নজরুলের গানে বর্ষা

রোজ অ্যাডেনিয়াম

সাহিত্যের প্রায় সকল শাখাতেই সোনা ফলিয়েছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সংগীতেও তিনি অনবদ্য। নিজের গান নিয়ে ভীষণ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। গানের প্রতি ছিল অন্যরকম এক মায়া। তাই নজরুল গেয়েছেন, ‘আমায় নহে গো ভালোবাসো শুধু ভালোবাসো মোর গান’। কাজী নজরুল ইসলামের গানের বিশাল ভান্ডারে লুকিয়ে আছে মণি-মানিক্য। গানের ভাষা ও তালের বৈচিত্র্য এক অনন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে তাঁকে। আমরা এ গদ্যে আলোকপাত করবো নজরুলের বর্ষার গান নিয়ে।

নজরুলের গান ছাড়া যেমন ঈদের খুশি ম্লান, তেমনি তার গান ছাড়া বর্ষা বন্দনাও ফিকে।

বর্ষা ঋতু আসতেই মনে পড়ে নজরুলের গান, ‘বরষা ঐ এলো বরষা, অঝোর ধারায় জল ঝরঝরি অবিরল, ধূসর নীরস ধরা হলো সরসা। ঘন দেয়া দমকে দামিনী চমকে, ঝঞ্ঝার ঝাঁঝর ঝমঝম ঝমকে, মনে পড়ে সুদূর মোর প্রিয়তমকে, মরাল মরালীরে হেরি সহসা।’ নজরুলের এমন অনেক গানেই ধরা দিয়েছে বর্ষাকাল। বর্ষার রূপ ও কবির আবেগ মিলে মিশে একাকার হয়েছে এসব গানে ও সুরে। জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বর্ষাকে বলেছেন ‘বাদলের পরী’। তিনি লিখেছেন, ‘রিমঝিম রিমঝিম ঘন দেয়া বরষে, কাজরি নাচিয়া চল, পুর-নারী হরষে।’

নজরুলের বর্ষা ঋতুর প্রেমের গান

কাজী নজরুল ইসলাম গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত ঋতু নিয়ে প্রচুর গান রচনা করেছেন। ঋতুভিত্তিক গানের সংখ্যা বিচারে নজরুলের গানে বর্ষার গানের আধিক্য রয়েছে। নজরুলের গানে আছে কালীদাসের মেঘদূত, রাধা-কৃষ্ণের কাজুরী কিংবা ঝুলনের আংগিকও। যেমন ‘যাও মেঘদূত দিও প্রিয়ার হাতে, আমার বিরহলিপি লেখা কেয়া-পাতে’ কিংবা ‘শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এলো না, কাজরীর কাজল মেঘ পথ পেল খুঁজিয়া, সেকি ফেরার পথ পেল না মা পেল না’ কিংবা ‘বাঁধলো বাঁধলো ঝুলনিয়া। একই ধাঁচের আরও একটি গান এমন ‘পরদেশী মেঘ যাওরে ফিরে বলিও আমার পরদেশীরে’। নজরুলের বর্ষা ঋতুর গানে প্রেম ফুটে উঠেছে নতুন মাত্রায়। ‘দোলে বন তমালের’, ‘গগনে কৃষ্ণ মেঘ দোলে’, ‘সখী বাঁধো লো বাঁধো’, ‘এলো কৃষ্ণ কানাইয়া’, ‘সোনার হিন্দোলে কিশোর’ এসব গানে বর্ষা আর প্রেম মিলে মিশে একাকার হয়েছে। বর্ষার অনেক গানে নিপুণভাবে প্রিয়ার বর্ণনা দিয়েছেন কবি। কবি বলছেন ‘আমার প্রিয়ার দীর্ঘ নিঃশ্বাসে, থির হয়ে আছে মেঘ যে দেশের আকাশে।’ এছাড়া ‘মেঘ-ঘন-কুন্তলা’ বা ‘কাঁখে বরষা-জলের ঘাগরি’। ‘এলায়ে মেঘ-বেণী, কাল-ফণী, আসিল কি দেব কুমারী’।

এমন অনেক গানে প্রিয়ার কথা বলেছেন কবি। বর্ষার প্রকৃতিতে কবি তার প্রিয়াকে এভাবে খুঁজেছেন ‘কত বরষায় খুঁজেছি তোমায়, তারায় তারায়।’ নজরুল তার গানে এক পল্লী বালিকার ছবি এঁকেছেন এভাবে ‘কাজল বরণ পল্লী মেয়ে, বৃষ্টি ধারায় বেড়ায় নেয়ে, মেঘের পানে চেয়ে একেলা, মেঘলা সকাল বেলা।’

আরও এমন অনেক গানের কথা বলা যেতে পারে। ‘পরদেশী মেঘ যাওরে ফিরে, বলিও আমার পরদেশীরে/সে দেশে যবে বাদল ঝরে, কাঁদে নাকি প্রাণ একেলা ঘরে/বাদল রাতে ডাকিলে পিয়া/উঠে নাকি…হিয়া।’ নজরুলের একটি জনপ্রিয় গান ‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে, বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে…’। গানটি নিয়ে যুগে যুগে উভয় বাংলায় বহু বিখ্যাত চলচ্চিত্রের কাহিনীতে বরষা, বিরহ, প্রেমের আবহ তৈরি করা হয়েছে। জনপ্রিয় সব শিল্পী এ গানে কণ্ঠ দিয়ে আরো বিখ্যাত হয়েছেন।

নজরুলের বর্ষার গানে বিরহ

নজরুলের বর্ষার গানে প্রেমের পাশাপাশি বিরহও ধরা দিয়েছে নানাভাবে। যেমন একটি গান এমন ‘ঝুরিবে পূবালী বায় গহন দূর বনে, রহিবে চাহি তুমি একেলা বাতায়নে।/বিরহী কুহু কেকা গাহিবে নীপ শাখে, যমুনা নদী পাড়ে শুনিবে কে যেন ডাকে।’ এখানে গহন বন, একেলা বাতায়ন, কুহু কেকা, নীপ শাখে ইত্যাদি শব্দের ব্যবহারে প্রেম-প্রিয়া-বিরহ আর বর্ষার এক গভীর ব্যঞ্জনা তৈরি করা হয়েছে। আরেকটি গানে কবি গেয়ে উঠেছেন ‘বাঁধলো বাঁধলো ঝুলনিয়া, নামিল মেঘলা মোর ভাদরিয়া, চল তমাল তলে গাহি কাজরিয়া, চললো গৌরী শ্যামলিয়া’।

বর্ষা, প্রিয়া আর বিরহের দৃশ্য আরও অনেক গানেই এঁকেছেন প্রেমের কবি নজরুল ইসলাম। যেমন ‘অথৈ জলে মাঠঘাট থৈ থৈ, আমার হিয়ার আগুন নিভিল কই?’ কিংবা ‘এসো হে সজল শ্যাম ঘন দেয়া, ফুটাইয়া যূঁথি-কুন্দ-নীপ-কেয়া, বারিধারে এসো চারিধার ভাসায়ে, বিরহী মনে জ্বালায়ে আশা আলেয়া’। আরও ‘কেমনে রাখি আঁখি বারি, এ ভরা ভাদরে আমারই মরা নদী, উথলি উথলি উঠিছে নিরবধি।’

একটি নাতে রাসূল ও শ্রাবণ

কাজী নজরুল ইসলাম বাংলার শ্রাবণকে মিশিয়ে দিয়েছেন আরব-মরুতে। ‘নাম মোহাম্মদ বোল রে মন নাম আহমদ বোল’ এই নাতে রাসুলটির তৃতীয় বা শেষ অন্তরাতে ‘শ্রাবণ’কে এভাবে বাণীতে যুক্ত করেছেন নজরুল ‘যে নাম বাজে মরু-সাহারায়/যে নাম বাজে শ্রাবণ-ধারায়।’

নজরুলের বর্ষার গান

অধ্যাপক ড. মাহফুজ পারভেজ (কবি, গল্পকার ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী) একটি গদ্যে লিখেছেন, কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায়, বর্ষা ঋতু, আষাঢ় এবং শ্রাবণ মাস নিয়ে নজরুলের প্রায় দেড় শতাধিক গান রয়েছে। এর মধ্যে শ্রেণি-বিভাজন রয়েছে। যেমন কাজরী ২৩, কাব্য-গীতি ৪১, রাগপ্রধান ২৪, খেয়াল ২৫, ঠুমরি ২, আধুনিক ২৯, ঝুলন ৪, চৈতী ৩ এবং ৪ খানি হিন্দি গান। পুরো বর্ষা ঋতুর দেড় শতাধিক গানের মধ্যে শ্রাবণ মাস নিয়েই রয়েছে নজরুলের অনবদ্য ৬০টি গান।

শেষকথা

কাজী নজরুলের বর্ষার গান নিয়ে বাংলাদেশের নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে একটি পূর্ণ একটি তালিকা প্রকাশ হয়েছে। সব মিলিয়ে নজরুলের গানের কথা ও সুর দারুণ এক ঘোরের ভেতর বন্দি করে রাখে শ্রোতাদের। প্রকৃতি বদলে যায়। বদলে যায় মানুষের মন। নজরুলের বর্ষার গানের মূল কথা প্রেম ও মানুষ।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

two × five =