নন্দিত থিয়েটার ব্যক্তিত্ব শিমুল ইউসুফ

সংশপ্তক হাসান

থিয়েটারে যেমন শিমুল ইউসুফ সাবলীল তেমনি তার রয়েছে মনমাতানো সংগীত পরিবেশন ক্ষমতা। শিল্পাঙ্গনের সব শাখায় স্বমহিমায় বিচরণ রয়েছে একুশে পদকপ্রাপ্ত এই বরেণ্য ব্যক্তিত্বের। শিমুল ইউসুফের পৈতৃক নিবাস ঢাকার অদূরে বিক্রমপুরে। তবে তার জন্ম ঢাকায়। ১৯৫৭ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আট ভাইবোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবার ছোট। তার পরিবারের ছিল শিল্পসম্বৃদ্ধ পরিবার। বাবা মেহথের বিল্লাহ ছিলেন একজন গায়ক। মা-ও ছিলেন সংগীত বোদ্ধা। সে কারণে শিমুল ও তার বাকি ভাই বোনেরাও হয়ে উঠেছিলেন শিল্পমনস্ক।

পিতার সান্নিধ্য বেশিদিন কপালে জোটেনি শিমুল ইউসুফের। বয়স যখন মাত্র চার তখন পিতৃবিয়োগ ঘটে তার। কিন্তু পিতার অভাব বুঝতে দেননি তার মা। আট সন্তানের মাথার ওপর ছায়া হয়ে বিরাজ করছিলেন তিনি। শিমুল ইউসুফ দেশের বরেণ্য ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্যে এসেছিলেন ওই ছোট বয়সেই। পেয়েছিলেন কবি সুফিয়া কামালের স্নেহস্পর্শ। তাকে খালা বলে ডাকতেন তিনি। শিমুলের বড় ভাই-বোনেরা যেতেন কচিকাঁচার আসরে। ভাইবোনদের সাথে তিনিও যেতেন সেখানে। সুফিয়া কামালের দুই মেয়েও ছিলেন কচিকাঁচার আসরের নিয়মিত সদস্য। ফলে কবিকন্যাদের সাথে শিমুল ও তার ভাইবোনদের ভাব হতে সময় লাগেনি।

সেসময় কচিকাঁচায় শেখাতেন দেশের সব বিখ্যাত মনিষীগণ। এর মধ্যে ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কবি জসীমউদ্দীন, চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান, ছড়াকার রফিকুজ্জামান দাদাভাই। ফলে শৈশবেই দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য পান তিনি। শিল্পাঙ্গনে শিমুল ইউসুফ আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয়েছিল মাত্র পাঁচ বছর বয়সে। তিনি মঞ্চে গান ও অভিনয় দিয়ে শুরু করেন। বেতারে নাম লেখাতেও বেশি সময় লাগেনি শিমুল ইউসুফের। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬৩ সালে তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানে সংগীত পরিবেশন করেন তিনি। পাকিস্তান টেলিভিশন যুগে প্রবেশ করে ১৯৬৪ সালে। শিমুল ইউসুফও ছিলেন সেখানে। সম্প্রচারের প্রথম দিনই শিশুশিল্পী হিসেবে সংগীত পরিবেশন করেন তিনি। প্রথম রেডিওতে তালিকাভুক্ত শিল্পী হয়ে ১০ টাকা সম্মানী পেয়েছিলেন তিনি। টেলিভিশনে গিয়ে সেই সম্মানী বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১৫ টাকা।

ছোটবেলা থেকেই এক সুন্দর পৃথিবীতে বেড়ে উঠেছেন শিমুল ইউসুফ। এটি সম্ভব হয়েছিল তার মায়ের কারণে। বাবা মারা গেলে শিমুল ইউসুফের আট ভাইবোনদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন মা। তিনি বলেছিলেন, যদি সাংস্কৃতিক পরিবেশে বড় না হও, তাহলে বুঝতেই পারবে না যে পৃথিবীটা কত সুন্দর। মায়ের কথা বাণী ভেবে শিল্পের পথে বেড়ে উঠছিলেন শিমুল। আর এই পথে তার নির্দেশক তো ছিলেন শিল্পের পুরোধা ব্যক্তিগণ। সেকারণে পৃথিবীটা সুন্দরই ছিল তার।

শিমুল ইউসুফের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ শহীদ সংগীতজ্ঞ আলতাফ মাহমুদ। তিনি ছিলেন তার ভগ্নিপতি। এর পেছনে একটি গল্প আছে। ১৯৬৩ সালে শিমুল ইউসুফরা বরিশাল গিয়েছিলেন কচিকাঁচার একটি অনুষ্ঠান করতে। সেখানেই সুরকার আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে পরিচয়। পরে শিমুলের বড় বোনের সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন আলতাফ মাহমুদ। এর মাধ্যমে কিংবদন্তি এ সুরকার ঘরের মানুষ হয়ে ওঠেন শিমুলদের। আলতাফ মাহমুদের সান্নিধ্যে এসে তার সাংস্কৃতিক পরিধি যেন আরও প্রসারিত হয়ে ওঠে। আলতাফ একইসঙ্গে অভিভাবক ও শিক্ষক হয়ে ওঠেন তার। তাদের সম্পর্কটা ছিল গুরু-শিষ্যের। শ্যালিকা বলে আলতাফ মাহমুদ বিন্দুমাত্র ছাড় দিতেন না। ছোট্ট শিমুলের রোজ রেওয়াজ ছিল বাধ্যতামূলক। কোনোদিন ব্যত্যয় ঘটলে সেদিন পারতপক্ষে বোনজামাই আলতাফ মাহমুুদের সামনে যেতেন না শিমুল।

ছোটবেলা থেকেই শিমুল ইউসুফ ছিলেন বহুগুণে গুণান্বিত। সংগীতের বাইরে সংস্কৃতি অঙ্গনের বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় বিচরণ ছিল তার। গানের পাশাপাশি নাচ ও অভিনয়েও বেশ দক্ষতা ছিল তার। শিমুল ইউসুফ থিয়েটারে নিজেকে মেলে ধরেন ১৯৭৪ সালে। সে বছর ‘বিদায় মোনালিসা’ নামের একটি নাটক দিয়ে থিয়েটার যাত্রা শুরু হয় তার। এ নাটকে শিমুলের চরিত্রটির নাম ছিল সূর্য। চরিত্রটি মঞ্চে সাবলীলভাবে উপস্থাপন করে বেশ প্রশংসিত হন তিনি।

এরপর একের পর এক থিয়েটারে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি অভিনয় করেন ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি’র নার্স, ‘শকুন্তলা’র গৌতমী, ‘কীত্তনখোলা’র ডালিমন চরিত্রে। এছাড়া তিনি অভিনয় করেছেন ‘কেরামতমঙ্গলে’র শমলা, ‘হাতহদাই’-এ চুক্কুনি, ‘যৈবতী কন্যার মন’-এ কালিন্দি, ‘চাকা’য় কথক, ‘বনপাংশুল’-এ সুকি, ‘প্রাচ্য’তে আবারও কথক এবং ‘বিনোদিনী’র বিনোদিনী চরিত্রে। প্রতিটি চরিত্রে অভিনয়ে তার ছিল পরম নিষ্ঠা ও মমতা। থিয়েটার আর শিমুল যেন একে অন্যের। শুধু অভিনয়ে নয় দেশে থিয়েটার বিপ্লবেও বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। গ্রাম থিয়েটার আন্দোলন গড়ে তুলতে সংঘবদ্ধ হয়েছিলেন। ছড়িয়ে দিয়েছিলেন গ্রাম থিয়েটার আন্দোলন। নাট্যাঙ্গনের সবারই জানা মঞ্চের প্রতি শিমুল ইউসুফের নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার কথা। সেকারণে সবাই তাকে উপাধি দিয়েছে ‘মঞ্চকুসুম’। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনেরও প্রিয়পাত্র ছিলেন তিনি।

দীর্ঘ থিয়েটার ক্যারিয়ারে শিমুল ইউসুফ ৩৩টি নাটকে অভিনয় করেছেন ষোলো শতাধিক বার। দেশের বাইরেও প্রশংসিত হয়েছে তার অভিনয়। এ গুণী থিয়েটার ব্যক্তিত্বের একক নাটক ‘বিনোদিনী’ বিশ্বনাট্য অলিম্পিকস ও আন্তর্জাতিক মনোড্রামা উৎসবে মঞ্চস্থ করা হয়েছিল। নাটকটি দুই জায়গাতেই ভীষণ প্রশংসিত হয়। শিমুল প্রথম বাঙালি অভিনেত্রী হিসেবে অভিনয় করেছেন ‘দ্য টেম্পেস্ট’ নাটকে। শেক্সপিয়রের এ নাটকটি অনুবাদ করেছিলেন রুবাইয়াৎ আহমেদ। এটি মঞ্চস্থ হয়েছিল ইংল্যান্ডের বিখ্যাত শেক্সপিয়র’স গ্লোব থিয়েটারে। নির্দেশনায় ছিলেন তার স্বামী নাসিরুদ্দিন ইউসুফ।

দেশের অভিনয় অঙ্গনের তারকাদের মধ্যে যারা থিয়েটার থেকে উঠে এসেছেন তাদের অনেকেরই লক্ষ্য থাকে টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের। সেখানে সফল হলে সহজেই নিজেদের শিকড় থিয়েটারকে ভুলে যান তারা। কস্মিনকালেও আর ওমুখো হন না। শিমুল ইউসুফ এখানেই ব্যতিক্রম। টিভিতে কাজ করেও ভুলে যাননি নিজের ভুবন। তাই তো ফিরে এসেছেন থিয়েটারে। টিভি অভিনয়শিল্পীর বদলে তিনি পরিচিত হয়েছেন থিয়েটারের পুরোধা হিসেবে। টেলিভিশন থেকে তিনি বিদায় নেন ১৯৯২ সালে। ‘গ্রন্থিকগণ কহে’ নামের একটি নাটকের মাধ্যমে টিভি ক্যারিয়ারে ইতি টেনেছিলেন তিনি।

আগেই জেনেছি সংগীতের সাথে শিমুলের সখ্যতা শৈশব থেকে। নজরুল, লালন ও গণসংগীতের চর্চা করেন ছোট থেকেই। উচ্চাঙ্গ সংগীতেও তার জুড়ি মেলা ভার। তিনি সংগীতে পাঠ নিয়েছিলেন ওস্তাদ হেলাল উদ্দিন, পিসি গোমেজ, ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদ, শহীদ আলতাফ মাহমুদ, শেখ লুৎফর রহমান, আব্দুল লতিফ, ওস্তাদ ইমামউদ্দীন এবং সুধীন দাসের মতো গুণী সংগীতজ্ঞদের কাছে। এছাড়া আলতাফ মাহমুদ সংগীত বিদ্যা নিকেতন থেকে সংগীতের ওপর একটি ডিপ্লোমা কোর্সও করেছেন। শিমুল ইউসুফের শিল্পীজীবন দীর্ঘ পাঁচ দশকের। লম্বা এই সময়ে তিনি অগণিত নজরুল সংগীত ও গণসংগীত গেয়েছেন।

শিমুল ইউসুফ বিবিধ গুণে গুণান্বিত হলেও তার ভেতর প্রধানত তিনটি সত্ত্বা ভীষণ প্রকট। এর মধ্যে একটি অভিনয়। এর বাইরে তিনি একজন সংগীতজ্ঞ। কণ্ঠশিল্পী ও সংগীত পরিচালক হিসেবে তার জুড়ি নেই। এছাড়াও তিনি একজন অ্যাক্টিভিস্ট। দেশপ্রেম তার বড়ই প্রখর। দেশের ক্ষেত্রে কখনও আপোষ করেননি। সংকটকালে থিয়েটারের মঞ্চ থেকে রাজপথে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন অসংখ্যবার। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে যেমন সক্রিয় ছিলেন তেমনই যুদ্ধপরাধীর বিচারের দাবিতে যখন দেশপ্রেমিক তরুণ জনতা এক হয়েছিল শাহবাগে। রাজাকারের ফাঁসির দাবিতে সেøাগানে মুখরিত হয়েছিল শাহবাগ চত্ত্বর। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ যোগ দিয়েছিল তাতে। শিমুল ইউসুফও ছিলেন এই দলে। যুদ্ধপরাধীর বিচারের দাবিতে উত্তাল শাহবাগের সাথে একাত্ম হয়েছিলেন তিনি। উচ্চকিত কণ্ঠে বিচার চেয়েছিলেন দেশদ্রোহীর।

দীর্ঘ ক্যারিয়ারে শিল্পে অমূল্য অবদান রাখায় অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন শিমুল ইউসুফ। চলতি বছর পেয়েছেন দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক। অভিনয়ে অবদান রাখায় এ পদক দেওয়া হয় তাকে। ব্যক্তিগত জীবনে শিমুল ইউসুফ নন্দিত থিয়েটার ব্যক্তিত্ব ও নির্মাতা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর সহধর্মিণী। এদেশে থিয়েটার যাদের মাধ্যমে সমৃদ্ধশালী হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। দেশের শিল্পাঙ্গনে অবদান রাখা শিমুল ইউসুফ যৌথজীবনে আছেন তারই সহকর্মী-সহযোদ্ধার সঙ্গে। যারা একে অন্যের সহযোগিতা অনুপ্রেরণায় সমৃদ্ধ করে তুলেছেন দেশের শিল্পাঙ্গন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ব্যক্তিত্ব

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

one × 1 =