তালের গুণের শেষ নেই

হাসান নীল

ভাদ্র মাসের গরমে তাল পাকে আরামে। চারদিক ম ম করে পাকা তালের ঘ্রাণে। আকাশ ছোঁয়া উচ্চতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তাল গাছগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় অসংখ্য গোলাকৃতির কালো রঙের বল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কখনও কখনও টুপ করে পড়ে মাটিতে। তালের ছাল ছাড়াতেই মাতাল করা ঘ্রাণ। নতুন ধান ঘরে এলে যেমন শুরু হয় পিঠাপুলির উৎসব তেমনই তালের মৌসুমে পাকা তালের হরেক রকম পদ তৈরি হয়। তালের পিঠা, তালের বড়া আরো কত কি।

দেশি নয় বিদেশি ফল

সুপ্রাচীন এই বৃক্ষ গ্রামাঞ্চলে অহরহ পাওয়া যায়। পথে ঘাটে পুকুর ধারে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। অনেকের ধারনা এটি দেশি ফল। এখানেই ভুলটা হয়। তাল মোটেও দেশি ফলের তালিকাভুক্ত নয়। কৃষি তথ্য সার্ভিসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এর উৎপত্তি স্থল আফ্রিকা। তবে অনেকে এ কথায় ভরসা পান না। তাদের মতে তাল উপমহাদেশীয় ফল। দেশে প্রায় সব এলাকায়ই তাল গাছ দেখা গেলেও ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, রাজশাহী ও খুলনা এলাকায় তালের উৎপাদন বেশি। একে বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন গাছ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে তালের কোনো অনুমোদিত জাত নেই।

গুণের শেষ নেই

গরমকালে কাঁচা তাল বেশ চাহিদাসম্পন্ন। তালের কচি শাস যেন অমৃত। তবে পাকা তালেরও গুণের শেষ নেই। এতে আছে প্রচুর ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস যা দাঁতের ক্ষয় রোধ করে থাকে। পাশাপাশি অ্যান্টি অক্সাইড গুণসমৃদ্ধ যা ক্যান্সার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। কোষ্ঠকাঠিন্য ও অন্ত্রের রোগ ভালো করতেও তাল ভালো ভূমিকা রাখে।

স্বাদ চমৎকার

পাকা তাল থেকে হয় হরেক রকম উপাদেয় খাবার। এরমধ্যে রয়েছে তালসত্ত্ব, তালের জুস, তালের বড়া, তালের কেক, তালের সেঁকা পিঠা। জামাই আপ্যায়ন থেকে শুরু করে অতিথি আপ্যায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে খাবারগুলো।

কিছুই ফেলতে হয় না

তালগাছ এমন একটি গাছ যার ফলের পাশাপাশি কোনো অংশ অপ্রয়োজনীয় নয়। প্রতিটি অংশই কোনো না কোনো কাজে লাগে। তাল ও তাল গাছ থেকে পাওয়া যায় রস, গুড়, চিনি, তাল মিছরি, তাল শাঁস, তাল ফল, তাল ফোঁপা।  বীজের শাঁস থেকে তেলও পাওয়া যায়। তালের আঁটি থেকে সদ্য গজানো অঙ্কুর সেদ্ধ করে খাওয়া যায়। এটি অত্যন্ত পুষ্টিকর। বছরে দেড় শ লিটার রস দিয়ে থাকে একটি তালগাছ। আফ্রিকায় এই রস মদ ও বিয়ার উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।

শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় ফল

শোনা যায় শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় ফল ছিল তাল। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম তাল পাকা মৌসুমে। সে কারণেই জন্মাষ্টমী পূজা তাল ছাড়া অসম্পূর্ণ থাকে। এছাড়া পুরাণ থেকে জানা যায়, বাসুবেদকে নন্দরাজের কাছে রেখে আসার পর গোকুলে কৃষ্ণের আবির্ভাব উপলক্ষ্যে প্রথম খাওয়ানো হয়েছিল তালের বড়া। ওই কারণে এই বড়া খুবই প্রিয় কৃষ্ণের। তাই জন্মাষ্টমীতে হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা বাড়িতে নানা রকম তালের পদ তৈরি করে থাকেন। এর মধ্যে তালের ক্ষীর, বড়া উল্লেখযোগ্য।

ধর্মেও গুরুত্বপূর্ণ

ধর্মীয় দিক থেকেও তালগাছ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ইহুদী ধর্মের অনুসারীদের কাছে। তারা মনে করেন জেরুজালেমবাসীদের সৃষ্টিকর্তা একটি বিশেষ তালগাছ উপঢৌকন হিসেবে দিয়েছিলেন। ধারণা করা হয় ওই তালগাছ হযরত দাউদ (আ.) সমাধির কাছাকাছি কোনো এক জায়গায় ছিল। এ ধর্মের অনুসারীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব স্টার উৎসব। এর আগের রোববারকে নামকরণ করা হয়েছে তাল গাছের নাম অনুসারে পাম সানডে। হিন্দু ধর্মেও তালের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীষ্মের রথে খচিত ছিল তাল গাছ। অন্য ধর্মীয় গ্রন্থগুলোতেও তাল গাছের উল্লেখ আছে।

শক্তির প্রতীক

ধর্মীয় দিক ছাড়াও বিভিন্ন দেশে তাল গাছের আছে বিশেষ গুরুত্ব। কোনো কোনো দেশে একে শক্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কম্বোডিয়ায় তাল গাছকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে জাতীয় বৃক্ষের।

কুসংস্কার

তাল গাছ দেরিতে ফল দেয়। ফলে রোপণকারী অনেক সময় ফল খেয়ে যেতে পারেন না। এর অবশ্য কারণও আছে। অনেক সময় শেষ বয়সে এসে তালগাছ রোপণ করায় এমনটা ঘটে। তবে গ্রামাঞ্চলে বিষয়টি শক্ত করেছে কুসংস্কারের ভিত। প্রচলিত আছে যিনি তাল গাছ রোপণ করেন তার খাওয়ার ভাগ্য হয় না। এ কথা মেনে অনেকেই তাল গাছ এড়িয়ে চলেন। এমনকি বাড়িতে তাল গাছ লাগানো নিয়েও রয়েছে আপত্তি।

খনার বচন

খনা বচন অনুযায়ী ‘এক পুরুষে রোপে তাল/ অন্য পুরুষি করে পাল। তারপর যে সে খাবে/ তিন পুরুষে ফল পাবে।’ খনার এই বচনটি অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায় তালের সঙ্গে। কেননা তাল গাছ রোপণ করলেও খাওয়ার ভাগ্য কম লোকেরই হয়। একটি তাল গাছ বাঁচে এক শ বছর। আয়ু এতো বলে ভাবার অবকাশ নেই যে আজীবন ফল দেয় তাল গাছ। গাছে ফল আসতেই লেগে যায় কুড়ি বছর।

স্ত্রী গাছ ফল দেয়

একটি তাল গাছে বছরে ৬ থেকে ১২টি কাঁদিতে ৩০০টি পর্যন্ত তাল ধরে থাকে। পুরুষ ও স্ত্রী তাল গাছ আলাদা। পুরুষ তাল গাছে ফল হয় না। তবে তাল গাছে ফল আসা যেমন একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া তেমনই ফুল থেকে ফলে পরিণত হতেও লাগে লম্বা সময়। ফুল আসে নভেম্বর-ডিসেম্বরে। পুরুষ পুষ্পমঞ্জরিতে ফুল ফুটতে লাগে দুই মাস। এপ্রিল মে’র দিকে তালে শ্বাস হয়। তা পাকতে থাকে আগস্ট সেপ্টেম্বরে। তালের রস মূলত পুরুষ গাছ থেকে পাওয়া যায়। পুরুষ ফুলের জটা হয়। জটা কেটে রস নামানো হয়।

কুটিরশিল্প

কুটিরশিল্পেও তালগাছ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তালের হাতপাখা, টুপি, ব্যাগ, বর্ষাতি, মাথাল, ঝুড়ি বেশ জনপ্রিয়। বিভিন্ন মেলায় কারুশিল্প পণ্যের প্রদর্শনীতে এগুলো ক্রেতাদের আলাদাভাবে নজর কাড়ে। এছাড়া পাকা তালের আঁশ থেকে তৈরি করা হয় এক ধরনের সুতা। এই সুতা দিয়ে কাপড় পর্যন্ত বোনা হয়। শক্তিশালী কাঠের মধ্যে অন্যতম তাল কাঠ। ঘর তৈরিতে এর বিশেষ চাহিদা রয়েছে। কাগজ আবিষ্কারের আগে ভূমিকা রাখত তালগাছ। এ সময়ে তালপাতায় প্রয়োজনীয় কথা লিখে সংরক্ষণ করা হতো। অনেক জাদুঘরে আজও সংরক্ষিত তালপাতার পুঁথি রয়েছে।

পাখির নিরাপদ আশ্রয়

তাল ফল যেমন মানুষের খাবারের চাহিদা মেটায় তেমন এর গাছও মেটায় আমাদের নানান চাহিদা। শুধু মানুষই নানাভাবে উপকৃত হয় না, উপকারে লাগে পাখিদেরও। তাল গাছে বাসা বাঁধে বাবুই পাখি। বাদুড়েরও নিরাপদ আশ্রয় তাল গাছ। এছাড়া বিলুপ্ত প্রায় শকুন, ঈগলও তাল গাছে বাসা বাঁধে। টিয়া পাখি এই গাছে ঘর বাঁধে। রাতের বেলা তাল গাছে এসে বিশ্রাম নেয় ময়ূরও।

উপকারিতা

*   গরমের কারণে আমাদের শরীর ঘেমে অনেক পানি বের হয়ে যায়। তালের শাঁস শরীর ঠান্ডা করে এবং পানীয় অংশ শরীরের পানির ঘাটতি পূরণ করে শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে সাহায্য করে।

*     গরমে পানি শূন্যতার কারণে চুলকানি বা এলার্জির সমস্যা দেখা দিতে পারে। গরমে খাদ্যতালিকায় তালের শাঁস রাখলে এই সমস্যা কমবে।

*    এতে রয়েছে সোডিয়াম এবং পটাশিয়াম, যা শরীরের ইলেকট্রোলাইট ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। ফলে গরমের ক্লান্তি দূর হয় এবং শরীর সতেজ থাকে।

*    গরমের কারণে সানবার্ন হয়, ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়। তাল শাঁসের উপাদানগুলো এ সমস্যা প্রতিরোধ করে।

*    অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ভিটামিন সি থাকায় শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। গরমে শরীর বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। এসব রোগ প্রতিহত হতে পারে তালশাঁস খেলে।

*    এটি খেলে হজমশক্তি বাড়ে। পাকস্থলীর বিভিন্ন সমস্যা প্রতিরোধ হয়। আঁশ সমৃদ্ধ তালশাঁস কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা কমাতে সাহায্য করে। পেটের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানেও কার্যকরী।

*   তাল শাঁস লো-ক্যালরির খাবার। এতে পানি ও ফাইবার থাকায় পেট ভরিয়ে রাখে এবং ক্ষুধাভাব কমায়। এভাবে এটি ওজন কমাতে সাহায্য করে।

*    তাল শাঁস খেলে মুখের অরুচি এবং বমি বমি ভাব দূর হয়।

*    তাল শাঁসে থাকা ক্যালসিয়াস, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস দাঁত ও হাড়ের গঠন মজবুত করে এবং চোখের বিভিন্ন সমস্যা যেমন চোখের অ্যালার্জি, পানি পড়া ইত্যাদি রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।

*    পর্যাপ্ত পরিমাণ আয়রন থাকায় তাল শাঁস রক্তশূন্যতা দূর করতে পারে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এটি খেলে শরীরে নাইট্রেটের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে প্রাকৃতিকভাবে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ হয়।

*   তাল শাঁস লিভারের সুরক্ষায় কাজ করে। এটি লিভার থেকে ক্ষতিকর ও দূষিত পদার্থ বের করতে ভূমিকা রাখে।

*   তাল শাঁস খেলে স্মৃতিশক্তি ভালো হয়, দৃষ্টিশক্তি ভালো থাকে।

*    চুল পড়া রোধ করে চুলের মসৃণতা বাড়াতেও সাহায্য করে তাল শাঁসের পুষ্টি উপাদানগুলো।

বিলুপ্তপ্রায়

একটা সময় মাঠে-ঘাটে বাড়িতে অসংখ্য তাল গাছ দেখা গেলেও এখনকার চিত্র একেবারেই ভিন্ন। দিন দিন তাল গাছের সংখ্যা কমছে। ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে। বাড়ছে বজ্রপাত। তাল গাছ লাগানোর লোকের যেমন অভাব তেমনই তাল গাছ থেকে রস পাড়া কিংবা তাল পাড়ার লোকেরও বেশ অভাব। একই অবস্থা দেখা যায় অন্য দেশেও। এক সময় তামিলনাড়ুতে ৫০ কোটিরও বেশি তাল গাছ ছিল। তবে কমতে কমতে তা এখন ৫ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন তাল বিলুপ্ত ফল হিসেবে বিবেচনা করা হবে।

সতর্কতা

তাল শাঁস নিঃসন্দেহে উপকারী। তবে তা অতিরিক্ত খাওয়া হলে পেট গরম হয়ে পেট ব্যাথা, বমি ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই অতিরিক্ত খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।

যাদের কিডনির সমস্যা আছে তারা তাল শাঁস খেলে শরীরে পটাশিয়াম বেড়ে যেতে পারে। তাই কিডনি রোগীরা খেতে চাইলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নেবেন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে হবে ক্লিক করুন: খাদ্য কথন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

eleven + 7 =