আহমেদ রুবেলের প্রস্থান

মাধবী লতা

সিনেমাটা আর দেখা হলো না। বাকি কাজগুলো করা হলো না। নিজের নতুন সিনেমার প্রিমিয়ারে এসে শো শুরু হওয়ার আগেই খাঁচা ছাড়ল প্রাণপাখি। সবাইকে ছেড়ে না ফেরার দেশে উড়াল দিলেন আহমেদ রুবেল। দেশের নাটক সিনেমার এক নির্ভরযোগ্য অভিনেতা ছিলেন তিনি। নিজের অভিনয় দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন বহুবার। বৃক্ষমানব কিংবা প্রেতের রুমির কথা কখনো ভুলবেন না দর্শক। ফেলুদা, সত্যজিৎ রায়, এমনকি শেখ মুজিবুর রহমানের চরিত্রেও অভিনয় করে দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছেন। চলুন জেনে নিই এই গুণী মানুষটির সম্পর্কে।

রাজারামপুরের সেই ছেলেটি

আহমেদ রুবেল নামে পরিচিত হলেও তার পুরো নাম আহমেদ রাজিব রুবেল। ১৯৬৮ সালের ৩ মে চঁাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের রাজারামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার পিতার নাম আয়েশ উদ্দিন। তবে ছোটবেলা থেকে বেড়ে উঠেছেন ঢাকা শহরে। বসবাস করছিলেন গাজীপুরে। আহমেদ রুবেলের বাবা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আয়েশ উদ্দিন গাজীপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘসময় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছেন। রুবেলের বড়ভাই ডা. খালেদ শামসুল ইসলাম ডলার জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক ছিলেন। তিনিও প্রায় এক যুগ আগে মর্মান্তিক এক দুর্ঘটনায় মারা যান।

রুবেলের ছেলেবেলা

এক গণমাধ্যমে আহমেদ রুবেলের ছেলেবেলার বন্ধু কবি, সাংবাদিক ও নাট্যকর্মী সৈয়দ মোকছেদুল আলম বলেছেন ছেলেবেলার গল্প। তার ভাষ্যে, ‘আমরা গাজীপুরের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভাওয়াল রাজমাতা প্রতিষ্ঠিত রানী বিলাসমনি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ‘সেরা’ ফাঁকিবাজ শিক্ষার্থী ছিলাম। মেধাবি কিন্তু দুষ্টুমিতে সেরা ছিলাম আমরা। এই আড্ডাবাজ বন্ধুদের দলে রুবেলও একজন। পড়ালেখা ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখা খুব প্রিয় কাজ তখন আমাদের। রানী বিলাসমনি স্কুল ঘেঁষে রাজবাড়ী সড়কের অপরপাশেই নারায়ণদা’র দোকান। সেই দোকানের পুরি-শিঙাড়ার দুর্নিবার হাতছানি আমাদের আড্ডায় টানতো। টিফিন বিরতিতে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে রুবেল, আমরা কয়েকজন নতুন ছবি মুক্তি পেলেই সিনেমা হলে ছুটতাম। তখন আমরা স্কুলে নিয়ে আসা বইখাতা নারায়ণদা’র দোকানে লুকিয়ে রেখে সিনেমা হলে যেতাম। গ্রীষ্মকালে দিন অনেক বড়। বিকেল ৩টা থেকে ৬টা ম্যাটেনি শো দেখতাম। ছবি শেষে হল থেকে বের হয়ে দেখতাম সূর্য মধ্যগগণ থেকে কেবল পশ্চিমে ঢলে পড়ছে। মাঝে মাঝেই আমরা ধরা পড়ে যেতাম। বাংলা ও ইংরেজির চলমান ডিকশনারি আমাদের শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক নূরুল ইসলাম (ভাওয়ালরত্ন) স্যারের গোয়েন্দা নজরদারিতে থাকতাম আমরা। সিনেমা দেখে ফিরে এসে দোকানে বইখাতা নিতে গিয়ে দেখি, সব হাওয়া। চেয়ে দেখি, নারায়ণদা’র মুখ মেঘ অন্ধকার। কী ব্যাপার! কী হলো! আমাদের বইখাতা গেল কোথায়! জানা গেল, নূরু স্যার টিফিন পলাতক বাঁদর ছাত্রদের খোঁজে এসেছিলেন। দোকানে তল্লাশি চালিয়েছেন। বাঁদরগুলোর টিকিটির নাগাল না পেয়ে বইখাতাগুলো আটক করেছেন। আমরা না হয় স্যারের হাতে জোড়া বেতের কিছু ধোলাই হজম করলেই বেঁচে যাবো কিন্তু বাপু রুবেলের হবেটা কী! নূরু স্যার আর রুবেলের বাবার দহরমমহরম দোস্তালি। ‘সুপুত্র’ রুবেলের টিফিন পিরিয়ডে ফাঁকি আর বইখাতা দোকানে রেখে লাপাত্তা হওয়ার খবর বাবার কানে গেলে হবেটা কী! রুবেলের মুখে ভয়ঙ্কর ভয় ও দুশ্চিন্তার  ছাপ, যা আমাদের নিজের টেনশন ভুলিয়ে দিতো। রুবেলের বাবা আয়েশ স্যার কঠিন রাগি মানুষ। রুবেলের  কী দণ্ড দেবেন কে জানে! এরপর কয়েকদিন আর রুবেলের দেখা নেই। জানি না কী হলো! কয়েকদিন পর হঠাৎ আবার সব আগের মতো। আবার সেই আড্ডা, সেই ফাঁকিবাজি। রুবেলের মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই কী ঝড় বয়ে গেছে! সে ওই প্রসঙ্গের ধারেকাছেও যায় না। আমরা আগের মতোই পুরি, শিঙাড়ার টানে আড্ডা জমাই। স্কুল পড়া ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখি। এরকম নানা গল্পগাথা আহমেদ রুবেলের স্মৃতির সাথে জড়িয়ে আছে। এমন অনেক ঘটনা আছে, যা খুব স্মরণীয় কিন্তু এখানে বর্ণনীয় নয়। না না, আর যা হোক রুবেলকে কখনো প্রেমে পড়ার গল্প করতে শুনিনি। সম্ভবত ও বাবার ভয়ে স্কুলজীবনে প্রেম করার কথা ভাবতেও চায়নি। সেই রুবেল যখন আহমেদ রুবেল হয়ে গেল আর আমাদের হার্টথ্রব অভিনেত্রী তারানা হালিমের সঙ্গে ঘর বাঁধলো, অবাক না হয়ে পারিনি! এটা যে প্রেমঘটিত ভালো লাগালাগির ঘটনা, তা তো বোঝা যায়।’

যেভাবে অভিনয় জীবন শুরু

রুবেলের অভিনয় জীবন শুরু হয় ১৯৮৩ সালের দিকে। গাজীপুরের একঝাঁক তরুণ সমকাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রুবেলসহ ২৫-৩০ জন এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। প্রথমে প্রখ্যাত নাট্যকার মামুনুর রশীদের ‘এখানে নোঙর’ মঞ্চনাটকে অভিনয় করেছিলেন। এরপর বেশ কিছু পথনাটকে অভিনয় করেন। সেলিম আলদীনের ‘বাসন’, মান্নান হীরার ‘ফেরারী নিশান’ আব্দুর রাজ্জাকের ‘সবার উপর মানুষ সত্য’-সহ  স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ‘চোর’ নাটকে অভিনয় করেন। বিশেষ করে এস এম সোলায়মানের ‘এই দেশে এই বেশে’ নাটকটির কথা আসবেই। ক্ষমতাসীন এরশাদের সময়ে তার বিরুদ্ধে নানা বিষয় নিয়ে রচিত এই সাহসী মঞ্চনাটকটি খুবই জনপ্রিয়তা পায়। ঢাকায় প্রতিটা শো হাউজফুল হতো। গাজীপুরে মাত্র ১০ টাকার টিকিট শেষ হয়ে গেলে সেটাই দুইশ, পাঁচশ টাকায় কেনার প্রতিযোগিতা দেখা যেতো শো-এর দিন। আহমেদ রুবেল এ নাটকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন। ‘বাসন’ নাটকের  দ্বিতীয় শো-এর সময় চেয়ারম্যান চরিত্রে ছিলেন আহমেদ রুবেল। তবে ‘ঢাকা থিয়েটার’ থেকে আহমেদ রুবেলের অভিনয় যাত্রা নতুন মোড় নেয়ে।

টেলিভিশন পর্দায় আহমেদ রুবেল

আহমেদ রুবেলের প্রথম টেলিভিশন নাটক গিয়াস উদ্দিন সেলিমের ‘স্বপ্নযাত্রা’। এরপর তিনি নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ঈদনাটক ‘পোকা’য় অভিনয় করেন, যেখানে ‘ঘোড়া মজিদ’ চরিত্রটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এছাড়া হুমায়ূন আহমেদের ‘অতিথি’, ‘নীল তোয়ালে’, ‘বিশেষ ঘোষণা’, ‘সবাই গেছে বনে’, ‘বৃক্ষমানব’, ‘যমুনার জল দেখতে কালো’ নাটকে রুবেলের অভিনয় প্রশংসিত হয়। মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা ধারাবাহিক ‘প্রেত’ নাটকটি রুবেলকে দেয় অন্যরকম জনপ্রিয়তা। এক পর্বের এবং ধারাবাহিক নাটকের মধ্যে  ‘বারোটা বাজার আগে’, ‘প্রতিদান’, ‘নবাব গুন্ডা’,  ‘এফএনএফ’, ‘একান্নবর্তী’, ‘রঙের মানুষ, ‘পাথর, ‘অতল’, ‘চেয়ার’, ‘স্বর্ণকলস’, ‘আয়েশার ইতিকথা’, ‘দূরের বাড়ি কাছের মানুষ’, ‘ সৈয়দ বাড়ির বউ’সহ আরও অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন রুবেল।

বড় পর্দায় আহমেদ রুবেল

১৯৯৪ সালে বাণিজ্যিক ধারার ‘আখেরি হামলা’ সিনেমা দিয়ে চলচ্চিত্রে রুবেলের যাত্রা শুরু হয়। এরপর ‘আজকের ফায়সালা’, ‘মুক্তির সংগ্রাম’, ‘রঙিন রংবাজ’, ‘কে অপরাধী’, ‘সাবাস বাঙালি’, ‘মেঘলা আকাশ’, ‘পৌষ মাসের পিরিত’সহ ১৯টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। তবে চলচ্চিত্রে রুবেলকে জনপ্রিয়তা ও পুরস্কার এনে দিয়েছে হুমায়ূনের ‘চন্দ্রকথা’, ‘শ্যামল ছায়া’। এছাড়া ‘ব্যাচেলর’, মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা ‘গেরিলা’, ‘দ্য লাস্ট ঠাকুর’, ‘অলাতচক্র’, ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ ও রুবেলের মুক্তি পাওয়া সর্বশেষ সিনেমা ‘চিরঞ্জীব মুজিব’ তাকে একজন দারুণ অভিনেতা হিসেবে বারবার তুলে ধরেছে। কলকাতার সিনেমাতেও রুবেল কাজ করেছেন। ২০১৪ সালে ভারতের নির্মাতা সঞ্জয় নাগ পরিচালিত ‘পারাপার’ এ প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি।

আহমেদ রুবেলের প্রাপ্তির ঝুড়িতে যুক্ত হয়েছে নতুন অর্জন। ভারতের একটি চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ‘জয়পুর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ২০২৩’-এর ফিচার ফিল্ম বিভাগে তাকে সেরা অভিনেতা নির্বাচিত করা হয়। ‘প্রিয় সত্যজিৎ’ সিনেমায় অনবদ্য অভিনয়ের সুবাদে এই পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

ওটিটিতে রুবেল

হালের ওটিটিতেও রুবেল কাজ করেছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের কালজয়ী গোয়েন্দা চরিত্র ‘ফেলুদা’ হিসেবেও তাকে পাওয়া গেছে। ‘নয়ন রহস্য’ উপন্যাস অবলম্বনে তৌকির আহমেদ পরিচালিত ওয়েব সিনেমায় ‘ফেলুদা’ হয়েছিলেন রুবেল। এছাড়া ‘কাইজার’ সিরিজেও তাকে দেখা যায়।

যেভাবে মৃত্যু হলো আহমেদ রুবেলের

অভিনেতা আহমেদ রুবেল না ফেরার দেশে চলে গেছেন ২০২৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। তার বয়স হয়েছিল ৫৫ বছর। ওইদিন সন্ধ্যায় নুরুল আলম আতিক পরিচালিত ‘পেয়ারার সুবাস’ সিনেমার প্রিমিয়ার অনুষ্ঠানে এসে মাথা ঘুরে পড়ে যান তিনি। পরে তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। আহমেদ রুবেল ওই সিনেমায় অভিনয় করেছেন। রাজধানীর স্টার সিনেপ্লেক্সে সিনেমার প্রিমিয়ার শো ছিল। সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলেন রুবেল। সিনেমাটির প্রধান সহকারী পরিচালক শ্যামল শিশির বলেন, আতিক ভাই আর রুবেল ভাই একসঙ্গেই আসছিলেন। বসুন্ধরা সিটির বেজমেন্টে গাড়ি রেখে প্রিমিয়ার অনুষ্ঠানে আসছিলেন। গাড়ি থেকে নামার পর রুবেল ভাই হুট করেই ফ্লোরে পড়ে যান। এরপর তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

আহমেদ রুবেলের মৃত্যুতে তারকাদের শোক

অভিনেতা আহমেদ রুবেলের মৃত্যুতে মিডিয়া পাড়ায় নামে শোকের ছায়া। শোক জানিয়েছেন এই অভিনেতার সহকর্মী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা।

মা ও বড় ভাইয়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রা

গাজীপুরে মা ও বড় ভাইয়ের কবরের পাশে দাফন করা হয় অভিনেতা আহমেদ রুবেলকে। ৮ ফেব্রুয়ারি বিকেলে গাজীপুরের ভাওয়াল রাজবাড়ি মাঠে জানাজা শেষে তাকে সিটি কর্পোরেশনের কবরস্থানে দাফন করা হয়। স্বজনেরা জানান, আহমেদ রুবেলকে যে কবরে দাফন করা হয়, একই কবরে তার মা ও বড় ভাইকে দাফন করা হয়েছিল।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্মৃতিচারণ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

five × two =