নিলয় রহমান : ষাটের দশকে বাংলাদেশে ‘ট্যাপেস্ট্রি’ শিল্পকর্ম হিসেবে আত্ম প্রকাশ করে। দেশ বরেণ্য প্রখ্যাত শিল্পী রশীদ চৌধুরী পাশ্চাত্যের উচ্চ শিক্ষা শেষে এদেশে ট্যাপেস্ট্রির গোড়াপত্তন করেন। এর পরে আশির দশকে প্রখ্যাত শিল্পী আব্দুশ শাকুর শাহ ট্যাপেস্ট্রিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিল্পশিক্ষা মাধ্যম হিসাবে চারুকলায় অন্তর্ভূক্ত করেন। সেই থেকে এই মাধ্যমটি নিয়ে শিল্পীরা নিরন্তর কাজ করছেন। শিল্পী রশীদ চৌধুরীর ফর্ম থেকে বেরিয়ে শিল্পীরা নানা রকম নতুন নতুন ফর্র্মে ট্যাপেস্ট্রিকে নবরূপে উদ্ভাসিত করেছেন। ধীরে ধীরে ট্যাপেস্ট্রি পরবর্তীতে ফাইবার আর্ট শিল্পমাধ্যমের সাথেও সখ্য গড়েছে।
শিল্পী মো: মনিরুল ইসলাম ও শিল্পী সুলতানা রুবী ট্যাপেস্ট্রি মাধ্যম নিয়ে চারুকলায় শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় শিল্পী আব্দুশ শাকুর শাহের অনুপ্রেরণায় এ মাধ্যমটির প্রতি আকৃষ্ট হন। তারপর শুরু হয় নিরলস নিরীক্ষা। নিজেদের সৃজনশীলতাকে তুলে ধরেন স্থানীয়, জাতীয় ও অন্তার্জাতিক নানা শিল্প প্রদর্শনীতে। উপস্থাপন করেন নিজস্ব স্বকীয়তা। প্রচারবিমূখ এই শিল্পী দম্পতিকে নিয়েই রঙ-বেরঙের আজকের কথপোকথন।
শিল্পী মনিরুলের ট্যাপেস্ট্রিতে সনাতন ফ্রেম ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার একটি প্রবণতা শুরু থেইে লক্ষ্য করা যায়। শিল্পকর্মে ব্যবহৃত শিল্প উপকরণ ও বুননের কৌশলে তিনি নানা রকম নিরীক্ষায় নিবিষ্ট হন। উপকরণে নতুনত্ব আনতে ব্যবহার করেছেন উল, কটন, নাইলন, জুট ফাইবার। এছাড়াও গার্মেন্টস শিল্পে ব্যবহৃত নানা ধরণের স্ট্রিং, ড্র-কর্ড, লেইস, চেইন, ইলেক্ট্রিক ওয়ার, রাবার স্ট্রিং, কাঠ ইত্যাদি ব্যবহারে তন্তুর পরস্পর বুননে বুনটের আলেখ্য তৈরির সাহসিকতা দেখিয়েছেন।
তিনি মানব অবয়বকে আশ্রয় করে নানা রকমের অনুষঙ্গে শিল্পরস তৈরি করেন মূর্ত-বিমূর্ত আঙ্গিকে এবং মানবীয় আবেগগুলোকে তুলে এনেছেন রঙে, রেখায়, তন্তুর নমনীয়তায়। দেহ অবয়বকে ঘিরেই উঁচু-নীচু এলামেলো অসমতল বুনটের টেক্সচার, মূর্ত-বিমূর্ত ফর্মের উলম্ব ব্যঞ্জনার (ভার্টিক্যাল) উপস্থাপনা দেখা যায়। শিল্পী মনিরুলের বুনটের টেক্সচার ও উপকরণ ব্যবহারে ভিন্নতার সাথে ত্রিমাত্রিক ইলুশনে তৈরি হয়েছে এনগ্রেভিং ও কার্ভিং-এর রিলিফ বৈশিষ্ট্য যা শেষ হয় ফ্রেমবদ্ধ অথবা ফ্রেমের বাইরে ঝুলন্ত মানবিক অবয়বে।
শিল্পী মনিরুল অনেক সময় তার কাজে লে-আউট ছাড়াই সরাসরি কাঠের ফ্রেমে নানা দ্যোতনায় উপকরণের স্বাভাবিক প্রকাশময়তায় বিষয় উপস্থাপন করেছেন। লে-আউট ছাড়া মানে, কাজটি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে শিল্পী নিজেও তা জানেন না; বরং রঙ, টেক্সচার ও তন্তুর নমনীয়তায় মনের চেতন-অবচেতন সংঘাতে তাকে অজানা আবেগের আরেক স্তরে পৌছে দেয়। ফর্মকে ভেঙ্গে বুনটের টেক্সচারে নানা আঙ্গিকে একটি দ্যোতনা তৈরি করে। এ যেন ছন্দবদ্ধ কবিতা। এ যেন নিজের সাথে নিজের নিত্য নতুন কথপোকথন। শিল্পী সুলতানা রুবীর ট্যাপেস্ট্রিতে মানুষ ও প্রকৃতির সমন্বিত রূপ ফুটে উঠে ছন্দময় বুনটের টেক্সচারে ও রঙে। উপকরণ ব্যবহারে তিনি বেশ সাহসী। উল, কটন, জুট, ড্র-কর্ড, নাইলন স্ট্রিং ফাইবারের সঙ্গে তিনিই প্রথম গার্মেন্টস শিল্পে ব্যবহৃত ফেলে দেয়া অফকাট কাপড়, ঝুট ইত্যাদি ট্যাপেস্ট্রিতে সফলভাবে প্রয়োগ করেছেন। এটি তার কাজের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। ট্যাপেস্ট্রির বুনটের স্বকীয়তা এবং তন্তুর নমনীয়তাকে প্রাধাণ্য দিয়ে তার সৃজনকৃত শিল্পকর্মগুলো নিরলস নিরীক্ষার ফসল।
নকশার বুনটে এসব উপকরণে নান্দনিক একটি চরিত্র বহন করে। তার অনেক কাজে ঠাস বুননে তৈলচিত্রের মসৃণতার আভা ফুটে উঠে। এছাড়াও দেহ অবয়ব ও প্রকৃতিকে ঘিরে গড়ে উঠা ফর্মগুলো তার ট্যাপেস্ট্রিতে পরিপাটিভাবে বা এলামেলোভাবে জ্যামিতিক নকশায় ফ্রেমবদ্ধ বা ঝুলন্তভাবে উপস্থাপিত। ২০০২ সালে শুধু ট্যাপেস্ট্রি নিয়ে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের আর্ট গ্যালারীতে তার একটি একক চিত্র প্রদর্শনী হয়েছে। মূর্ত-বিমূর্ত নানা আঙ্গিকে এই শিল্পীদ্বয় নিজের সৃজনশীলতাকে হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছেন। মাধ্যমের সাবলীল উপস্থাপনায় তাদের ট্যাপেস্ট্রি ও ফাইবার আর্ট থেকে শিল্প রসিক মাত্রই অনায়াসে শিল্পরস আস্বাদন করতে পারেন। এই শিল্পী দম্পতি আগামীতে আরও নতুন সৃষ্টি উন্মাদনায় নিবিষ্ট হবেন সেই প্রত্যাশা রইলো।