আগের জমিদারই ভালো ছিল…

মাহবুব আলম

অনেকদিন আগে আমাদের দেশে এক অত্যাচারী জমিদার ছিল। সেই জমিদারের মৃত্যুর পর তার দুই পুত্র সিদ্ধান্ত নিল বাবার শ্রাদ্ধে আশেপাশের গ্রামের সকলকে নিমন্ত্রণ করা হবে। সেই সাথে ব্রাহ্মণ ভোজের আয়োজন ও দান-দক্ষিণা করা হবে। যাতে সকলে তার বাবার স্বর্গ লাভের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে। কিন্তু নিমন্ত্রণ করতে গিয়ে দেখা গেল গ্রামের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকেই বলাবলি শুরু করছে, এমন অত্যাচারী জমিদারের নরকেও ঠাঁই হবে না। যত শ্রাদ্ধ, আরতি, পূজা-অর্চনা যাই করুক না কেন, কোনো কাজ হবে না। ঈশ্বর বলে কথা। ঈশ্বর সব দেখেছে।

গ্রামবাসীর এসব কথা শুনে জমিদার পুত্রদ্বয় খুব ভেঙে পড়ে। শত হলেও বাবার শ্রাদ্ধ বলে কথা। তার উপর তিনি দাপুটে জমিদার ছিলেন। তার কথায় বাঘে ছাগলে এক ঘাটে পানি খেত। সেই জমিদারের পুত্র তারা। তারা কি সহজে হাল ছাড়তে পারে? না, পারে না। তাই তারা তাদের অভিজ্ঞ নায়েব মহাশয়ের পরামর্শ চাইলেন। অভিজ্ঞ নায়েব অনেক চিন্তা-ভাবনা করে তাদের পরামর্শ দিয়ে বললেন, আপনার বাবার চাইতেও আপনাদের আরও বেশি অত্যাচারী হতে হবে। এজন্য তিনি প্রথমেই বললেন, আপনার বাবা জমিদারের পুকুর থেকে পানি নেওয়ার জন্য কলসি প্রতি এক পয়সা নিতেন। এটা দুই পয়সা করে দেন। আর সেইসাথে যে পানি নিতে আসবে সে নারী-পুরুষ যেই হোক তার পিঠে পাছায় একটা বেতের বাড়ির নির্দেশ দিয়ে দিন। নায়েব মহাশয়ের পরামর্শ বলে কথা। সঙ্গে সঙ্গে দুই ভাই আদেশ দিয়ে দিল জমিদারের পুকুর থেকে পানি নিতে এখন থেকে দুই পয়সা দিতে হবে। সেই সাথে একটা বেতের বাড়ি।

এই ঘটনায় গ্রামে ছিঃ ছিঃ রব উঠে গেল। দুদিন না যেতেই আর এক কেলেঙ্কারি। গ্রামের সুন্দরী নারী দেখলেই জমিদার পুত্রদের পাইক পেয়াদারা তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া শুরু করল। কি ব্যাপার? জিজ্ঞেস করলেই এক উত্তর, জমিদার পুত্রদ্বয়ের আদেশ একে বাগানবাড়িতে নিতে হবে। আগেও এমনটা হয়েছে তবে তা অনেকটা লুকোচুরি করে রাতের আঁধারে। কিন্তু এবার প্রকাশ্যে দিনের বেলায় গ্রামবাসীদের চোখের সামনে।

এই ঘটনায় সর্বত্র বলাবলি শুরু হলো- এরা তো বাপের চাইতেও বড় অত্যাচারী। মহা অত্যাচারী। এদের তুলনায় আগের জমিদার তো অনেক ভালো ছিল। আর যাই হোক এভাবে প্রকাশ্যে বউ-ঝিদের পাইক পেয়াদা দিয়ে তুলে নিয়ে যায়নি। আর কলসি প্রতি এক পয়সা এটা তো দেওয়া যেত, এখন দুই পয়সা। কী অত্যাচার। তারপর বেতের বাড়ি। এমন অত্যাচার কেউ কখনো করেনি। এভাবে কিছুদিনের মধ্যে গ্রামের মানুষ সেই অত্যাচারী জমিদারের অত্যাচার ভুলে গেল। অনেকে তার জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনাও শুরু করল। সবাই কমবেশি এক হলো আগের জমিদারই ভালো ছিল। এদের তুলনায় ভগবান ছিল।

পুরান ঢাকার মিরনজিল্লার হরিজন পল্লী উচ্ছেদ করে সেখানে মার্কেট নির্মাণের পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নে বুলডোজার দিয়ে ঘরবাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় দেশের হরিজনের মধ্যে তখন অনেকেই বলাবলি করেছে আগের জমিদার, আগের রাজাই তো ভালো ছিল। এখানে আগের জমিদার ও আগে রাজা বাদশা বলতে জেনারেল এরশাদ ও তার আমলের ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক জেনারেল মাহমুদুল হাসানকে বোঝানো হচ্ছে। সত্যিই তো তাই। জেনারেল এরশাদের শাসনামলে ঢাকা সিটির প্রশাসক জেনারেল মাহমুদুল হাসান দয়াগঞ্জ বিশাল সুইপার পট্টিতে সুইপারদের জন্য চারতলা দালান করে দিয়েছে। এবং সুইপারদের ওই দালানে ঘর দিয়ে তার মালিকানা দিয়েছে। ওই সুইপার এলাকা মিরনজিল্লার চাইতেও অনেক গুণ বড় ও খুব গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দয়াগঞ্জের গেন্ডারিয়া মহাসড়কের পাশে। সেখানে ইচ্ছা করলেই রাস্তা সংলগ্ন এলাকায় বিশাল মার্কেট করে ভিতরে সুইপারদের আবাসনের ব্যবস্থা করা যেত। না, এরশাদ বা মাহমুদুল হাসান তা করেননি। তারা অল্প কয়েকটা ভবন করলেও পুরো এলাকা ওই সুইপারদের দখল অব্যাহত রাখেন।

উল্লেখ্য, বংশপরম্পরায় এখানে ওই সুইপারদের বসবাস। সেই সূত্রে ওই জায়গা ওদের। একইভাবে মিরনজিল্লায় বসবাসরত সুইপাররাও ওইখানে বংশপরম্পরায় বসবাস করছে। একশ, দুইশ নয়, চারশ বছর ধরে। মুঘল আমল থেকে। মুঘল আমলে ঢাকা শহর পত্তনের সময় শহরকে জঞ্জালমুক্ত করে পরিছন্ন রাখার জন্য ওই সুইপারদের আনা হয় তৎকালীন মুঘল সাম্রাজ্যের তামিলনাড়ু ও উত্তর প্রদেশ থেকে। এরা হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষ। এই মানুষগুলোকে মুঘল শাসকরা মিরনজিল্লায় বসবাস করার আদেশ জারি করেন। সেই আদেশ বলেই ওরা এই এলাকার মালিক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমান মেয়র ও স্থানীয় কাউন্সিল এদের জমির স্বপক্ষে কোনো দলিল না থাকায় এদের উচ্ছেদ করে মার্কেট নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো ওরা যাবে কোথায়? তার থেকে বড় প্রশ্ন এই জায়গা তো ওদের। সিটি কর্পোরেশনের নয়। তাহলে এই জায়গায় মার্কেট নির্মাণ করবে কোন অধিকার বলে? এই প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। উল্টো উচ্ছেদ অভিযানে বারবার বুলডোজার নামানো হচ্ছে।

এই উচ্ছেদ শুধু অমানবিকই নয়, এই উচ্ছেদ বর্তমান সরকারের গৃহীত নীতির বিরুদ্ধেও। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গৃহীত নীতি, সবার জন্য গৃহ। কেউ গৃহহীন থাকবে না। সেখানে নতুন করে সাড়ে ৪০০ পরিবারকে গৃহহীন করার পরিকল্পনা তাও আবার সিটি কর্পোরেশনের মতো দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান থেকে। এটা কি করে সম্ভব?

শুধু তাই নয় এদের রীতিমতো হাইকোর্ট দেখানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে যারা সচিব স্বাক্ষরিত নিয়োগপ্রাপ্ত তাদের বিষয়ে বিবেচনা করা হবে। তাদের বিকল্প ব্যবস্থা করা হবে। আর যারা আগের সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্তৃক নিয়োগকৃত তাদের বিষয়ে বিবেচনা করা হবে না।

উল্লেখ্য, মিরনজিল্লায় বসবাসরতদের অধিকাংশই ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের চাকরি করেন। তাই ওই বিভেদ প্রচেষ্টা। যা অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক। সেই সাথে যদি অন্যান্য সরকারি অফিসে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেলায় কেউ প্রশ্ন তোলে অতীতের সরকারের নিয়োগকৃত কোনো সুযোগ সুবিধা পাবে না। সুযোগ সুবিধা পাবে শুধু বর্তমান সরকারের নিয়োগকৃতরা। তাহলে পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়াবে?

তাই দেখে শুনে মনে হচ্ছে আর হরিজনদের বলতে হচ্ছে, আগের জমিদারই ভালো ছিল। অত্যাচার নির্যাতন যাই করুক ওই জমিদার তো পেটে লাথি মারেনি। চুলের মুঠি ধরে ঘর থেকেও বের করে দেয়নি।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে হবে ক্লিক করুন: রম্য রচনা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three × five =