একাত্তরের সংবাদপত্র

জাফর ওয়াজেদ : ফিরে যদি তাকাই পেছনে, পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ পানে, তবে দেখতে পাই-মৃত্যু, নৃশংসতা, নির্বিচারে গণহত্যা, নারীর সম্ভ্রমহানি, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, ঘরবাড়ি ছেড়ে স্বজন হারিয়ে কোটি মানুষের দেশত্যাগ, শরণার্থী শিবিরে আশ্রয়। দেখতে পাই, বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের উজ্জ্বলতম অর্জন-পর্ব ‘মুক্তিযুদ্ধ’। রণাঙ্গন থেকে রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে যুদ্ধরত ছাত্র, যুবা, কৃষক, শ্রমিক, মাঝিমাল্লা, সেনা, পুলিশ, ইপিআর, আনসারসহ নানা পেশার মানুষকে। সাহসে, অঙ্গীকারে, বীরত্বে, আত্মদানে, জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য বানিয়ে সম্মুখসমরে শত্রুহননে মত্ত হওয়ার এমন দিন বাঙালির ইতিহাসে আর কখনোই আসেনি। এটা অনস্বীকার্য যে, বাঙালি জাতির ধারাবাহিক স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার সম্মিলিত ফসল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এ যুদ্ধ ছিল বাঙালির জাতিসত্তা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও আত্মানুসন্ধানের লড়াই। বাঙালির অহংকার, গৌরব আর আত্মপরিচয় তুলে ধরার ভিত্তি বলা যায় মুক্তিযুদ্ধ। শিশুঘাতী, নারীঘাতী, বর্বরতম প্রতিরোধে এমন সম্মিলিত সংগ্রামের ইতিহাস, নিজের বুকের রক্তে এমন করে আগে কখনো লেখেনি জাতি বাঙালি।
পঞ্চাশ বছর আগে আরও দেখতে পাই, অহিংস গণ-অসহযোগ আন্দোলন থেকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ; সংসদীয় গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের দাবি থেকে স্বাধীনতার রক্ত পতাকাত্তোলন। বিশ শতকের বিশ্ব রাজনীতিতে এমন ঘটনা অকল্পনীয় এবং অভাবনীয় যেমন, তেমনই অভূতপূর্বও। এই অভাবনীয় ঘটনা ঘটেছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। ‘মুক্তিযুদ্ধ’-এই প্রপঞ্চটির মধ্যে এই ভূখণ্ডের মানুষের অনেক বোধ, সংগ্রাম, অর্জন, মৃত্যু, হাহাকার, অশ্রু, আর্তি এবং স্বপ্ন ভিড় করে আছে। মুক্তিযুদ্ধ মূলত একটি প্রত্যয়। ছিল যা বাঙালির জাতীয় জীবনের মোহনাকাল, বাঙালির মানুষ হয়ে ওঠার কাল। মুক্তিযুদ্ধের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যে দেখা গেছে, বাঙালির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার, ভ্রাতৃত্ববোধের এবং সহমর্মী, সহকর্মী, সমব্যথী, সমচেতনার, সদাজাগ্রত থাকার সময়কাল ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির ইতিহাসের শুধু অসাধারণ ঘটনাই নয়, স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসের অসাধারণ ঘটনা। এই যুদ্ধে বাঙালি জনগণের অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক। সাধারণ বাঙালি সশস্ত্রভাবে পাকিস্তানি হানাদার ও দখলদার বাহিনীকে প্রতিরোধে মত্ত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জনগণের যুদ্ধ তথা জনযুদ্ধ। স্বল্পসংখ্যক বিশ্বাসঘাতক ছাড়া সেসময়ের সাড়ে সাত কোটি বাঙালিই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতার পক্ষে। সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্য, ইপিআর, পুলিশ, আনসার বাহিনীর বিদ্রোহী সদস্য থেকে শুরু করে লাখ লাখ ছাত্র-তরুণ-যুবক-নারী-কৃষক ও সাংস্কৃতিক কর্মী-বুদ্ধিজীবী, চিকিৎসক, নার্স, প্রকৌশলী, সরকারি চাকরিজীবী, কলকারখানার শ্রমিক, ঘাটের মাঝি, মাঠের কৃষকসহ নাম না-জানা বাঙালি সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। দেশের অভ্যন্তরে দখলদার হানাদার বাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে অনেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন। অনেকে ধরা পড়েন, যারা আর ফিরে আসেননি। জল্লাদরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। অনেকের লাশ পাওয়া যায়নি। ছিল গণকবর আর বধ্যভূমিতে আকীর্ণ বাংলাদেশ।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল পাকিস্তান। সব যুদ্ধেরই পক্ষ ও প্রতিপক্ষ থাকে। এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরোধিতা করাটাই স্বাভাবিক। আর এই বিরোধিতা যে কেবল ভূমিতে, আকাশে, জলপথে মারণাস্ত্র নিয়ে লড়াই, তা-ই শুধু নয়। বিরোধিতার চূড়ান্ত পরিণামে যে সংঘর্ষ তাতে যেমন সামরিক কৌশল ব্যবহার করা হয়, একই সঙ্গে রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং যোগাযোগীয় কৌশলও ব্যবহৃত হয়। পুরাকাল থেকেই যোগাযোগ তথা গণমাধ্যম তাই যুদ্ধের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। অনস্বীকার্য যে, মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র্রজন্মের চূড়ান্ত ঘটনা। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর আলবদর, আলশামস, রাজাকার ও দালালরা পরাজিত হয়। হানাদাররা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। মাত্র নয় মাসের এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগী দালাল ও চরেরা ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করে। ধর্ষিত হয় তিন লাখ নারী। গণমাধ্যম এসব খবর পরিবেশন করেছে যুদ্ধকালে এবং যুদ্ধোত্তর সময়ে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যুদ্ধ ও সংবাদমাধ্যমের সম্পর্ক সব সময়ই সাংঘর্ষিক। যে কোনো যুদ্ধে, প্রাচীন হোক অথবা বর্তমানকালের হোক, যোগাযোগমাধ্যম ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে স্বার্থ ভিন্নতার বিষয়টি বড়ো বাস্তবতা। সংবাদমাধ্যমের মূল কাজ সত্য প্রকাশ করা। ঘটনার অনুপুঙ্খ তথ্য পাঠযোগ্যভাবে সংবাদ ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেয়। যুদ্ধে প্রধানত দুটি পক্ষ থাকে। সংবাদমাধ্যমের আদর্শিক অঙ্গীকারের জন্য দুটি পক্ষ সম্পর্কে, যুদ্ধ যুদ্ধ ঘটনার দৈনন্দিন ফলাফল সম্পর্কে জনসাধারণকে যতদূর সম্ভব পর্যাপ্ত তথ্য দেওয়ার দায়িত্ব সংবাদমাধ্যমের পেশাগত দায়বদ্ধতার অংশ। এমনকি জাতিগত, রাষ্ট্রগত কিংবা রাজনৈতিক ভাবাদর্শগত কারণে যে পক্ষকে একটি সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠান সমর্থন করে, সেক্ষেত্রেও একথা সমানভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু যুদ্ধকালে এ ব্যাপারটি ঘটে না। বরং সংবাদমাধ্যম হয়ে ওঠে যুদ্ধভূমি। শুধু তা-ই নয়, কৌশলগত প্রয়োজনেই যুদ্ধমান সামরিক বাহিনী কিংবা সরকার সংবাদমাধ্যমকে সব তথ্য দেয় না। তথ্য সংগ্রহ এবং প্রেরণে বাধা দেয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সমরনায়ক আইসেন হাওয়ার গণমাধ্যম ও সামরিক বাহিনীর ভূমিকার এমন বৈপরীত্যের কথা খুব স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, সামরিক অভিযানের প্রথম কথা হলো গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য শত্রুকে দেওয়া যাবে না। সংবাদপত্র এবং সব প্রচারমাধ্যমের অপরিহার্য কাজ ব্যাপক বিস্তৃত প্রচার।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, জন্মকাল থেকেই সংবাদমাধ্যম যুদ্ধ-ঘটনার রিপোর্টিং করে আসছে। গত দুই-তিন শতকে যুদ্ধ রিপোর্টিংয়ের গতি এবং বোধগম্যতার ক্ষেত্রে নানা রকমের পরিবর্তন এসেছে। ‘ওয়াটার লু’-এর যুদ্ধের সময় যুদ্ধক্ষেত্রের খবর সাংবাদিককে সশরীরে সংবাদপত্র অফিসে বয়ে আনতে হতো। ক্রিমিয়া এবং গোটসবার্গ যুদ্ধের সময় টেলিগ্রাফের আবিষ্কার ঘটে গেছে। আর সংবাদপত্র অফিসে যুদ্ধ-সংবাদ পাঠানোর ক্ষেত্রে এগুলো ব্যবহৃত হয়েছে। এ সময় খবরের সহায়ক হিসাবে যুদ্ধের ছবি ব্যবহার শুরু হয়।
আরও অনেক পেছনে তাকাই যদি, দেখতে পাই-উনিশ শতকের শেষার্ধে ১৮৯০ সালে আমেরিকায় হলুদ সাংবাদিকতার জের হিসাবে স্প্যানিশ শাসনের অবসান ঘটানোর জন্য কিউবা আক্রমণ করে বসে।
সংবাদপত্রই ধ্বংস-মৃত্যুর বিপরীতে যুদ্ধের একটা গৌরবোজ্জ্বল চেহারা দাঁড় করানোর চেষ্টা করে এবং যুদ্ধ যে বেশ একটা রোমান্টিক ব্যাপার, তা-ও ফুটিয়ে তোলা হয়। যুদ্ধ যে একটা পূণ্যের কাজ, গৌরবের কাজ, নশ্বর পৃথিবীতে অপরিমেয় বীরত্ব বিবরণ তৈরি করার সুযোগ-পৃথিবীর প্রায় সব মহাকাব্যেই একথা বলা হয়েছে। প্রধানত যুদ্ধস্পৃহা জাগিয়ে তোলার জন্য, যুদ্ধপতিদের সুখ দিয়ে কিংবা সম্মুখসমরে স্পর্ধা বাক্য বিনিময়কালে যুদ্ধের এমন মাহাত্ম্য বর্ণনা রামায়ন, মহাভারত, ইলিয়ড ও ওডেসিতে চোখে পড়ে। কিন্তু সংবাদপত্র অথবা গণমাধ্যমের যুদ্ধ উসকানির পেছনে এসবের সঙ্গে আরও যে একটি ভয়ংকর বিষয় কাজ করে, তা হলো মুনাফা লিপ্সা। এবং এই কাজটি দখলদার বাহিনী বা তার প্রতিপক্ষ বাহিনীর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়।
ফিরে যদি দেখি, দেখব, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ও ঘটনাস্থল থেকে সংবাদ সংগ্রহ করে সাংবাদিকদের টেলিগ্রাফের মাধ্যমে সংবাদ অফিসে পৌঁছাতে হতো। অবশ্য এ সময়কালে ‘কেবল’ সংযোগ আরও বিস্তৃত হয়েছে। খবরের পাশাপাশি এ সময় যুদ্ধক্ষেত্রের ঘটনা ক্যামেরায় ধারণ করে ‘নিউজরিল’ আকারে থিয়েটারে বা প্রেক্ষাগৃহে দেখানো হতো। দেখা গেছে, এই সময়কালেই অধিক মুনাফার আশায় যুদ্ধের ঘটনাকেন্দ্রিক বিশ্লেষণধর্মী এবং প্রোপাগান্ডামূলক চলচ্চিত্র তৈরি হয়।
যুদ্ধ ‘কাভার’ করার ক্ষেত্রে ‘রিয়েল টাইম লাইভ রিপোর্টিং’ বলতে যা বোঝায়, তার শুরু কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বেতারের মাধ্যমে। আর টেলিভিশনের মাধ্যমে বিশ্ব তথা যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি প্রত্যক্ষ করেছে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়। এভাবেই যুদ্ধে বাস্তবতা, দৃশ্য-শব্দ, মৃত্যু, ধ্বংস, আহাজারি মানুষের বসার ঘরে ঢুকে পড়ে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খণ্ড খণ্ড চিত্র ও বিদেশি টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের কল্যাণে বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছেন।
পূর্ব বাংলায় ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকাল পর্যন্ত এদেশে মোট তেইশটি (২৩) দৈনিক পত্রিকার আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। ছিল বেতার এবং পরবর্তীকালে টেলিভিশনও। পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনের প্রায় চব্বিশ (২৪) বছর, অল্পকিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে সংবাদমাধ্যম বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে সফল পরিণতিতে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছিল। কিন্তু পঁচিশে মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর আওতায় গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরুর পর এসব পত্রিকা হানাদার বাহিনী সম্পূর্ণ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। কয়েকটি পত্রিকা অফিস জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। শুধু সংবাদপত্রই নয়, বেতার-টিভিসহ পুরো যোগাযোগব্যবস্থারই নিয়ন্ত্রণ নেয় দখলদার পাকবাহিনী। দেশের বাস্তব অবস্থা দেশি-বিদেশি জনগণ যাতে জানতে না পারে, সেজন্য সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করেছিল। আরোপিত হয়েছিল সেন্সরশিপ। তাদের নৃশংস তৎপরতাকে ধামাচাপা দিতে যতই কলাকৌশলের আশ্রয় নিক না কেন তাতে কামিয়াব হয়নি। দেশে যে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, বাঙালি যে স্বাধীনতার জন্য লড়ছে, সেসব প্রকাশের নিষেধাজ্ঞা ছিল শক্তাশক্তি। মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কৃতকারী, ভারতের চর, ইসলামের শত্রু, পাকিস্তানের দুশমন অভিধা দেওয়া হতো সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমে। দখলদার পাকিস্তানিরা সারাদেশে গণহত্যা চালিয়ে বাঙালি নিধনে মত্ত থাকলেও সেসব খবরাখবর তাদের নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্র, বেতার-টিভিতে প্রচার হতো না। অবরুদ্ধ দেশে বাঙালি এসব খবরাখবর মোটেই বিশ্বাস করেনি। বরং স্বাধীনতাকামী বাঙালিই বাঙালির কাছে খবর পৌঁছে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিশেষ করে বেতার এ সময় হয়ে ওঠে মুক্তিকামী বাঙালির তথ্য চাহিদাপূরণের নির্ভরযোগ্য উপায়। ভারতসহ বিদেশি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরাখবরও বেতার থেকে উদ্বৃত করা হতো। সেসব সংবাদপত্র এদেশে না এলেও বিদেশি বেতারের কল্যাণে তা জানা হয়ে যেত। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম রণাঙ্গন তখন হয়ে উঠেছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। পঁচিশে মার্চ গণহত্যা শুরুর পরদিনই ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের পর সারাদেশের মানুষ জনযুদ্ধে নেমেছিল। সেসময় সংবাদপত্র প্রকাশিত হতে পারেনি বেশ কিছুকাল। যুদ্ধকালে দেশের মুক্তাঞ্চল থেকে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা সেসময় পালন করেছিল ঐতিহাসিক দায়িত্ব। এসব মাধ্যমে কর্মরত শব্দসৈনিকেরা মুক্তিকামী বাঙালির স্বাধীনতাবোধ ও চেতনাকে সংহত ও শাণিত করে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও দেশকে হানাদারমুক্ত করার সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছিল। দখলদার বাহিনীর প্রোপাগান্ডা ও মিথ্যাচার প্রচারযন্ত্রের বিপরীতে স্বাধীন বাংলা বেতার, আকাশবাণী, বিবিসি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গণহত্যা, জনগণের ঘোরতর দুর্দশা, মুক্তির জন্য লড়াই, আর প্রতিরোধের খবর বা তথ্য সম্পর্কে কোনো পত্রিকা বা জার্নাল কিংবা সাময়িকী বাংলাদেশের দখল করা অঞ্চলের মধ্যে রাখাটা ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। প্রায় অসম্ভবই ছিল বলা যায়। তথাপি কেউ কেউ গোপনে সাইক্লোস্টাইলে বুলেটিন বের করেছে, তা নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে থাকা বিশ্বস্ত স্বজনদের কাছে বিতরণ করেছে। তবে কেউ তা সংগ্রহ করে রাখত না। হানাদারের দৃষ্টি এড়াতে ছিঁড়ে বা পুড়িয়ে ফেলেছে।
মুক্তাঞ্চল থেকে বাংলাদেশ সরকার ছাড়াও আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, সিপিবি সাপ্তাহিক মুখপত্র বের করত নিয়মিত। বাংলার বাণীও সেসময় প্রকাশ হতে থাকে। কলকাতার বাংলা ইংরেজি পত্রিকাতেও মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর থাকত। সেসব পত্রপত্রিকা যাতে দেশের ভেতরে না আসতে পারে, সেজন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল দলখদার হানাদার বাহিনী। যে কোনো আকারে এসব খবর প্রচারও ছিল নিষিদ্ধ। খবরের ছিটেফোঁটাও বিদেশে প্রচার করার বিষয়ে বিদেশি কূটনৈতিক মিশনগুলোর ওপর রাখা হয়েছিল কড়া নজর। সংবাদমাধ্যমগুলোর ওপরে ছিল কঠোর কড়াকড়ি ও নজরদারি। বেতার শুনতে হতো গোপনে লুকিয়ে, নিম্ন ভলিউমে। এত কড়াকড়ির মধ্যেও লুকিয়ে পত্রপত্রিকা পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করত।
মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ১ মার্চ ১৯৭১ ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা ১১০নং সামরিক বিধি জারি করে। এই সামরিক বিধিতে বলা হয়েছিল, ‘পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো ছবি, খবর, অভিমত, বিবৃতি, মন্তব্য প্রভৃতি মুদ্রণ বা প্রকাশ থেকে সংবাদপত্রসমূহকে বারণ করা হচ্ছে। এই আদেশ লঙ্ঘন করা হলে সর্বোচ্চ শাস্তি দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।’ উল্লেখ করার বিষয় এখানে যে, এসব বিধিনিষেধ, কালাকানুনÑসবই এক পর্যায়ে এসে এদেশের সাংবাদিকরা ভঙ্গ করেছেন। এর আগে ১৯৫৮ সালের সামরিক অধ্যাদেশে সংবাদপত্রের ওপর প্রি-সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ‘এই আইন অমান্য করলে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। এবং সেজন্য সাত বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হবে।’ আরেক ধারায় বলা হয়, ‘কোনো লিখনীর সাহায্যে কোনোরূপ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করা হলে তা সামরিক আইনে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এবং এ ধরনের অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ চৌদ্দ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হবে।’ এরপরও বিভিন্ন সময় অধ্যাদেশ জারি করে সংবাদপত্রের ওপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছিল। পূর্ব বাংলার সাংবাদিকরা এসব আইনের বিরুদ্ধে নানা সময়ে প্রতিবাদীও হয়েছিল। পূর্ব বাংলার সাংবাদিকতার ইতিহাস, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য এক নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের ইতিহাস। জাতীয় চেতনাকে শাণিত করার এই অস্ত্রটিকে দখলে আনার জন্য পাকিস্তানি জান্তা শাসকদের চেষ্টার অবধি ছিল না।
সংবাদপত্র কেবল মানুষকে তথ্য দেয় না, জনগণকে শিক্ষিত করে, জনচৈতন্য এবং জনমতকে প্রভাবিত করে। এ কারণেই পূর্ববঙ্গে স্বাধীন সংবাদপত্র যাতে বিকশিত না হয়, সেজন্য সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছিল পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠী শুরু থেকেই। পাকিস্তানি উপনিবেশ আমলে চব্বিশ বছরে এদেশে সাংবাদিকতা বিকাশের স্পষ্ট বৈশিষ্ট্যের কারণে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের কাল পর্যন্ত প্রথম পর্ব। সামরিক শাসনের কাল ১৯৫৮ থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দ্বিতীয় পর্ব এবং ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত তৃতীয় পর্ব। প্রত্যেক পর্বেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং দেশের স্বাধিকারের জন্য সাংবাদিকদের সাহসী ভূমিকার ইতিহাস যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে পাকিস্তানি শাসকদের সাথে আপস, আনুগত্য, তাবেদারি ও আঁতাতের কলঙ্ক। পূর্ব বাংলার গণ-আন্দোলনের প্রচণ্ড বিস্ফোরণোম্মুখ পরিবেশ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সংগ্রাম প্রত্যেকবার নতুন স্তরে প্রবেশ করেছে। জনমত সৃষ্টি, জনমতের বিশ্বস্ত বাহন হিসেবে সংবাদপত্রকে জনতার সামনে উপস্থাপিত করার কাজে সাংবাদিকরা কঠোর সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছেন। তাই পর্যালোচনায় দেখা যায়, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিকরা বারংবার কারাবরণ করেছেন, এমনকি স্বৈরাচারী শাসকদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। পূর্ববঙ্গে সংবাদপত্র শিল্পের বিকাশের পেছনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাব প্রত্যক্ষ ছিল। তবে দু-একটি পত্রিকা সামরিক সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল স্বার্থের মুখপত্র হিসেবে কাজ করেছে। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ঘোষণার পর তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারী ছিল না ইত্তেফাক ছাড়া প্রধান ধারার অন্য কোনো পত্রিকা। তবে সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে সব পত্রিকা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মসূচিকে বিপুল সমর্থন জুগিয়ে গেছে। শেখ মুজিবের স্বদেশ ও তার মানুষের মুক্তির সংগ্রামের সমান্তরালে এগিয়েছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার আন্দোলন। ‘আমাদের বাঁচার দাবি ছয় দফা’ কর্মসূচি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে, সত্তরের নির্বাচনে মুজিবের দলকে নিরঙ্কুশ বিজয় এনে দেওয়ার ক্ষেত্রে ও সর্বোপরি তাঁকে এদেশের মুক্তিকামী জনগণের নামে অবিসংবাদিত জননেতা হিসেবে গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে সংবাদপত্র অমূল্য ও নিঃস্বার্থ ভূমিকা পালন করেছে। দেখা গেছে যে, পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে যখনই গণ-আন্দোলন তীব্র রূপ নিয়েছে, সংবাদপত্র ও সাংবাদিকরা তাদের ওপর আরোপিত সব নিয়ন্ত্রণ, হুমকি, জেলের ভয় অতিক্রম করে ছাত্র, জনতা এবং রাজনীতিবিদদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
এটা স্বীকার করতেই হবে যে, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক-মুহূর্ত পর্যন্ত এদেশে সাহসী সাংবাদিকতার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল, সাংবাদিকরা সংগ্রামী যে ঐতিহ্য নির্মাণ করেছিলেন, পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর প্রথম আঘাতেই তা ভেঙে যায়। হানাদারদের লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে ছিল সংবাদপত্র অফিস এবং সংশ্লিষ্ট সংবাদকর্মী ও সাংবাদিক। হানাদারদের গোলার আঘাতে একের পর এক আক্রান্ত হয় স্বাধীনতার সপক্ষের পত্রিকা অফিস ও কর্মরত সাংবাদিকরা।
২৫ মার্চ রাতেই কামানের গোলায় ধ্বংস করা হয় ‘দ্য পিপল’ ও ‘গণবাংলা’ পত্রিকার অফিস। গোলার আঘাতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন দ্য পিপল অফিসে কর্মরত ছয়জন সাংবাদিক। ২৬ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাকের অফিসটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ২৮ মার্চ দৈনিক সংবাদের অফিস পেট্টোল ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। অফিসে কর্মরত সাংবাদিক শহিদ সাবের অগ্নিদগ্ধ হয়ে মর্মান্তিকভাবে মারা যান। ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে শুরু হয় সশস্ত্র প্রতিরোধ এবং মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস-২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সংবাদপত্র ছিল সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ। বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে সেই যাত্রা খুবই করুণ, মর্মান্তিক।
এটা স্পষ্টতই প্রতীয়মান যে, যে কোনো যুদ্ধে প্রথম মৃত্যু ঘটে সত্যের। সংবাদপত্র অফিসে আক্রমণ এবং সাংবাদিকদের হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসের পরবর্তী নয় মাসের জন্য সংবাদপত্র অফিস ‘সত্যের কসাইখানা’ হওয়ার পথ খুলে দিয়েছিল।
২৬ মার্চ পাকিস্তানি জান্তা শাসক নরঘাতক ইয়াহিয়া সামরিক বিধি ঘোষণা করে বিবিধ নিষেধাজ্ঞা জারি করে। নির্দেশ দেওয়া হয়, সরকার নিযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে আগে পেশ না করে এবং কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র না নিয়ে কোনো রাজনৈতিক বিষয় সংবাদপত্রে মুদ্রণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। এই আদেশ লঙ্ঘনের সর্বোচ্চ শাস্তি নির্ধারিত হয় সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। সামরিক শাসন প্রয়োগ এবং তা অব্যাহত রাখার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বা সংহতির বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমালোচনার চেষ্টা নিষিদ্ধ করা হয়। মোদ্দাকথা হচ্ছে, সংবাদপত্রের সার্বিক কণ্ঠরোধ করা হয়। শুধু এই বিধি নয়, এরপর নাজেল হতে থাকে একের পর এক সামরিক আইনের আদেশ। প্রত্যেকটি বিধি ও আদেশ ছিল এদেশের জনগণ, সংবাদপত্র, বেতার ও টিভির বিবেকী কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেওয়ার এক নখরযুক্ত থাবা।
দখলদার বাহিনীর কাছে সংবাদপত্র দুটি কারণে ছিল অপরিহার্য। দেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে, এই তথ্য দেশে-বিদেশে প্রচার এবং যুদ্ধ প্রচারণার মাধ্যম হিসেবে সংবাদপত্রকে প্রাত্যহিক অনুষঙ্গ করে তোলা। দেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে, এটি প্রমাণ করার জন্য সামরিক জান্তা অপারেশন সার্চ লাইটের দিন তিনেকের মধ্যেই পত্রিকা মালিকদের নির্দেশ দেয়, সব পত্রিকা আবার প্রকাশ করতে হবে। ২৯ ও ৩০ মার্চ থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করে মর্নিং নিউজ, পূর্বদেশ, অবজারভার, দৈনিক পাকিস্তান। ইত্তেফাক প্রকাশিত হয় ২১ মে হতে। সংবাদপত্রের মালিকরা বন্দুকের নলের মুখে নয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজেরাই দখলদার হানাদারদের গুণকীর্তনে এগিয়ে আসে। অনেক দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা নিষিদ্ধ করা হয়। হানাদাররা ‘সেন্সরশিপ হাউজ’ চালু করে। সব খবর, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, নিবন্ধ ছাপানোর আগে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হতো এই সেন্সরশিপ হাউজে।
দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশন্স বিভাগ তথা আইএসপিআর নিয়ন্ত্রণ আরোপে সক্রিয় ছিল। সরাসরি এর দায়িত্বে ছিল মেজর সিদ্দিক সালিক। একাত্তরের ভয়ংকর সেই দিনগুলোতে মেজর সালিক ছিলেন সংবাদপত্র অফিসের ত্রাস। কোনো স্টাফ রিপোর্টারের প্রতিবেদন ছাপানো হয়নি কোনো পত্রিকায় মাসখানেকের বেশি। অ্যাসোসিয়েট প্রেস অব পাকিস্তান বা এপিপির দেওয়া প্রতিবেদনই ছাপা হতো। সাংবাদিকরা দখলদার বাহিনীর বন্দুকের নলের মুখে সত্য যা কিছু লেখার ছিল, তা লিখতে পারেননি। তারপরও এর মধ্য দিয়েও সাংবাদিকরা সংযমের আড়ালে সত্য প্রকাশে ছিলেন সচেষ্ট। যে কারণে সিরাজুদ্দিন হোসেন, নাজমুল হক, শহীদুল্লা কায়সার, খন্দকার আবু তালেব, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, শেখ আবদুল মান্নান লাডু, শিবসাধন চক্রবর্তী, শহীদ সাবের, সেলিনা পারভীনসহ আরো সাংবাদিককে প্রাণ দিতে হয়েছে হানাদার বাহিনীর হাতে।
পঁচিশে মার্চের পর অবরুদ্ধ দেশের সংবাদপত্রকে চরিত্র বিচারে সংবাদপত্র বলা অবশ্যই যাবে না। সেগুলো ছিল দখলদার হানাদার বাহিনীর মুখপত্র। অধিকাংশ পত্রিকায় পাকবাহিনী এবং রাজাকার, আলবদরদের তৎপরতা, যুদ্ধে তাদের সাহস, জামায়াতে ইসলামীর নেতা ও সামরিক কর্তাদের বিভিন্ন অঞ্চলে সফর, শান্তিবাহিনীর কাজ ফলাও করে প্রকাশ করা হতো। পক্ষান্তরে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ভারতীয় চর, দুষ্কৃতকারী, ইসলামের শত্রু হিসেবে উল্লেখ করা হতো। বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ, মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতের বিরুদ্ধে কুৎসা ও মিথ্যে প্রচারে ব্যাপক জায়গা ব্যয় করেছে সংবাদপত্রে। অপরদিকে দেশে নির্বিচারে খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তকরণ, মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ সাফল্য সম্পর্কে নীরব থেকেছে। সেই সময় সাংবাদিকদের মধ্যে অনেকে আত্মগোপন করেছিলেন, নয়তো মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। অনেকে আবার কর্মরত থেকে দখলদারদের অন্যায় প্রতিরোধ করতে না পারলেও প্রতিবাদ করে জেল, জুলুম সয়েছেন। তৎকালীন পিপিআই-এর চিফ রিপোর্টার সৈয়দ নাজমুল হককে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে দুবার রাওয়ালপিন্ডিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য। মিথ্যা বলতে রাজি হননি বলে পরিণামে ১০ ডিসেম্বর রাতে একজন কর্নেলের নেতৃত্বে হানাদাররা বাসা ঘেরাও করে তাকে ধরে নিয়ে যায়। তিনি আর ফিরে আসেননি। যুদ্ধের শেষদিকে কয়েকজন সাংবাদিক আলবদর ও রাজাকারদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। অনেকের লাশ পাওয়া যায়নি। অবশ্য সাংবাদিকরা যুদ্ধ করেছিলেন ভেতরে-বাইরে। আবার বুদ্ধিজীবি হত্যায়ও জড়িত ছিলেন সাংবাদিকই।
যারা দেশ ছাড়তে পেরেছিলেন, তারা মুক্তাঞ্চল থেকে স্বাধীনভাবে সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিলেন। আবার যুদ্ধক্ষেত্রে জন্ম নিয়েছিল বেশকিছু সংবাদপত্র। একাত্তরে দু’ধরনের সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। দখলদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে দেশের ভেতর থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রে থাকত যুদ্ধ সম্পর্কে অসত্য তথ্য। উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে বিভ্রান্ত করা। অপরদিকে মুজিবনগর থেকে মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রের উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধের সাফল্যের সংবাদ পরিবেশন করে মুক্তিকামী বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করা। একই সঙ্গে উদ্দীপনা সৃষ্টি করা। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হাতেগোনা কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা ছাড়া বাকি সব পত্রিকাই ছিল সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, সাময়িকী, বুলেটিন অথবা নিউজ লেটারধর্মী। পত্রিকাগুলো সাইক্লোস্টাইল করে, হাতে লিখে কিংবা প্রেস থেকে মুদ্রিত হয়ে আত্মপ্রকাশ হয়েছে। পত্রপত্রিকাগুলোর স্থান হিসেবে ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, নওগাঁ, বরিশাল, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, তেঁতুলিয়া, মুক্তাঞ্চল ও মুজিবনগরের নাম থাকলেও এর অধিকাংশ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য যেমন: পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়, থেকে প্রকাশিত হতো। এসব পত্রিকা প্রকাশনায় বিপুলসংখ্যক শরণার্থী ও স্থানীয় বাঙালি জনগণের সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা ও সহমর্মিতা ছিল। যুদ্ধকালে জন্ম নেওয়া এসব পত্রিকার নাম এবং সংবাদ শিরোনামে স্বদেশপ্রেম এবং যুদ্ধজয়ের স্বপ্ন জড়িয়ে ছিল। মুক্তাঞ্চলে এবং অবরুদ্ধ দেশে এসব পত্রিকা বাঙালিকে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রেরণা জুগিয়েছে। পরিস্থিতি, সময়ের দাবি, স্থানীয় চাহিদা ও যুদ্ধজয়ের লক্ষ্যকে সামনে রেখে এসব পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। এসব পত্রপত্রিকার বিষয়বস্তু যুদ্ধ, প্রতিরোধ, হানাদার বাহিনী আর রাজাকারদের লাঞ্ছনা, পরাজয়, যুদ্ধাক্রান্ত মানুষের কষ্ট, স্বপ্ন ইত্যাদি। সেসময়ের পত্রিকাগুলোয় প্রতিবেদন ফিচার, নিবন্ধ, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় ইত্যাদি বিষয়ের ব্যানারেই মূলত সংবাদগুলো প্রকাশিত হতো। কখনো কখনো কিছু ছবি, কবিতা-গল্প, সাক্ষাৎকার, যুদ্ধজয়, নেতাদের বিবৃতি, বক্তব্য ছাপা হয়েছে। আবার দুই-একটি পত্রিকায় বেশকিছু বিদ্রুপাত্মক কার্টুনও প্রকাশ হয়েছিল। পত্রিকার পাতায় পাতায় থাকত মুজিবনগর সরকার গঠন; সরকারের মাধ্যমে যুদ্ধ পরিকল্পনা-পরিচালনা, কূটনৈতিক তৎপরতা, বিভিন্ন রাষ্ট্রের সমর্থন-স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা, বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং তাঁকে ঘিরে স্বাধীনতাযুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়গুলো। যুদ্ধকালীন পত্রিকা বলেই এর সবটুকু জুড়ে থাকত যুদ্ধের খবরাখবর এবং মুক্তিবাহিনীর বীরত্বব্যঞ্জক তৎপরতা। হানাদার বাহিনীর পর্যদুস্ত হবার বর্ণনা প্রাধান্য পেত।
‘পত্রিকাগুলোর আদর্শ ও উদ্দেশ্য ছিল অভিন্ন পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতিকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করা। এসব পত্রিকার প্রচারসংখ্যা বেশি না থাকায় সেগুলো জনগণের চাহিদা মেটাতে পারত না। এগুলোর একটি কপি সংগ্রহ করা কিংবা এতে এক ঝলক চোখ বোলানোর জন্য এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে যেত অনেকেই। প্রধানত অল্পবয়সি ছেলেরাই এগুলো বিলি করত। যুদ্ধের সময় এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যে, খবরের কাগজসহ ধরা পড়ার পর পাকিস্তানিরা এসব কিশোরকে ঘটনাস্থলেই বিনা বিচারে হত্যা করেছে।’ (লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে: মেজর রফিকুল ইসলাম)
বাস্তবতা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সামান্য তথ্য পাবার জন্য বাঙালি হন্যে হয়ে ফিরতো। হাতে লেখা দেওয়াল পত্রিকা এবাড়ি থেকে ওবাড়ি, ওবাড়ি থেকে অন্য বাড়ি পৌঁছাতে গিয়ে অনেক কিশোর, যুবা ধরা পড়ে নির্যাতন ভোগ করেছে। তাদের উষ্ণ রক্তে রঞ্জিত হয়েছে এদেশের মাটি।
যুদ্ধের সময় সংবাদপত্র অন্য রণাঙ্গণের যোদ্ধার ভূমিকাই পালন করেছে। একদিকে স্বদেশ ও প্রবাসী বাঙালি সম্প্রদায়কে সচেতন ও সংঘবদ্ধ করে একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে তোলা এবং বিশ্ব জনমত সৃষ্টি করে তাদের সাহায্য সহযোগিতা ও সমর্থন আদায় করা এর প্রধান এবং আদর্শ লক্ষ্য ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালে ছত্রিশটিরও বেশি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে বলে জানা যায়। এদের মধ্যে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ‘দৈনিক জয়বাংলা।’ নওগাঁ হতে মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে। ১১টি সংখ্যা পাওয়া গেছে। শত্রুকবলিত হওয়ায় পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এর একমাস পর প্রবাসী সরকারের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত (রেজিস্ট্রেশন নং ১) প্রথম সংবাদপত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশক করে জয়বাংলা। যা মূলত আওয়ামী লীগের মুখপত্র ছিল। আট পাতার পত্রিকাটিতে বিজ্ঞাপনও ছিল। পত্রিকাটির লেটার হেড এঁকেছিলেন পটুয়া কামরুল হাসান। কমিউনিস্ট পার্টি প্রকাশ করে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নামক সাপ্তাহিক। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মুখপত্র সাপ্তাহিক নতুন বাংলা নিয়মিত বেরিয়েছে। পত্রিকার লেটার হেডের নিচে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লেখা হতো পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি এবং পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। রুশ-ভারত মৈত্রী চুক্তির পর এরা পূর্ব পাকিস্তানের স্থলে ‘বাংলাদেশ’ লেখা শুরু করে।
২৫ মার্চ নারকীয় হত্যাযজ্ঞ পরিচালনার সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এদেশের সঙ্গে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ফলে ২৬ ও ২৭ তারিখে বিদেশি পত্রপত্রিকাগুলো বাংলাদেশ সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি। শুধু ২৭ তারিখে ভারতের বিভিন্ন পত্রিকায় ও বেতারে মুক্তিযুদ্ধ ও হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের কথা ফলাও করে প্রচার করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মুদ্রণ মাধ্যমের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যুদ্ধের দীর্ঘ নয়মাস ভারত, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের পত্রপত্রিকাসহ বিভিন্ন দেশের মুদ্রণ মাধ্যম বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে গেছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মধ্যে আকাশবাণী, অল ইন্ডিয়া রেডিও, বিবিসি এবং বয়েস অব আমেরিকার নাম স্মরণীয়। আকাশবাণীর খবর ও কথিকা মুক্তিযোদ্ধা, অবরুদ্ধ দেশের মানুষ আর শরণার্থীদের লড়াই করার আর বেঁচে থাকার প্রেরণা যুগিয়েছে। বিবিসি যুদ্ধাক্রান্ত বাংলাদেশ বিষয়ক খবর ছিল সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য। বিদেশি রেডিওর পাশাপাশি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিকরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য ভূমিকা পালন করেন।
বিশ্বের যেসব সাংবাদিক বাংলাদেশের পক্ষে তাদের পত্রিকার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের জনগণ, জনপ্রতিনিধি ও সরকারকে সহানুভূতিশীল করে তোলেন তাদের মাঝে অন্যতম ছিলেন সায়মন ড্রিং, এন্থনি মাসক্যারেনহ্যাস, সিডবি এইচ স্কেনবার্গ, জন ই উডাফ, এস হ্যারিসন, চেষ্টার বাউলেস, জিন ভিনসেন্ট, পিটার আর ক্যান, হেনরি এস রেডসিয়ার, মিলান জে কুবিক, ট্যাড সুজলক, ডব্লিও ব্রাউন, আদাম ক্লাইমার, এনট্যারো পিটিলা, ডুবিয়াস হেভেন, বেঞ্জামিন ওয়েলস, এলভিন টফলার, সি এস সুলজবারগার বেঞ্জামিন ওয়েলস, জনই ফ্রেজার, জন কেনিথ গলব্রেথ, ক্রসবি এ নায়েস, এনথনি এসটারসন, মেলকম এম ব্রাউন, বার্নার্ড গাটজম্যান, উইলিয়ম ডামন্ড, লি লেসক্যাজ, কায়াস বিচ, প্রান সাহারওয়াল, পিটার সারকান, জেস পিস্টেরাসহ আরো অনেক্ েনিজ নিজ দেশে প্রথিতযশা এসব সাংবাদিকরা একের পর এক সংবাদ ও প্রতিবেদন ছেপে বিশ্ব জনমতকে পক্ষে আনার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখেন। অবশ্য তাদের সংবাদসমূহ ছিল ঘটনা সম্পর্কে সত্য বিবরণ এবং এসব সত্য ও নিরপেক্ষ সংবাদ এবং প্রতিবেদনই বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে জানার সুযোগ করে দেয়। সাংবাদিকদের মাঝে ভারতীয় সাংবাদিকদের ভূমিকা ছিল পুরোপুরি বাংলাদেশের পক্ষে।
যেসব বিশ্বখ্যাত পত্রিকা বাংলাদেশের খবর যথাসম্ভব বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষভাবে প্রকাশ করেছিল তার মাঝে উল্লেখযোগ্য পত্রিকাসমূহ ছিলÑ নিউ ইয়র্ক টাইমস, পোস্ট, বল্টিমোর সান, নিউজউইক, টাইম, ইভেনিং স্টার, ওয়াশিংটন ডেইলি নিউজ, ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল, সেটারডে রিভিউ, শিকাগো সান টাইম, ওয়াশিংটন স্টার, ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর, সানডে স্টার, নিউজডে, দি গার্ডিয়ান, আল-আহরাম, লস এঞ্জলেস টাইমস, সিডনি মনিং হেরাল্ড, দি এজ-ক্যানবেরা, নিউ হেলাল্ড-কাঠমুন্ডু, ওয়াং ওয়া ইট পো-পেনাং, জাকার্তা টাইম, ব্যাঙ্কক ওয়ার্লড, অটোয়া সিটিজেন, পালাভার-আক্রো, ব্যাংকক পোস্ট, দি কমনার-কাঠমুন্ডু, সানডে অস্ট্রেলিয়ান বিউনো এ্যায়ারস হ্যারাল্ড, স্টেইটস ইকো-মালয়েশিয়া, স্টেইটস টাইমস-মালয়েশিয়া, ন্যাশনাল জাইটুংও-বার্নি, জাম্বিয়া ডেইলি মেইল, গায়ানা ইভেনিং পোস্ট, সানডে টাইমস-ওয়েলিংটন, দাগেনস নাইহেটার-স্টকহোম, ম্যানিলা ক্রনিলা ক্রনিকল, ভে সার্নজে নভস্তি-যুগোশ্লাভ, পালাভার উইকলি-ঘানা, জা রুবেজম রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়ান অবজারভার, লা সেলেইল-সেনেগাল, দাগরডেট-নরওয়ে, টরেন্টো টেলিগ্রাম-কানাডা, অটোয়া সিটিজেন, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, ফ্রাঙ্কফুর্টার আলমেইন জাইটুং-প জার্মানি, ওয়েস্টার্ন মেইল (কার্ডিফ) ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ, ইয়াঙ্কি-আঙ্কারা, এডভান্স, মাইনিটি ডেইলি নিউজ টকিও, লা লিবর বেলজিক-ব্রাসেলস (নিরপেক্ষ), গ্লোব অ্যান্ড মেইল-টরেন্টো, আল সাওরা দামেস্ক (নিরপেক্ষ), সানডে পোস্ট-নাইরোব, হেল সিনজিন সারোমাত-হেলসিংকি, দে ভক্সক্রান্ত-নেদারল্যান্ড, নেপাল টাইমস, সানডে পোস্ট নাইরোবী, হেল সিজিন সারোমাত হেলসিংকি, দে ভক্সক্রান্ত-নেদারল্যান্ড, নেপাল টাইমস, সানডে টাইমস অফ জাম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া বায়া, মাদারল্যান্ড কাঠমুন্ডু, নিউজ ডেসল্যান্ড-পূর্ব বার্লিন, নানইয়াং সিয়াং পু-মালয়েশিয়া, ইজতে স্তিয়াপ হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, কালান্তর, নিউ এজ, দি স্টেটসম্যান, দর্পণ, টাইমস অব ইন্ডিয়া, পোট্রিয়ট, দি হিন্দু ইত্যাদি। এছাড়া বিশ্বের নামকরা পত্রিকাসমূহ বাংলাদেশের পক্ষে সোচ্চার ছিল দীর্ঘ নয় মাস। এ হতে অনুমেয়, বাংলাদেশের আন্দোলন বিশ্বব্যাপী কিভাবে জনমতকে প্রভাবিত করেছিল।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট ঘনিয়ে উঠলে মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে বিদেশি সাংবাদিকরা ঢাকায় আসতে থাকেন। ২৫ মার্চ রাতে দখলদার পাকিস্তানী বাহিনী অপারেশন সার্চ লাইটের নামে গণহত্যা চালানোর সময় বন্দুকের মুখে সকল বিদেশি সাংবাদিককে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আটকে রাখে এবং ধরে নিয়ে ঢাকা থেকে বিমানে করাচি পাঠিয়ে দেয়। দখলদার পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর তল্লাশী অভিযান এড়িয়ে সেখানে রয়ে যেতে সমর্থ হন ২৬ বছর বয়সী লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক সাইমন ড্রিং। তিনি যুদ্ধ উপদ্রুত ঢাকার লড়াইয়ের চাক্ষুষ বিবরণ জানাতে সমর্থ হন। এক পর্যায়ে ঢাকা ত্যাগ করেন। ব্যাংকক থেকে বাংলাদেশে সশস্ত্র যুদ্ধের ওপর যে প্রতিবেদন পাঠান, তাতে বিশ্ববাসী প্রথম জানতে পারেন, বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যার ঘটনা। ত্রিশে মার্চ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিস্তারিত বিবরণ ছিল। যার ফলে গণহত্যার বিষয়টি দখলদারদের পক্ষে আর চেপে রাখা সম্ভব হয়নি।
লন্ডনের সাপ্তাহিক ‘ইকোনমিস্ট’ নামক সাময়িকী ত্রিশ এপ্রিল লিখেছিল ‘বন্দুকের মুখে ঐক্য’ শিরোনামে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গৃহযুদ্ধের পথ বেছে নিলেও যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারবেন না। সাময়িকী পত্রের মধ্যে টাইম, নিউজউইক, ইকোনোমিস্ট, নিউজ ভারত, গ্লোব অ্যান্ড মেইল (টরেন্টো), ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়ার পাশাপাশি কলকাতার সাপ্তাহিক দেশ, সাপ্তাহিক অমৃত পত্রিকাও পাকিস্তানী হানাদারদের গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট নিয়ে অনেক প্রতিবেদন ছেপেছে। কলকাতা থেকে অনেক লিটল ম্যাগাজিনও বেরিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক। প্রথম প্রকাশিত হয় একাত্তরের এপ্রিলে আশীষ সান্যাল সম্পাদিত ‘ঘোড় সওয়ার’। সেখানে সব কবিতাই ছিল বাংলাদেশ কেন্দ্রিক, হানাদারদের বর্বরতার উল্লেখ। কলকাতায় শিল্পী, সাহিত্যিকদের পাশাপাশি সাংবাদিকরাও ছিলেন সক্রিয়। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে যুদ্ধরত অঞ্চল সরেজমিনে পরিদর্শন করে প্রতিবেদন লিখতেন কলকাতার সাংবাদিকরা।
বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সংবাদপত্র ও সাময়িকীসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। অবরুদ্ধ দেশে অনেক সাংবাদিকই স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাকিস্তানী হানাদারদের পক্ষাবলম্বন করে। বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত ছিল দুই সাংবাদিক। বিচারে তাদের মৃত্যুদন্ড হলেও তারা যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাংবাদিকদের অংশগ্রহণ ও অবদান হাতে গোণা। দালাল আইনে অনেক সাংবাদিক গ্রেপ্তার ও সাজা পেয়েছেন। চীনাপন্থী সাংবাদিকরা পাকিস্তানী জান্তা শাসকের পক্ষে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে ব্যর্থ করতে চেয়েছিলেন। দখলদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকার পরও কতিপয় সাংবাদিক ও সংবাদপত্র মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখায় সচেষ্ট ছিলেন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ভাবাদর্শের প্রতিফলন স্বাধীনতা পরবর্তী সংবাদপত্রেও দেখা যায়।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকালে যদি ফিরে তাকাই দেখবো, একাত্তরে আমাদের সাংবাদিকদের একটা অংশের মনোজগতে পাকিস্তানী চিন্তা-চেতনা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অবস্থান কোনভাবেই সংকুচিত হয়নি। বরং দিন দিন তা বেড়েছে। পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা কিংবা পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার প্রকল্প এসব সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের তাড়িত করে।
মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছরের এই সুবর্ণ সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা সগর্বে বলতে পারি ষাট দশকে আমাদের সংবাদপত্র স্বাধিকার প্রশ্নে সোচ্চার ছিল। শেখ মুজিবের ছয় দফার সমর্থন না করলেও তাঁর কর্মকান্ডের বিবরণী না ছেপে পারেনি পাঠকবিমুখতার আতংকে। পঞ্চাশ বছর আগে বিদেশি সংবাদ-সাময়িকপত্র এবং সাংবাদিকরা যে ভূমিকা রেখেছেন স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে তা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। তারা বাঙালির অহংকার ও গৌরবকে মহিমান্বিত করেছেন।
লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক, মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

seven − 7 =