গরমে স্বস্তি কাফতানে

নাহিন আশরাফ
ঠিক এই সময়টায় এসে মানুষ নিজের জন্য এমন কিছুর খোঁজে যাতে থাকবে স্বাচ্ছন্দ্য আর ফ্যাশন সচেতনতা। তাছাড়া কয়েকবছর ধরে দেশে অস্বস্তিকর গরম পড়েছে। এই আবহাওয়ায় ফ্যাশন করতে চাইলে তার পাশাপাশি আরামকেও প্রাধান্য না দিয়ে উপায় নেই। ফ্যাশন ও আরাম দুটিই পাওয়া যাবে এমন এক ট্রেন্ডি পোশাক হলো কাফতান। প্রাচীন পারস্যে প্রথম এই পোশাক দেখা যায়। মিশর, সৌদি আরব, দুবাইসহ কিছু দেশে বোরকা তখন কাফতান স্টাইলে বানানো হতো। আবার মরক্কোর পণ্ডিত ও উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারাই কাফতান পরতেন। তখন ছেলে মেয়ে উভয়ই কাফতান পরিধান করত। মেসোপটেমিয়া সভ্যতায় এ ধরনের পোশাকের ব্যবহার দেখা যায়। অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতানরা এমন পোশাক পরতেন। আরব দেশের নারীরা ঘরে পরার পোশাক হিসেবেও কাফতান পরতো। কথায় আছে ফ্যাশন কখনো হারিয়ে যায় না, বার বার ফিরে আসে। কথাটি সত্য প্রমাণ করলো কাফতান।

আরব দেশের নারীদের এই প্রিয় পোশাক হঠাৎ করে ট্রেন্ডি পোশাক হয়ে গেলো সবার কাছে। প্রথম বাংলাদেশে কাফতানের ব্যবহার দেখা যার বোরকার মধ্যে দিয়ে। যারা একটু ভিন্নধর্মী বোরকা পরতে চাইতো তারা কাফতান স্টাইলের বোরকা পরে উপরে হিজাব পরতো। বোরকার পর কাফতান দেখা যেত নাইট ড্রেস হিসেবে। ঢিলেঢালা লম্বা এই পোশাক অতি আরামদায়ক হবার কারণে অনেকে বেছে নিতে শুরু করে নাইট ড্রেস হিসেবে। ধীরে ধীরে পাকিস্তান, ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশে কাফতান হয়ে উঠে জনপ্রিয়। বোরকা ও নাইট ড্রেস থেকে বের হয়ে কাফতান নিয়ে শুরু হয় নানা ফিউশন। কাফতানের মধ্যে নিয়ে আসা হয় বৈচিত্র্য। বিভিন্ন দৈর্ঘ্যে যেমন ২৮ ইঞ্চি থেকে শুরু করে ৩২ ইঞ্চি পর্যন্ত এমনকি পা পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় ৬০ ইঞ্চি পর্যন্তও নেমে যাচ্ছে কাফতানের দৈর্ঘ্য। কামিজ, কুর্তি, শর্ট টপস, লং টপস ইত্যাদি সব কিছুই কাফতান স্টাইলে করা হচ্ছে। এখন ওভার সাইজ পোশাকের ট্রেন্ড চলছে আবার কাফতানও ঢিলেঢালা তাই বেশ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। প্রিন্টের কাফতান, এক রঙের কাপড়ে রঙিন আঁকিবুঁকি করা কাফতান, বাটিক ইত্যাদি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিভিন্ন ফুলের ডিজাইন, লতা-পাতা, জ্যামিতিক ডিজাইন স্থান পেয়েছে কাফতানে। কোনোটিতে আবার সিকুয়েন্স, পার্ল, স্টোন ওয়ার্ক করা থাকে। এইসব কাফতান খুব গর্জিয়াস হয়ে থাকে।

কাফতানে এখন দেশীয় ঐতিহ্যের ছোঁয়া আনা হচ্ছে। কাফতানে করা হচ্ছে সুই সুতার কাজ, এমব্রয়ডারি ও হ্যান্ড পেইন্ট। নকশি কাঁথা ও জামদানি মোটিভের কাফতানও চোখে পড়ে। শার্টের কলারের মতো কলারও দেখা যায় কিছু কাফতানে, তাতে কলারের মধ্যে নকশা করা হয়ে থাকে। দেশীয় ঐতিহ্য বজায় রাখতে কিছু ফ্যাশন হাউজ মসলিন কাপড়ের কাফতান বানিয়ে থাকে, এছাড়া কাপড়ের উপর হাতের কাজ করা হয়ে থাকে। খুব সাধারণ সুতি কাপড়ের কুর্তিকে কাফতান স্টাইলে বানিয়ে আরো বেশি ট্রেন্ডি করে তোলা হচ্ছে। কাফতান স্টাইলের কুর্তির উপর সবচেয়ে বেশি ফুলের মোটিভ দেখা যায় ও সামনে ফিতা থাকে। উজ্জ্বল রঙের কাফতানের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। হলুদ, কমলা, নীলের উপর নানা ধরনের প্রিন্টের কাফতান নজরকাড়া হয়ে থাকে। কাফতান শাড়ির সঙ্গে বেশ মিলে যায়। শাড়ি যখন ড্রেপ করে কোনো বেল্ট দিয়ে ফ্যাশনেবল স্টাইলে পরা হয়, ঠিক তেমনই দেখায় কাফতান।

কাফতান আপনাকে আত্মবিশ্বাসী ও ফ্যাশনেবল করে তুলবে। প্যান্ট, ল্যাগিংস কিংবা জ্যাগিংসের সঙ্গে এ পোশাকটি পরা যায়। ক্লাস, অফিস, বন্ধুদের আড্ডা কিংবা হুটহাট যেকোনো কাজে বাইরে যাওয়ার জন্য কাফতান একটি ভালো অপশন। নিত্যদিনের জন্য কাফতান সুতির হলেই ভালো। কারণ সুতি কাপড় আরামদায়ক হয়। সুতি ছাড়া লিলেন কাপড়ের কাফতানও পরা যেতে পারে। জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে কিংবা সান্ধ্যকালীন যেকোনো পার্টিতে কাফতান পরা যায়। সে ক্ষেত্রে সিল্ক, শিফন, পাতলা ভেলভেটের কাফতান বাছাই করতে হবে। আপনাকে আরও বেশি রুচিশীল করে তুলতে পারে যদি পোশাকটিতে টার্সেল ও লেইসের ব্যবহার থাকে। গর্ভবতী মায়েদের পছন্দের তালিকায় নির্দ্বিধায় থাকতে পারে কাফতান। কাফতান পরে খুব সহজে উঠা বসা করা যেতে পারে। কাফতানের একঘেয়েমি কাটাতে কোমরে একটি বেল্ট ব্যবহার করুন। যেহেতু কাফতান অনেক ঢিলা হয়ে থাকে; তাই বেল্ট পরলে কোমরের দিক থেকে বেশ সুন্দর ও মানাসই দেখাবে। এটি স্টাইলে ভিন্ন মাত্রা যোগ করবে। পছন্দের লকেট লাগিয়ে নিতে পারেন কাফতানের গলার কাছে। কোমরের কাছে টার্সেল বা ফিতা টানার ব্যবস্থা থাকতে পারে, যাতে শরীরে কিছুটা ‘ফিট’ করে কাফতান। কাফতানের নিচের দিকে অসমান কাট আনতে পারেন। জিগজ্যাগ প্যাটার্ন হতে পারে কিংবা এক পাশ বড়, অন্য পাশ ছোট করতে পারেন। আবার নিচের দিকটা একটু গোল করে কেটে ডিম্বাকৃতিও করতে পারেন। কাফতানের সামনের দিকে (মাঝে বা দুপাশেই) টার্সেল বসিয়ে দিতে পারেন। সুতা দিয়ে টার্সেল বানিয়ে নেওয়া যায়। হাতের অংশ কেটে সুবিধামতো ছোট করে নিতে পারেন। ভাঁজ করে করে সেলাই করলেও হাতের অংশ ছোট হয়ে আসবে, নকশাতেও ভিন্নতা আসবে।

কোনো উৎসবে বা অনুষ্ঠানে কাফতান পরলে এর সঙ্গে জুয়েলারি পরতে পারেন। বিশেষ করে কাফতানের সঙ্গে সিলভার জুয়েলারি বেশ মানিয়ে যায়। কাফতানে যদি ডিজাইন কম থাকে তবে গলায় বড় সিলভার জুয়েলারি পরতে পারেন। অফিসে বা আউটিংয়ে কাফতান পরলে এর সঙ্গে স্কার্ফ ব্যবহার করতে পারেন। এটা লুকটাই চেঞ্জ হয়ে যাবে ও নিয়ে আসবে ভিন্নতা। কাফতানের সাথে জুতি বেশ মানানসই, পার্টিতে গেলে কাফতানের সঙ্গে হাইহিল পরা যেতে পারে। এছাড়া অনেক নারী আরামে চলা ফেরার জন্য সব ধরনের পোশাকের সাথেই স্নিকার্স পরে থাকেন। তারা চাইলে কাফতানের সাথেও স্নিকার্স পরতে পারেন।

বলা হয়ে থাকে কাফতানকে এক প্রকার ট্রেন্ডে নিয়ে এসেছে বলিউড তারকারা। ২০২০ সালে বলিউড তারকাদের মধ্যে কাফতান পরবার হুল্লোড় পড়ে যায়। সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখা যায় বলিউড তারকাদের কাফতান দিয়ে নানা স্টাইল। ঐশ্বরিয়া রায়কে দেখা যায় সাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে নীল কাফতান ও সানগ্লাসে। কাফতানের রং ও সাগরের রং যেন মিলে একাকার। সোনম কাপুরকে একটি ফটোশুটে দেখা যায় ক্লাসি সাদা রঙের কাফতানে ও তার হাতে ছিল সিলভার ব্রেসলেট ও কানে সাদা টপ। শিল্পা শেঠিকে দেখা যায় লং লাল কাফতানে ও চুলে ছিল লাল ব্যান্ড। প্রিয়াংকা চোপড়া আকাশি কাফতান কোমরে সাদা বেল্ট পরে ও মাথায় ওভারসাইজ হ্যাট পরে সোশ্যাল মিডিয়াতে ছবি দেন। অন্যদিকে কারিনা কাপুরকে তার গর্ভকালীন সময়ে কাফতান পরে মিডিয়ায় সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে। এছাড়া অনেক বলিউড তারকারা ভ্রমণ কিংবা লং জার্নির সময় কাফতান পরেন বলে জানা গিয়েছে তাদের সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। তাই এটা বললে ভুল হবে না বলিউড থেকেই এই কাফতান ফ্যাশনে পৌঁছে গেছে।

কোথায় ও কেমন দাম
ট্রেন্ডে থাকার কারণে কাফতান এখন বাড়ির কাছে যেকোনো আউটলেটে গেলেই পাওয়া যাবে। দেশীয় ও নান্দনিকতার ছোঁয়া থাকবে এমন কাফতান চাইলে যেতে পারেন দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলোতে। আড়ং, দেশাল, অঞ্জনস, লা-রিভ, ইয়েলোসহ অনেক ফ্যাশন হাউজগুলো এখন তাদের কালেকশনে কাফতান রাখছে। সম্প্রতি আবহাওয়া ও চাহিদার কথা চিন্তা করে দেশাল তাদের কালেকশনের বড় একটি অংশ জুড়ে কাফতান রেখেছে। ব্র্যান্ডগুলোতে কাফতানের দাম পড়বে ২০০০ টাকা থেকে ৩৫০০ টাকার মধ্যে। কাপড় যদি সিল্ক বা মসলিনের হয় তাহলে দাম আরো বাড়বে। পার্টিতে পরার মতো গর্জিয়াস কাফতান চাইলে যেতে পারেন বসুন্ধরা সিটি, যমুনা ফিউচার পার্ক, পিঙ্ক সিটি ও পুলিশ প্লাজা। এইসব জায়গায় কাফতানের দাম পড়বে ৫০০০ টাকা থেকে ১২০০০ টাকার মধ্যে। নন ব্র্যান্ডের কাফতান চাইলে ঘুরে আসে পারেন নিউ মার্কেট, গাউছিয়া, নূরজাহান, মৌচাক মার্কেটের মতো কিছু জায়গায়। এইসব জায়গায় নিত্যদিনের ব্যবহারযোগ্য সুতির কাফতান পাওয়া যাবে। দাম পড়বে ৩০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে। এছাড়া অনলাইনেও রয়েছে বেশ কিছু কাফতানের সমাহার। হুর নুসরাত, কইন্যা, কারুশালা, শরদিন্দুসহ আরো কিছু পেইজে রয়েছে কাফতান কালেকশন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ফ্যাশন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

nine − two =