অস্থিরতায় নতুন মাত্রা ‘অখণ্ড ভারতের মানচিত্র’

মাহবুব আলম

নতুন দিল্লিতে ভারতে নবনির্মিত সংসদ ভবনের ‘অখণ্ড ভারতের’ ম্যুরাল তথা মানচিত্র স্থাপন করা হয়েছে। ওই মানচিত্রে স্থাপন করার পর ভারতের সংসদবিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশি মানচিত্রের ছবি টুইট করে বলেছেন, ‘আমাদের স্বপ্ন অখণ্ড ভারত’। বিজেপি তথা আরএসএসের এই অখণ্ড ভারতের মানচিত্রের রাজনীতি দক্ষিণ এশিয়ায় অস্থির পরিবেশের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ এই মানচিত্রে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, মালদ্বীপ এমন কি তিব্বতকে অখণ্ড ভারতে অন্তর্ভুক্ত দেখানো হয়েছে।

স্বাভাবিকভাবেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশে দেশে নিন্দা-প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। পাকিস্তান ও নেপাল ইতিমধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে নিন্দা-প্রতিবাদ করে ওই মানচিত্র প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ না করলেও এ বিষয়ে ভারত সরকারের কাছে ব্যাখ্যা দাবি করেছে। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বাদে প্রায় সকল রাজনৈতিক দল ও সংগঠন ভারতের এই দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ডের নিন্দা-প্রতিবাদ করে অবিলম্বে ওই মানচিত্র প্রত্যাহারের দাবি করেছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন পত্রপত্রিকাসহ সামাজিকমাধ্যমে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এসব সামাজিকমাধ্যমে পাল্টা অখণ্ড বাংলার মানচিত্র পোস্ট করা হচ্ছে।

একই ঘটনা ঘটেছে নেপালে। নেপালে ১৮৪৬ সালের সুগোলি চুক্তির আগের মানচিত্র প্রকাশ করে তা তাদের প্রশাসনিক দপ্তরে উত্তোলন করা হচ্ছে। সরকারিভাবেও নেপাল কড়া প্রতিবাদ করেছে।

অখণ্ড ভারতের মানচিত্রে গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনী ও তার পৈত্রিক বাড়ি কপিলাবস্তুকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত দেখানোর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে নেপাল ভারতের চিকেননেক-শিলিগুড়ি করিডরকে নিজেদের বলে দাবি করেছে। শুধু তাই নয়, এই দাবি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে সরাসরি উপস্থাপন করেছেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমাল দাহাল প্রচন্দ।

উল্লেখ্য, ভারত চানক্য দর্শন দ্বারা পরিচালিত হয়। আর এই চানক্যই সর্বপ্রথম অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন দেখেন। এই লক্ষ্যে তিনি সম্রাট বিন্দুসারের পুত্র যুবরাজ অশোককে গড়ে তোলেন। অশোক সম্রাট হয়ে ভারতের বিভিন্ন ছোট-বড় রাজ্যকে ঐক্যবদ্ধ করে অখণ্ড ভারত গড়ে তোলেন। তারপর বিগত কয়েক হাজার বছরে বহ্মপুত্র, গঙ্গা, যমুনা, ইরাবতী, ঝিলম দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে। একের পর এক সম্রাজ্য গড়ে উঠেছে। আবার পতনও হয়েছে। সেই সাথে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণা তৈরি হয়েছে। এবং এই অঞ্চলে অনেকগুলো স্বাধীন সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। কিন্তু তারপরও হিন্দুত্ববাদী আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ) ও বিজেপিসহ তার বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন এখনো তাদের সেই পুরনো ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। এখনো তারা অখণ্ড ভারতের স্বপ্নের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। আর তাইতো বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, আফগানিস্তানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করে এই দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের সেই স্বপ্নের রাষ্ট্র গঠনের চক্রান্ত ও চূড়ান্ত করেছে। এক্ষেত্রে এখন আর তারা কোনো রাখ-ঢাক করছে না। আর তাইতো খোদ ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী যোশি টুইট করে বলেন, ‘আমাদের স্বপ্ন অখণ্ড ভারত’। আর এর পরিণতি ভারতের নবনির্মিত সংসদ ভবনে অখণ্ড ভারতের ম্যুরাল বা মানচিত্র। যার আয়তন হবে ৭১ লাখ ২৭ হাজার ২৯৩ বর্গ কিলোমিটার। যা হবে ভারতের প্রাচীন যুগের মৌর্য ঐক্যবদ্ধ ভারত। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো- ভারতের পাঁচ হাজার বছরে ইতিহাসে কখনোই একটি একক রাষ্ট্র বা দেশ ছিল না। ভারত ছিল অনেক ছোট-বড় রাজ্যের সমষ্টি। ঠিক যেমন ছিল ইউরোপ। ইউরোপের ছোট-বড় সব দেশ নিজেদের ইউরোপীয় হিসেবে পরিচয় দিলেও তাদের প্রত্যেকের জাতীয়তা, ভাষা ও ধর্ম ছিল ভিন্ন।

দুর্ভাগ্যজনক, ভারতে হিন্দুত্ববাদীরা অখণ্ড ভারতের নামে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অস্বীকার করতে চায়; তার চাইতেও বড় কথাÑ এই হিন্দুত্ববাদীরাই ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ করে। অবশ্য তার আগেই বার্মা (মিয়ানমার) ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। আর আফগানিস্তান কার্যত ভারতবর্ষের অংশই ছিল না। বরং আফগানরা ভারত জয় করে ভারতকে তাদের অংশে পরিণত করেছিল।

শুরুতেই বলেছি, আরএসএসের অখণ্ড ভারতের মানচিত্রের রাজনীতি এই অঞ্চলে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। তার লক্ষণ সুস্পষ্ট। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে নিন্দা-প্রতিবাদের ঝড়ের মুখে ভারত যে ব্যাখ্যা দিয়েছে তা মোটেও গ্রহণযোগ্য হয়নি। ভারত সরকার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছে, এটা কোনো রাজনৈতিক মানচিত্র নয়, এটা সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক মানচিত্র; এটা সম্রাট অশোকের আমলের মানচিত্র।

ইতিমধ্যে আরও উল্লেখ করেছি, অখণ্ড ভারতে মানচিত্রকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে নেপাল তার বৃহত্তর নেপালের মানচিত্র প্রকাশ করে তা বিলিবণ্টন করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে অখণ্ড বাংলার মানচিত্র পোস্ট হচ্ছে ফেসবুকে। এ সবই অস্থিরতার লক্ষণ।

এ বিষয়ে সিপিবি এক বিবৃতিতে বলেছে, এর ফলে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। এমনিতেই প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো না। বিশেষ করে পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক তো একেবারেই শত্রুতার পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে সেই কয়েক দশক ধরে। সম্প্রতি নেপালের সঙ্গেও সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে সম্পর্কের মধ্যে রয়েছে নানান সন্দেহ অবিশ্বাস। এই অবস্থা আর যাই হোক কোনো ভালো লক্ষণ নয়। আর তাইতো জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন, ১৯৪৭ উত্তর আধুনিক রাজনৈতিক মানচিত্রে অখণ্ড ভারত বলে কিছু নেই। এটা অনভিপ্রেত। তাই ভারতের উচিত বিষয়টা সংশোধন করা। তিনি আরো বলেছেন, এটা আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি। একই কথা বলেছেন বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অন্যান্য দলের নেতৃবৃন্দ। মির্জা ফখরুল একে অপমানজনক বলেও মন্তব্য করেছেন। তারপরও ভারতের টনক নড়ছে বলে মনে হয় না।

অতএব এই বিষয়টা পরস্পর সন্দেহ অবিশ্বাসকে শুধু উস্কে দেবে তা নয়, এটা অস্থির অবস্থারও সৃষ্টি করতে পারে। অবশ্য ভারতের বিবেকবান মানুষ এ বিষয়ে শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত নেয় তা দেখার বিষয়। কারণ খোদ ভারতে হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও সংগঠন লড়াই সংগ্রাম করছে।

এ বিষয়ে আরেকটি কথা না বললেই নয় তা হলো- সর্বভারতীয় দলের অনুপস্থিতি বা তাদের শক্তিমত্তার দুর্বলতার সুযোগই হিন্দুত্ববাদের উত্থান ও বাড়বাড়ন্ত অবস্থা। এই অবস্থা ভারতের নিজেদের ঐক্য ও সংস্কৃতিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। তারপরও কেনো এই অখণ্ড ভারতের চিন্তা। তাছাড়া অখণ্ড ভারতে তো হিন্দুদের একচ্ছত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতাও থাকবে না। অতএব বিষয়টা স্রেফ একটা পোপাগান্ডা হতে পারে। যার লক্ষ্য হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করে হিন্দু ভোটের একক ঠিকাদার হওয়া।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সমসাময়িক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

nine + 5 =