হেমন্তের রাতে চলে গেলেন তারেক মাহমুদ

রোজ অ্যাডেনিয়াম

তখন গভীর রাত। হেমন্তের শিশির ঝরছিল টুপ টাপ। পথের পাশের কুকুরগুলো শীতল বাতাস ভারী করে তুলছিল করুণ আর্তচিৎকারে। মাঝে মধ্যে শোনা যাচ্ছিল রাতচরা পাখিদের ডাক। ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে ভেসে উঠলো একটা ছবি। কাঁধে একটা লাল মোরগ নিয়ে বসে আছেন কবি, অভিনেতা, চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাহমুদ। মজার ছবিই বটে। কিন্তু ছবির ক্যাপশনটা মজার ছিল না। সেখানে লেখা ‘তারেক মাহমুদ আর নেই।’ মনটা খারাপ হয়ে গেল। ২৬ অক্টোবর বৃহস্পতিবার গভীর রাতে কবি, অভিনেতা ও নির্মাতা তারেক মাহমুদ উড়াল দিয়েছেন পৃথিবীর পাঠ চুকিয়ে।

তার সঙ্গে তেমন সখ্যতা ছিল না আমার। তবে দেখা হতো মাঝে মধ্যে। শাহবাগে, ছবির হাটে কিংবা বইমেলায়, আজিজ পাড়ায়। নাহ তেমন কথাও হতো না। মনে পড়ছে একদিন তার ‘চটপটি’ সিনেমার শুটিং স্পটে গেছিলাম নিউজ কাভার করতে। কয়েকবার তার সিনেমার নিউজ করেছি। পড়ে আমার লেখাটার প্রশংসা করেছিলেন। আর কখনো কথা হবে না তার সঙ্গে। ওপারে ভালো থাকবেন ভাই।

তারেক মাহমুদের শেষ কবিতা

এটিই হয়তো কবি তারেক মাহমুদের লেখা শেষ কবিতা। ২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর নিজের ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন কবিতাটি। পড়লেই চমকে যাবেন।

ধবধবে সাদা রাত

বনানীর ১৮ নম্বর সড়ক দিয়ে হাঁটছিলাম রাতে

নিয়নবাতির রূপসী আলোর রাস্তায়

দীঘল খোলাচুলে সাদা শাড়ি পরা

অসাধারণ এক অচেনা ঝলমলে তরুনী

মুখরিত হাসি দিয়ে আমার পাশে দাঁড়ালো

বললো- যাবে?

বললাম- কোথায়?

বললো- সামনেই এক উচ্চবিত্ত কবরস্থান আছে। যাবে?

বললাম- নিশ্চয়ই। কবরস্থান আমার খুব প্রিয়।

জীবনের মানে খুঁজে পাই।

সাদা শাড়ি পড়া তরুনীটি আমার হাত ধরলো

আমরা এগিয়ে যেতে থাকলাম কবরস্থানের দিকে।

০৮.১০.২০২৩। রামপুরা, ঢাকা।

এই কবিতা লেখার আঠারো দিন বাদে সতিই তিনি হেঁটে গেলেন কবরের দিকে। কবরস্থান নাকি তার খুব প্রিয়।

হার্ট অ্যাটাক ও এক স্বপ্নবাজের মৃত্যু

হঠাৎ করেই সবাইকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন কবি তারেক মাহমুদ। অভিনেতা, নির্মাতা ও কবি তারেক মাহমুদ ২৬ অক্টোবর রাতে রাজধানীর একটি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। হার্ট অ্যাটাক কেড়ে নেয় তার তার প্রাণ। ঢাকা শহরে যে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলেন তারেক মাহমুদ সেটা অপূর্ণই থেকে গেল। তিনি ফিরে গেলেন নিজের জন্ম শহর পাবনায়। আর কখনো ঢাকায় ফিরবেন না তিনি। সেদিন দুপুরের পর তারেক মাহমুদকে সমাহিত করা হয় পাবনায়।

তারেক মাহমুদের জন্য শোক

তারেকের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন অনেকেই। অভিনয় শিল্পী সংঘের সাধারণ সম্পাদক রওনক হাসান ও তার বেশ কয়েকজন সহকর্মী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে নিয়ে লিখেছেন। রওনক হাসান বলেন, ‘মগবাজার কমিউনিটি হাসপাতালে তারেক ভাই না ফেরার দেশে চলে গেছেন! তার আত্মার শান্তি হোক।’ ফেসবুকে দীর্ঘ স্ট্যাটাস লিখেছেন অভিনেতা সিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন, আমার নাটকে আমার একটি প্রিয় চরিত্র করেছিলেন তিনি। নাটকের নাম ‘গফুরের বিয়ে’। চরিত্রের নাম ছিল আলতা পাগলা। বাস্তবে আলতা চরিত্রটি আমার কাকা। সবাই তাকে আলতা পাগলা বলে ডাকে। চরিত্রটি যখন তাকে বুঝিয়ে বললাম। এমন অভিনয় তিনি করেছিলেন যে, তার ভেতরে আমি আমার কাকাকে দেখেছিলাম। তারেক ভাই শক্তিমান অভিনেতা ছিলেন। কিন্তু এই দেশ ও জাতি তাকে চিনতে পেরেছিল কি না জানি না।

নিজ জেলায় শোক সভা

পাবনার সাহিত্য সংগঠন ‘পাবনা লেখক ঐক্য’র উদ্যোগে সদ্যপ্রয়াত কবি-সম্পাদক চলচ্চিত্র অভিনেতা তারেক মাহমুদ ও পাবনার কবি মির্জা তাহের জামিল এবং সাগর আল হেলালের স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয় ৩ নভেম্বর। গল্পকার মির্জা তাহের জামিল ও কবি হেলালকেও এসময় স্মরণ করা হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতে ৩ কবির বিদেহি আত্মার প্রতি সম্মানসূচক ১ মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠানে তারেক মাহমুদ পরিচালিত ‘চটপটি’ সিনেমার শুভমুক্তির জন্য সরকারি অর্থায়নের চেষ্টা করা হবে বলে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

শিল্পকলায় স্মরণ সভা

মৃত্যুর পরের দিন তারেক মাহমুদ স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয় সেগুনবাগিচায়, শিল্পকলা একাডেমির নাট্যশালা মূল মিলনায়তনে। এক সময় শিল্পকলায় আড্ডা দিতেন কবি। প্রায় দেড়শো বন্ধু-স্বজন-সহকর্মী একত্রিত হয়ে তারেক মাহমুদকে স্মরণ করেন। বন্ধু-স্বজন-সহকর্মীদের স্মৃতিচারণে উঠে আসে কবি তারেক মাহমুদের পাবনা থেকে ঢাকায় এসে তিন দশককাল জীবনযাপন, কবিতা চর্চা, লিটল ম্যাগাজিন ‘পথিক’ সম্পাদনা করা, নাটক-সিনেমায় অভিনয় ও নির্মাণ প্রসঙ্গ। উঠে আসে তারেকের ব্যক্তিগত জীবনের লড়াই, অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার সংগ্রাম, বিবাহিত জীবন, ভাঙন, সন্তান প্রসঙ্গ। প্রায় পঞ্চাশজন কথা বলেন তারেককে নিয়ে।

তারেকের ‘চটপটি’ সিনেমা

সিনেমার কাজ প্রায় শেষ করেছিলেন তারেক। সাউন্ডের কাজ একটু বাকি আছে। অর্থের অভাবেই কাজটুকু শেষ করে যেতে পারলেন না তিনি। তারেক ‘আইসক্রিম’ নামে একটি সিনেমা বানাতে চেয়েছিলেন। রেদোয়ান রনি ঐ নামে সিনেমা নির্মাণ করে ফেলেন তার আগেই। পরে ‘চুইংগাম’ নামে একটি সিনেমা বানাতে চান। সেটাও হয়নি। ওই নামে এফডিসির একজন ডিরেক্টর সিনেমার নাম বুকিং দেন। অবশেষে ‘চটপটি’ নির্মাণ করেন তারেক মাহমুদ।

অভিমানি কবি

স্বনামধন্য পত্রিকার পাতায় ছাপা হতো না তারেক মাহমুদের কবিতা। তারেক নিজেই একটা পত্রিকা বের করতেন, নাম ‘পথিক’। ‘ছায়ালোক’ পাবলিকেশন্স-এর ব্যানারে নিজের বই নিজেই প্রকাশ করতেন। নিজেই বই ও ‘পথিক’ পত্রিকা বিক্রি করতেন। তারেকের প্রথম কবিতার বই ‘কালার বাঁশি।’ বইটির প্রচ্ছদের ছবিতে ছিল চারুকলার ভেতরে থাকা একটি নারী ভাস্কর্যের মুখে তারেক নিজেই চুমু দিতে যাচ্ছেন এমন একটা ভঙ্গি।

ঠিকানা ও পরিবার

আজিজ মার্কেটের আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোরে ছিল তারেকের একটি রুম। ওটাই ‘ছায়ালোক’ প্রকাশনী, ওখান থেকেই বের হতো ‘পথিক’। নব্বই দশকের শুরু থেকেই শাহবাগ, পাবলিক লাইব্রেরি, চারুকলা, ছবির হাট, টিএসসি, বইমেলা, বাংলা একাডেমি চত্বর, সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে কেটেছে তার সময়। বিয়ে করেছিলেন তারেক মাহমুদ। সংসার টেকসই হয়নি। একটি ছেলে সন্তান আছে তার।

অভিনেতা তারেক

২০০৮ সালে একটি টেলিভিশন প্রোডাকশনে তারেক টোকন ঠাকুরের সঙ্গে কাজ করেছিলেন কালা জাহাঙ্গীর ওরফে হ্যারি কে টমাস চরিত্রে। ওই সময়ে আরও কয়েকটি নাটকে তারেক অভিনয় করে দর্শকদের নজরে আসেন। এরপর নিজে নির্মাতা হতে চাইলে তাকে আর কেউ অভিনয়ে তেমন ডাকেনি।

শেষ কথা ও এক বন্ধুর স্ট্যাটাস

তারেক মাহমুদের মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন অনেকেই। কবি টোকন ঠাকুর লিখেছেন তাকে নিয়ে। একটি অনলাইনে পোর্টালে সেগুলো প্রকাশ পেয়েছে। অনেক কিছু উঠে এসেছে সেখানে। নিচের স্ট্যাটাসটি কবি মাসুদ পথিকের লেখা। তারেকের মৃত্যুর পর লেখা কবি লেখাটির শিরোনাম দিয়েছেন ‘কবি ও অভিনেতা তারেক মাহমুদ ও আজিজ সুপার মার্কেট। এবং আমাদের মৃত্যু।’ লেখাটি এমন:

‘শূন্যতা, তাকে রাখার জায়গা নেই আমার ভেতর। মৃত মানুষের তা থাকে না। তবুও, কেমন লাগছে, শূন্য নয়, কেবল শূন্যতা নয়, মনটা হাহাকার করছে। গত দুবছরে অনেক নির্মম, অনেক নিষ্ঠুরতা দেখলাম। উপভোগ করলাম। তো, এই ফিলিংগুলো ব্যক্তিগতই থাকে। একান্ত। কিন্তু ব্যক্তিগত নয়। আমরা যারা কবিতার নেশায় বুঁদ, শিল্পের দাস, কামলা বা মুনি, তারা জীবনকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতেই এসেছি। তবু, কিছু করার থাকে, সামষ্টিক ফিলোসোফি থাকে। কবি ও অভিনেতা তারেক মাহমুদের তা ছিলো। চোখে চকচক করতো তীব্র বোহেমিয়ান কিরণ। শিল্পের প্রতি দায়, নেশা। তারেক মাহমুদের সঙ্গে প্রথম পরিচয়, সম্ভবত ১৯৯৫ সালে, আজিজ সুপার মার্কেটের কাফে এলি রেস্টুরেন্টে। তারপর দীর্ঘদিন, একটা কালখণ্ড ধরে মেশা, আড্ডা, আলোচনা, স্মৃতি। আমার প্রথম সিনেমা ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ (২০১১)০এ অভিনয় করেছিলো তারেক মাহমুদ। ‘মায়া: দ্য লস্ট মাদার’ ও ‘বক’ সিনেমায় অভিনয় না-করতে পারার আফসোস ছিলো, কথা ছিলো, পরবর্তী সিনেমায় অভিনয়ের। গতকালও, রাতে তার মৃত্যু সংবাদ তৈরি হবার আগের বিকেলে, তার সঙ্গে দেখা হলো। সে একই জেশ্চার, হাসি। অহংকার শূন্য অবয়ব। উচ্ছল এক মানুষ। সহজতা। সফলতা, বিফলতা, গুণবিচার, সলিড মতাদর্শ, এগুলো আপেক্ষিক। কেবল ভাবা, ভাবা প্র্যাকটিস করাই শিল্পীর কাজ। আর কাজে চলমান থাকা। কবি তারেক মাহমুদ ‘কালার বাঁশি’ বাজাতে বাজাতে চলে গেলেন, না ফেরার দিকে। না-ফেরার দিকে কি শিল্প চর্চা হয়? ভাবি, কেবল ভাবি! তারেক আমার বন্ধু। আমাদের বন্ধু।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্মৃতিচারণ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

twenty + 6 =