গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত
দুটি মানুষের নতুন সম্পর্কের সূচনা হয় বিয়ের মাধ্যমে। সমাজে তারা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে পরিচিত হয়। বিয়ের পরে স্বামী-স্ত্রী মিলে বেড়াতে যাওয়ার একটা ট্রেন্ড তৈরি হয়ে গেছে। হানিমুন বাংলায় যাকে বলা হয় মধুচন্দ্রিমা। হানিমুন শব্দটি নবদম্পতিকে পুলকিত করে। বিয়ের পরই তারা কোথাও হানিমুনে যেতে মনস্থির করেন। দেশে বা দেশের বাইরে গিয়ে তারা হানিমুন করে থাকেন। বিয়ের আগে থেকেই পরিকল্পনা করতে থাকেন বর-কনে। সামর্থ্য অনুযায়ী হানিমুনের ধরন ভিন্ন হয়ে থাকে।
কিন্তু হানিমুন শব্দটি কোথা থেকে আসলো। হানিমুনের উৎপত্তি সম্পর্কে অনেকেরই জানা নেই। বিয়ের পরে বেড়াতে যাওয়ার সঙ্গে কিভাবে ‘হানি’ এবং ‘মুন’ জুড়ে গেল, ইতিহাস ঘেঁটে তার মোটামুটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। জানা যায়, ১৮ শতকে হানিমুন শব্দটির উৎপত্তি হয়েছিল। অতীতে কেবল পশ্চিমা দেশগুলোতে হানিমুনের চল ছিল। কিন্তু বর্তমানে এটির প্রচলন সব দেশে। তবে মজার বিষয় হলো, এখন অনেকে আবার বিয়ের আগেই প্রি-হানিমুন সেরে নিচ্ছেন। ইতিহাসে অনেক ধরনের ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায়। তবে কারণ যাই হোক না কেন, বিয়ের পর নবদম্পতির একে অপরকে আরও ভালোভাবে চেনা-জানার জন্য, দুজনে একসঙ্গে ভালো কিছু মুহূর্ত কাটানো, নতুন সম্পর্কের ভিত মজবুত করার জন্য এই ঘুরতে যাওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। দুজন মানুষের মধ্যে ভালোবাসা মজবুত করার জন্য হানিমুন ছাড়াও বছরে কমপক্ষে একবার ঘুরতে যাওয়া প্রয়োজন। এবার জেনে নেওয়া যাক হানিমুন নিয়ে কিছু তথ্য।
হানিমুনের উদ্ভাবক না কি জার্মানরা
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় হানিমুনের উদ্ভাবক জার্মানরা। দ্য শর্টার অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুযায়ী, হানিমুনের অর্থ ছিল ‘বিয়ের পরের প্রথম মাস’। কিন্তু হানিমুনের বর্তমান অর্থ হচ্ছে, ‘নবদম্পতির একসঙ্গে বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও সময় কাটানো’।
হানিমুন শব্দের উৎস ব্যাবিলন
আবার শোনা যায়, হানিমুন শব্দের উৎস ব্যাবিলন। প্রাচীন ব্যাবিলনে বিয়ের পরে মেয়ের বাবা জামাইকে তার চাহিদামতো মধু দিয়ে তৈরি মদ উপহার দিতেন। এই থেকেই হানি কথাটি এসেছে। ব্যাবিলনের ক্যালেন্ডার ছিল চান্দ্র। সেখান থেকে এসেছে মুন। শুরুতে নাকি ব্যাবিলনে বিয়ের পরের মাসকে হানি মান্থ বলা হতো। সেখান থেকে শব্দটি পরিবর্তিত হতে হতে শেষে হানিমুন হয়, যা প্রচলিত এবং জনপ্রিয় রীতি হিসেবেই গৃহীত।
ইংরেজি শব্দ থেকেই এসেছে হানিমুন
বিয়ের পর মাধুর্য ও সুখ বোঝাতে ‘হানি’ শব্দটি, আর ‘মুন’ ব্যবহার করা হয় চাঁদ হিসেবে। আর চাঁদ সময় হিসেবে দেখানো হয়। মধু মানে সুখ আর চাঁদ মানে সময়, সেখান থেকেই মধুচন্দ্রিমা বা হানিমুন বলা হয়।
হুন রাজা অ্যাটিলারের কান্ড
প্রাচীন হুন রাজা অ্যাটিলার সময় থেকে একটি রীতি প্রচলিত ছিল। বিয়ের পরে এক মাস প্রতিদিন এক পাত্র করে মধু দিয়ে তৈরি মদ খেতে হতো নবদম্পতিকে। নতুন সম্পর্ক সুখের ও মধুর করার জন্য এই রীতি ছিল। সেখান থেকেও হানিমুনের উৎপত্তি বলে মনে করা হয়। মধু দিয়ে তৈরি মদ খাওয়ার প্রথা সেই হুন রাজা অ্যাটিলার সময় থেকে চালু ছিল, যা থেকেই এসেছে হানিমুন শব্দটি।
১৯ শতকে ব্রিটেনে ছিল ব্রাইডাল ট্যুর
১৯ শতকে ব্রিটেনে যুগলরা বিয়ের পর ব্রাইডাল ট্যুরে যেতেন। তখন হানিমুন বিষয়টা এতোটা জনপ্রিয়তা লাভ করেনি। নবদম্পতিরা ব্রাইডাল ট্যুরে আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধুদের বাড়িতে যেতেন, যারা বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি নানা সমস্যার কারণে।
বাংলাদেশের মানুষের জন্য মধুচন্দ্রিমা
বাংলাদেশি অনেক দম্পতিরা বিয়ের পর দ্রুত সময়ের মধ্যে কোনো পর্যটন এলাকায় ঘুরতে যান। হানিমুনের স্মৃতি হিসেবে সমুদ্রসৈকত, পাহাড়ি ঝরনা, রিসোর্ট, দর্শনীয় স্থানে সুন্দর মুহূর্ত কাটান। বেশিরভাগ দম্পতি সমুদ্র সৈকত বেছে নেন। সম্প্রতি বিয়ের পর হানিমুনে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। ভারতের কাশ্মীর, দার্জিলিং, সিকিম এবং নেপাল, মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া যাচ্ছেন যুগলরা। কিছু শ্রেণির মানুষ প্যারিসেও গিয়ে থাকেন। এছাড়া ইদানীং দুবাইতেও গিয়ে থাকেন তারকারা।
কত ধরনের হানিমুন
জানলে অবাক হবেন হানিমুনের বিভিন্ন প্রকার রয়েছে। অ্যাডভেঞ্চার হানিমুন, সাফারি হানিমুন, রিসোর্ট হানিমুন, রোড ট্রিপ হানিমুন, মিনি মুনস, ফ্যামিলি মুন, সিটি হানিমুন, বেবি মুন, বিচ হানিমুন, ক্রুজ হানিমুন এসব বেশ পরিচিত। অনেকে নিজের অজান্তেই এক ধরনের হানিমুন করে ফেলেন যা সম্পর্কে তার ধারণা নেই। মূলত ঘুরাঘুরি করাটাই থাকে মূল লক্ষ্য। অ্যাডভেঞ্চার হানিমুন, রিসোর্ট হানিমুন, বিচ হানিমুন সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় দম্পতিদের কাছে।
হানিমুন ভ্রমণ হার বেশি জার্মানিতে
ইউরোপে নবদম্পতিদের কাছে হানিমুনের গুরুত্ব অনেক বেশি এবং মার্কিনীদের তুলনায় তারা মধুচন্দ্রিমা উদযাপনও বেশি করে। হানিমুন উপলক্ষ্যে ভ্রমণের হার সবচেয়ে বেশি জার্মানিতে। সেখানে প্রায় ৯১% নবদম্পতি বিয়ের পর মধুচন্দ্রিমা উপলক্ষ্যে বেড়াতে যান নানা স্থানে।
হানিমুনের জন্য জনপ্রিয় ১০ দেশ
হানিমুনের জন্য পৃথিবীর অনেক দেশ জনপ্রিয়। নবদম্পতিরা সেসব দেশগুলোতে বেশি ভ্রমণ করে থাকে। এমন দেশগুলো হলো মালদ্বীপ, ইতালি, বালি, গ্রিস, মালয়েশিয়া, অ্যান্টিগুয়া ও বার্বুডা, মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, দুবাই, কোস্টারিকা। এছাড়া পৃথিবীর অনেক দেশে মানুষ ঘুরে থাকে নিজের পছন্দ মতো।
তারকাদের হানিমুন
তারকাদের হানিমুন নিয়ে ভক্তদের ব্যাপক আগ্রহ কাজ করে। কিছু তারকাদের হানিমুনের গল্প শোনা যাক।
* ১৯৯১ সালের ২৫ অক্টোবর গৌরীর সঙ্গে সাত পাকে বাঁধা পড়েন শাহরুখ। গৌরীর সঙ্গে বিয়ের পর মধুচন্দ্রিমায় যাওয়ার সুযোগ পাননি শাহরুখ খান। ‘রাজু বান গয়া জেন্টলম্যান’ ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর কিং খান গৌরীকে বলেছিলেন, ছবির স্যুটিং বিদেশে হচ্ছে। তখন হানিমুন করতে গৌরীকেও সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সেই সময় আসলে তারা দার্জিলিং গিয়েছিলেন। এভাবে গৌরীকে বোকা বানিয়েছিলেন শাহরুখ।
* ২০১৫ সালে রীতিকা সজদের সঙ্গে বিয়ে হয় রোহিত শর্মার। বাইশ গজের এই সুপারস্টার ব্যক্তিগত জীবনেও নাকি খুব রোমান্টিক। হানিমুনে ইতালি উড়ে গিয়েছিলেন এই যুগল।
* ২০১০ সালের জুলাই মাসে সাক্ষী রাওয়াতকে বিয়ে করেন ক্যাপ্টেন কুল মহেন্দ্র সিং ধোনি। রোমান্টিক হানিমুনের জন্য ওই বছরই নভেম্বরে গোয়া উড়ে যান যুগল। ওয়াটার স্পোর্টস থেকে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার, সাক্ষী-মাহির মধুচন্দ্রিমাও ছিল একেবারে কুল।
* ফটোগ্রাফারদের চোখ ফাঁকি দিতে গোপনে ইতালিতে রূপকথার ডেস্টিনেশনে ওয়েডিং সেরেছিলেন বিরাট-আনুশকা। অনুষ্কা শর্মা আর বিরাট কোহলিদের একজন বাইশ গজের সম্রাট, অন্যজন বলিউডের প্রিয় মুখ। এই দুই হাই প্রোফাইল তারকাদের হনিমুন নিয়েও ভক্তদের উৎসাহের অন্ত ছিল না। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি পোস্ট করে যুগল জানিয়েছিলেন তারা ফিনল্যান্ডে হানিমুন করছেন।
* বিশ্বসুন্দরী ঐশ্বর্য রাই এবং অভিষেক বচ্চন ২০০৭ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই জুটি মধুচন্দ্রিমায় গিয়েছিলেন ইউরোপে। সেখানেই একে অপরের সঙ্গে বেশ কিছু ভালো মুহূর্ত কাটান তারা।
* কারিনা কাপুর খান এবং সাইফ আলি খান হানিমুন করতে গিয়েছিলেন সুইস আল্পসের গিস্তাদ নামের একটি ছোট্ট গ্রামে। সেই অঞ্চলের একটি অনবদ্য স্কাই রিসর্টে ছিলেন তারা। ম্যাডোনা থেকে প্রিন্সেস ডায়ানা, কত স্বনামধন্য মানুষের যে পা পড়েছে সেই গ্রামে, তার ইয়ত্তা নেই।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: জানা অজানা