রোদে পোড়া ত্বকের প্রাকৃতিক যত্ন

নীলাঞ্জনা নীলা

বাইরে তাপের দাপট থাকলেও রোজ কিন্তু কাজে বের হতে হচ্ছে। গরমের দোহাই দিয়ে ঘরে বসে থাকবার তো উপায় নেই। আর তাপের প্রভাব পড়ছে সরাসরি আমাদের ত্বকের ওপর। যাকে বলা হয় ‘সানবার্ন’। সানবার্ন নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেন রূপবিশেষজ্ঞ সেলিনা পারভীন। সানবার্ন আসলে কি; জানতে চাইলে তিনি বলেন, সূর্যের অতিবেগুনি বিকিরণের সংস্পর্শে আসার ফলে ত্বক রোদে পুড়ে যায়। তাকেই মূলত সানবার্ন বলা হয়ে থাকে। ত্বকে সূর্যের কারণে হওয়া ক্ষতি প্রায়শই প্রকাশ পায় না। রোদে পোড়া ছাড়াও, অতিবেগুনি রশ্মি ত্বকের নিচে ডিএনএ’র পরিবর্তন করতে পারে। যার ফলে আপনার ত্বক অকালেই বয়স্ক দেখাতে পারে। ডিএনএ’র ক্ষতি হলে সময়ের সাথে সাথে মেলানোমাসহ ত্বকের মেলিগনেসিস পর্যন্ত ঘটাতে পারে। মেলানিন এই ক্ষতির প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। মেলানিন হলো ত্বকের বাইরের স্তরের একটি গাঢ রঞ্জক যা ত্বককে তার স্বাভাবিক রঙ প্রদান করে। সূর্যের সংস্পর্শে এলে ত্বক মেলানিন তৈরি করে যা ত্বকের সর্বনিম্ন স্তরকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। কিছু মানুষের শরীরে অতিরিক্ত মেলানিনের ফলে চামড়ায় একটি গভীর আভা বা ট্যান তৈরি হয়। যাদের মেলানিন কম থাকে তারা উজ্জ্বল রক্তবর্ণ ধারণ করে, যা রোদে পোড়ারই ইঙ্গিত দেয়। এই রোদে পোড়া লালভাব শরীরে ক্ষতির প্রতিক্রিয়ার কারণে ঘটে।

রোদে পোড়া ত্বকের সাধারণ লক্ষণ
১. ত্বক লাল হয়ে উঠবে ২. শরীর পানি শুষে নেওয়ার জন্য পানিশূন্যতা দেখা দিবে ৩. ত্বকে সামান্য ব্যথা অনুভব হবে ৪. চুলকানি ও লাল র‌্যাশ হবে, এমনকি ফুসকুড়িও হতে পারে। ৫. চামড়াতে ছোপ ছোপ দাগ দেখা যাবে।
রোদ পোড়া ত্বকের জন্য চাই বিশেষ যত্ন। যত্ন না দিলে ত্বকের উপর খারাপ প্রভাব পড়বে যা পুনরুদ্ধার করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। প্রথমেই চেষ্টা করতে হবে রোদের সংস্পর্শে যতটা কম আসা যায়।
নিজেকে রোদ থেকে বাঁচাতে

ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন: ময়েশ্চারাইজার ত্বকের আর্দ্রতা ফিরিয়ে আনতে, সেটি ধরে রাখতে এবং ত্বকের উপরে একটি হাল্কা অদৃশ্য আস্তরণ তৈরি করে। ত্বকে উপস্থিত জলের অণুকে ত্বক থেকে বাইরে চলে যাওয়ার পথে বাধা প্রদান করে। তাই ত্বকের ধরন যেমনি হোক ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার রোজ করতেই হবে।

সানস্ক্রিন ভুলে যাওয়া যাবে না: রোদ থেকে ত্বককে রক্ষা করতে চাই সানস্ক্রিন। সানস্ক্রিন ক্রিমের সান প্রটেকশন ফ্যাক্টর আপনার ত্বককে অতি বেগুনি রশ্মির হাত থেকে রক্ষা করে। এবং একই সাথে সান ব্লক ক্রিম ব্যবহার করলে ত্বক পুড়ে যাওয়ার কারণে স্কিন ক্যান্সারের মতো জটিল রোগ থেকেও আপনি বেঁচে যেতে পারেন। তাই ঘর থেকে বের হবার আগে কোনোভাবেই সানস্ক্রিন লাগাতে ভুলে যাওয়া যাবে না।

সানগ্লাস ও ছাতা ব্যবহার করুন: রোদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ময়েশ্চারাইজার ও সানস্ক্রিন খুব ভালো সাহায্য করে। কিন্তু এরপর চাই বাড়তি সুরক্ষা। তাই ঘর থেকে বের হবার সময় রোদ চশমা ব্যবহার করার অভ্যাস করতে হবে। এটি চোখ ও চোখের নিচের অংশকে রোদ থেকে রক্ষা করবে। সাথে ছাতা রাখতে হবে।

সব ধরনের সুরক্ষা নেওয়ার পরেও যদি ত্বক রোদে পুড়ে যায় তখন ত্বক পুনরায় সুস্থ করতে দিতে হবে নিজেকে বাড়তি সময়। ত্বকের যত্ন নিতে হলে যে প্রতি মাসে পার্লারে যেতে হবে ও সেখানে কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালতে হবে এমন নয়। আমরা চাইলে খুব সহজেই নিজেদের রান্না ঘরে থাকা উপাদান দিয়েই কম খরচে ও বাড়তি ঝামেলা ছাড়া নিজেদের যত্ন নিতে পারি।

রোদে পোড়া ত্বকের যত্ন
টোনার: ত্বক গভীর থেকে পরিস্কার করে টোনার। এটি ত্বকে বাড়তি পুষ্টি জোগায় এবং ত্বকের পিএইচ ব্যালান্স বজায় রাখে। এ ছাড়া রোমকূপ সংকুচিত করে ব্রণের প্রবণতা কমাতে সহায়তা করে। টোনিং ত্বকের রক্ত সঞ্চালন বাড়ায় এবং অতিরিক্ত তেল নিঃসরণ রোধ করে। রোদে পোড়া ত্বক অনেক বেশি তেলতেলে হয়ে যায়, তখন সেই তেল কমাতে টোনার সাহায্য করে। বাড়িতে শসা দিয়ে খুব সহজে টোনার বানানো যায়। ভালো করে শসার রস বের করে কিছুক্ষণ ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা করে তুলা দিয়ে মুখে লাগিয়ে নিন। এটি রোদে পোড়ার ফলে চামড়ার ব্যথা ও লাল ভাব কমায়। এছাড়া গোলাপজল, আলুর রস, টমেটো রস ইত্যাদি টোনার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

লেবুর রস ও মধু: মধুতে রয়েছে ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার গুণ এবং লেবুর রসে আছে ব্লিচিং উপাদান; যা ত্বকের রোদে পোড়া দাগ দূর করতে সহায়তা করে। লেবুর রস ও মধু মিশেয়ে প্যাক বানিয়ে ৪০ মিনিট মুখে রেখে ধুয়ে ফেলুন। এটি নিয়মিত ব্যবহারের ফলে দূর হবে চামড়ার কালচে ভাব।

হলুদ ও বেসন: রান্নাঘরে এই দুটি উপাদান থাকবেই। তাই চটজলদি এই দুটি দিয়ে বানিয়ে ফেলুন চামড়ার জন্য উপকারী প্যাক। এই প্যাক রোদে পোড়া দাগ কমিয়ে ত্বক উজ্জ্বল করতে সাহায্য করে। হলুদ ও বেসনের সাথে দুধ মিশিয়ে প্যাক তৈরি করে মুখ ও শরীরে লাগিয়ে ৩০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলতে হবে। এটি চামড়ার গভীরের ময়লা বের করে এনে মুখ পরিষ্কার করবে।

মুলতানি মাটি: ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইডে সমৃদ্ধ মুলতানি মাটি ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা প্রাকৃতিকভাবে দূর করে ত্বককে ভিতর থেকে সুন্দর করে তোলে। মুলতানি মাটি ত্বককে উজ্জ্বল করার সাথে সাথে ত্বকের কোষ পুনর্গঠনে সাহায্য করে। মুলতানি মাটি স্ক্রাব হিসেবেও খুব ভালো কাজ করে। আমন্ড কিছুটা গুঁড়া করে এর সাথে গ্লিসারিন এবং এক চা চামচ মুলতানি মাটি মিশিয়ে স্ক্রাব হিসেবে হালকাভাবে ঘষুন। এই স্ক্রাবটি কনুই বা ঘাড় থেকে কালো দাগ তুলে ফেলতে সাহায্য করবে। সামান্য চিনি দিয়ে নাকের দুইপাশে ঘষলে ব্ল্যাক হেডস এবং হোয়াইট হেডস দূর করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে।

নারিকেল তেল: নারিকেল তেল চুলের জন্য উপকারী এটা কে না জানে। কিন্তু নারিকেল তেল চামড়ার জন্যও বেশ উপকারী। তবে অবশ্যই তা হতে হবে খাঁটি নারকেল তেল। নারকেল তেল ত্বকের জন্য প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার হিসেবে কাজ করে। এটি ত্বকের মরা চামড়া দূর করে এবং ত্বক উজ্জ্বল করে। চর্মরোগ, ডার্মাটাইটিস, একজিমা এবং রোদে ত্বক পুড়ে গেলেও এটি ব্যবহার করা যেতে পারে।

দুধ: দুধের পুষ্টিগুণ নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই দুধ দিয়েও করা যায় পোড়া ত্বকের যত্ন। দুধের ভেতর রয়েছে ল্যাকটিক এসিড। ল্যাকটিক এসিড চামড়ার ভেতরে থাকা মৃত কোষ দূর করতে সাহায্য করে। রোদে পোড়া ত্বকে অনেক সময় অকালে বয়সের ছাপ পড়ে যায়। নিয়মিত দুধ দিয়ে মুখ ধোয়ার ফলে তা অনেকাংশে কমে যায়। ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করতে তুলা দিয়ে দুধ ব্যবহার করতে পারেন বা অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে দুধ মিশিয়ে ফেস প্যাক বানিয়ে নিয়মিত ব্যবহার করতে পারেন।

পরিশেষে সেলিনা পারভীন বলেন, রূপচর্চা যা-ই করা হোক না কেন, অল্প সময়ে ফল আশা করা যাবে না। ধৈর্য নিয়ে ত্বকের পরিচর্যা করে যেতে হবে এবং পাশাপাশি স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেতে হবে ও দেহের চাহিদা অনুযায়ী পানি পান করতে হবে। বলা হয় ত্বকের বড় ঔষধ পানি। পানি ভেতর থেকে ত্বককে পরিষ্কার রাখে। রোদে পুড়ে গিয়ে অনেক সময় ত্বকে ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে। তখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে হবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: আরশী

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

20 − 1 =