নারী উদ্যোক্তা হতে হলে…

নাহিন আশরাফ

অর্থনৈতিকভাবে দেশ ও পরিবারকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য নারীর ভূমিকা শুরু হয়ে গিয়েছে বেশ অনেক আগে থেকেই। একটা সময় ছিল যখন নারীর স্থান মনে করা হতো রান্নাঘর। কিন্তু সেই ধারণা থেকে বের হয়ে নারীরা এখন ঘরে ও বাহিরে উভয় জায়গায় নিজেদের দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। নারীরা শিক্ষিত হয়ে বড়জোর একটি চাকরি করার মধ্যে নিজেকে এখন আর আবদ্ধ রাখেনি। সব ধরনের পেশাতেই তারা পুরুষের সাথে তালে তাল মিলিয়ে কাজ করছে ও নিজেদের দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। নারী যে শুধু বাইরে কাজ করেই তার দিন পার করছে তা নয়, সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে ঘরে ফিরে তার ঘরও সামলাতে হচ্ছে। নিজেকে শিক্ষিত ও দক্ষ করে তোলার পরেও এই সমাজে নারীকে যেকোনো পেশার মধ্যে দিয়ে যেতে হলে নানা ধরনের বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। পুরুষের তুলনায় নারীদের পথটাও যেন কিছুটা কঠিন।

বেশ কয়েক বছর ধরে ‘নারী উদ্যোক্তা’ বিষয়টির সাথে আমরা পরিচিত। নিজে থেকে কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করে নিজের কর্মস্থানের পথ তৈরি করা নারীদের নারী উদ্যোক্তা বলা যায়। অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হওয়া কিংবা কখনো পরিস্থিতি বাধ্য করেছে একজন নারীকে উদ্যোক্তা হতে। নারীরা ব্যবসা করবে একসময়  একথা চিন্তা না করা গেলেও এখন নারীরা দাপটের সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছোট থেকে মাঝারি আকারের উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। এমনও অনেক নারীর উদাহরণ বাংলাদেশে রয়েছে যারা নিজেদের ব্যবসা অনেক বড় অন্যদের কর্মসংস্থান করে দিচ্ছে। শুধু সে নিজে যে স্বাবলম্বী হচ্ছে তা নয় অন্যকেও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করছে। নারীর এই ক্ষমতায়নে সরকার যেমন সহযোগিতা করছে তেমনি সহযোগিতা করছে তাদের পরিবারও। তবে সমাজ যতই এগিয়ে যাক মানুষের চিন্তাধারা ও মানসিকতার যতই পরিবর্তন আসুক নারীর জন্য পথ পাড়ি দেওয়া কষ্টের। নারীর পাশে বন্ধুর মতো কারো সহযোগিতা কিংবা পরিপূর্ণ পরিকল্পনা ছাড়া এ পথ যেন হয়ে ওঠে আরো কঠিন! তবুও নারীরা লড়ে যাচ্ছে যে যার স্থান থেকে।

কথা হয় বেশ কিছু নারী উদ্যোক্তাদের সাথে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ নারী করোনাকালীন সময়ে উদ্যোগ নিয়েছিলেন ব্যবসা শুরু করার। করোনাকালীন সময় ঘরে বসে থাকা কিংবা পরিবারের যার আয়ের উৎস তার চাকরি চলে যাওয়াসহ নানা ধরনের সমস্যায় পড়ে অনেকে নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে বাধ্য হয়েছিলেন। কারো উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসা করে পরিবারের পাশে দাঁড়ানো। আবার কারো বা ইচ্ছা ছিল নিজের অবসর সময় কাটানো। বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে নারীরা উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ শুরু করলেও অনেকে সফলতার মুখও দেখেছে। যারা সফলতার মুখ দেখতে পেরেছে তাদের পথটা খুব সহজ ছিল না। পেরিয়ে আসতে হয়েছে অনেক বাধা ও নিজের পরিচয়ের জন্য করতে হয়েছে সংগ্রাম।

নারীরা এখন ব্যবসা করছে বিভিন্ন জিনিস নিয়ে। তবে করোনাকালীন সময়ে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল হোমমেড ফুড। যেহেতু সে সময়টা বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল এবং করোনায় আক্রান্ত হবার কারণে অনেকে নিজের খাবার নিজে তৈরি করার মতো পরিস্থিতিতে ছিল না তখন অনেকেই এমন সব পেইজ থেকে হোমমেড ফুড অর্ডার করতো। যেহেতু রান্নাবান্না বেশিরভাগ নারীর জীবনের প্রতিদিনের অংশ তাই পরিবারের রান্নার পাশাপাশি কিছু বাড়তি রান্না করে ব্যবসা করার কথা চিন্তা করেছেন অনেকেই। এ ব্যবসা যারা করেছেন করোনাকালীন সময়ে সাড়াও পেয়েছেন ব্যাপক।

এছাড়া নিজের নকশা করা পোষাক, গয়না, জুতা, ব্যাগ ইত্যাদি বিভিন্ন অনুষঙ্গ দিয়ে নারীরা নিজেদের উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ব্যবসা করছে। ক্ষুদ্র থেকে মাঝারি এই নারী উদ্যোক্তাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করছে সোশ্যাল মিডিয়া। ঘরে বসেই তাদের কাস্টমাররা তাদের কাছে অর্ডার দিচ্ছে এবং তারা তাদের কাস্টমারের চাহিদা অনুযায়ী বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছে। বিভিন্ন স্তরের নারী উদ্যোক্তাদের সাথে কথা বলে জানার চেষ্টা করা হয় তাদের এই কাজের সবচেয়ে বড় বাধা কী! বেশিরভাগ নারীর এ প্রশ্নের জবাব থাকে পরিবারের সহযোগিতা ছাড়া যেকোনো কাজ প্রায় অসম্ভব। পরিবারের সহযোগিতা না থাকলে শুধু ব্যবসা কেন চাকরি বা যেকোনো পেশায় কাজ করায় বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। যারা নিজেদের আজ সফল বলে দাবি করছেন তারা বেশিরভাগই নিজেদের ভাগ্যবান বলে মনে করেন। কারণ তারা তাদের পাশে পরিবার কিংবা স্বামীকে পেয়েছিলেন বন্ধুর মতো।

অনেক নারীর স্বপ্ন থাকে চাকরি না করে নিজের একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করা কিংবা নিজের ব্যবসা দাঁড় করানো। নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুললেও কিছু সুবিধা সেখানে রয়েছে চাকরির চেয়ে সেখানে থাকে নিজের স্বাধীনতা। তাই তো অনেক স্বাধীনচেতা নারীরা চাকরির জায়গায় ব্যবসাকে বেছে নিচ্ছেন। কিন্তু নিজেকে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য থাকা প্রয়োজন কিছু গুণাবলী।

পরিশ্রম

পরিশ্রম ছাড়া জীবনের সফলতা অর্জন করা সম্ভব নয়। অনেকে জীবনে সফলতা অর্জন করতে না পারলে দোষারোপ করে নিজের ভাগ্যকে। কিন্তু পরিশ্রম দ্বারা নিজের ভাগ্য ও পরিবর্তন করে নেওয়া সম্ভব। তাই নিজেকে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করতে চাইলে প্রচুর পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকতে হবে।

ধৈর্যধারণ

ধৈর্য সফলতার চাবিকাঠি। বিশেষ করে ব্যবসার ক্ষেত্রে খুব সহজে সফলতার মুখ দেখা যায় না তাই অনেক বেশি সাধনা ও ধৈর্যের মাধ্যমে অর্জন করে নিতে হবে সফলতা।

জ্ঞান অর্জন

নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে অনেক বেশি শিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন তা নয়। কিন্তু বর্তমান যুগে যেকোনো কাজের জন্যই ন্যূনতম সেই বিষয়ে ধারণা, শিক্ষা ও প্রযুক্তিগত শিক্ষা অর্জন করা অবশ্যই জরুরি। তাই যেকোনো ধরনের ব্যবসা শুরু করার আগে সঠিক জ্ঞান অর্জন করে নিতে হবে।

কমিউনিকেশন স্কিল

ব্যবসা করতে চাইলে অবশ্যই নিজের কমিউনিকেশন স্কিল উন্নতি করতে হবে। কারণ ব্যবসার জন্য অনেক মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপন ও নতুন করে সম্পর্ক গড়ার প্রয়োজন হতে পারে। তাছাড়া হুট করে কোনো ব্যবসা শুরু করার আগে যারা এ বিষয়ে দক্ষ তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি করে আলোচনা ও পরামর্শ নিতে হবে। এবং ব্যবসায় যেহেতু কাস্টমার ও গ্রাহকের বিষয় থাকে তাই তাদের সাথেও ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।

নতুনত্ব

একই ধরনের পণ্য নিয়ে হয়তো আরো অনেক মানুষ কাজ করবে কিন্তু কেন একজন ব্যক্তি আপনার থেকেই কিনবে। তাই আপনার পণ্যের মধ্যে থাকতে হবে নতুনত্ব ও বৈচিত্র্য। এবং যে ধরনের পণ্য নিয়ে কাজ করা হোক না কেন তা ভালো মানের হতে হবে। তা না হলে ক্রেতারা কখনোই আর দ্বিতীয়বার সেখানে ফিরে আসবে না।

ব্যর্থতা মেনে নিতে হবে

যেকোনো কাজে ব্যর্থতা থাকবে। তবে ব্যবসার ক্ষেত্রে লাভ-ক্ষতির একটি হিসাব সবসময় থাকে। কোনো মাসে যদি অনেক লাভ হয়, পরবর্তী মাসে আবার ক্ষতি হতে পারে। অনেকেই এই ক্ষতি মেনে নিতে পারে না ও পরবর্তীতে ব্যবসা করা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ব্যবসা করতে হলে সর্বদাই আপনাকে ব্যর্থতার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

বিশ্বাস অর্জন

ব্যবসা করার ক্ষেত্রে অবশ্যই গ্রাহকদের বিশ্বাস ও আস্থার জায়গা অর্জন করতে হবে। তা না হলে ব্যবসা বেশিদিন চালিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। ভালো মানের পণ্য ও ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রাহকের বিশ্বাস ও আস্থার জায়গা অর্জন করে নেওয়া সম্ভব। কখনো যদি পণ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকে তাহলে তা মেনে নিয়ে গ্রাহকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে হবে ক্লিক করুন: ইন্টারপ্রেনিওর

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

8 − four =