মৌ সন্ধ্যা
দেশের নন্দিত অভিনেতা ছিলেন মাসুদ আলী খান। কখনো শিক্ষকের, কখনো বাবার, কখনো দাদুর, কখনো বাড়ির সিনিয়র কর্তা চরিত্রে দর্শক মাতিয়ে রাখতেন তিনি। কখনো গুরু গম্ভীর আবার কখনো মজার সব হাসির চরিত্রেও হাজির হতেন। একজীবন অভিনয়ের সঙ্গেই ছিলেন প্রিয় মানুষটি। মঞ্চ, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র তিন মাধ্যমেই দর্শকের মন জয় করেছেন। অনেক দিন থেকেই অসুস্থ ছিলেন। সম্প্রতি শক্তিমান এ অভিনেতা সবাইকে ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। রঙবেরঙের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই নিবেদন। মাসুদ আলী খান আর কখনই আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন না। তবে তিনি আমাদের মাঝে থেকে যাবে তার কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে।
মাখন-নিজাম থেকে খ্যাতিমান অভিনেতা
মাসুদ আলী খান ১৯২৯ সালের ৬ অক্টোবর মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতায় কিছুকাল পড়াশুনা করেন। এরপর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরে তিনি জগন্নাথ কলেজ এবং স্যার সলিমুল্লাহ কলেজে পড়াশোনা করেছেন। তার বাবা আরশাদ আলী খান ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। তিনি থাকতেন কলকাতায়। তার মায়ের নাম সিতারা খাতুন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে মাসুদ তৃতীয়। খ্যাতিমান এই অভিনেতার ডাক নাম ছিলো মাখন-নিজাম। জানা যায়, তার মা তাকে আদর করে ‘মাখন’ নামে ডাকতেন আর বাবা ডাকতেন ‘নিজাম’ নামে।
মঞ্চেই অভিনয়ে হাতেখড়ি
ব্রিটিশ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ তিন আমলেই অভিনয় করেছেন মাসুদ আলী খান। ছোটবেলাতেই তার অভিনয়ে হাতেখড়ি হয়। ক্লাস টুতে পড়ার সময় স্বরসতী পূজায় ‘রানা প্রতাপ সিং’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। স্কুলে পড়ার দিনগুলোতে বার্ষিক নাটকগুলোতে অভিনয় করতেন। এক সময় কুমিল্লাতে বড় বোনের বাসায় থাকতেন। তখন ভার্নাল থিয়েটারের শাহজাহান নাটকে অভিনয় করেছিলেন। এরপর শুরু হয় ঢাকার জীবন। ঢাকায় আজিমপুরে বড় ভাই মাহবুব আলী খানের সঙ্গে মেসে থাকতেন। পড়াশোনার পাশাপাশি ডাক ও টেলিফোন বিভাগে কাজও পেয়ে যান।
থিয়েটার কর্মী
জগন্নাথ কলেজ থেকে বিএ পাস করেন মাসুদ আলী খান। সেই সময় যুক্ত হন সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘অগ্রণী শিল্পী সংঘ’র সঙ্গে। এরপর ১৯৫৬ সালে যুক্ত হন ঢাকার প্রথম আধুনিক নাট্যদল ‘ড্রামা সার্কেল’-এ। ড্রামা সার্কেলের হয়ে ‘রক্তকরবী’, ‘বহিপীর’, ‘রাজা ও রানী’, ‘ইডিপাস’, ‘আর্মস অ্যান্ড দ্য ম্যান’, ‘দৃষ্টি’সহ অনেক নাটকে অভিনয় করেন তিনি। নব্বইয়ের দশকে দলটি পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার পূর্বপর্যন্ত তার সক্রিয় উপস্থিতি ছিল। অভিনয়ের পাশাপাশি কখনো কখনো নাট্যপরিচালনাও করেছেন তিনি। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংসদের উদ্যোগে বাংলা একাডেমি মঞ্চে তার পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তাসের দেশ’।
ছোটপর্দায় অভিনয়
১৯৬৪ সালে ঢাকায় টেলিভিশন স্থাপিত হওয়ার পর নূরুল মোমেন পরিচালিত নাটক ‘ভাই ভাই সবাই’ দিয়ে ছোট পর্দায় মাসুদ আলী খানের অভিষেক হয়। এরপর অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত আলোচিত নাটকগুলোর মধ্যে আছে ‘কূল নাই কিনার নাই’, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘সুখী মানুষ প্রকল্প’, ‘দিন চলে যায়’, ‘মধুর ঝামেলা’, ‘গুলশান এভিনিউ’, ‘শাদা কালো সোম’, ‘শাপমোচন’, ‘পঞ্চাশ-পঞ্চাশ’, ‘পৌষ ফাগুনের পালা’, ‘প্যাভিলিয়ন’ প্রভৃতি। সব মিলিয়ে পাঁচ দশকের অভিনয় ক্যারিয়ারে প্রায় ৫০০ নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি।
চলচ্চিত্রে অভিনয়
সাদেক খানের ‘নদী ও নারী’ সিনেমা দিয়ে বড় পর্দায় হাতেখড়ি হয় মাসুদ আলী খানের। এই চলচ্চিত্রে নায়ক আসগর চরিত্রে অভিনয় করে সবার নজর কাড়েন। এরপর একের পর এক বৈচিত্র্যময় নানা চরিত্র করে চেনামুখ হয়ে ওঠেন তিনি। তার অভিনীত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হচ্ছে ‘দুই দুয়ারি’, ‘দীপু নাম্বার টু’, ‘মাটির ময়না’ ও ‘মোল্লা বাড়ির বউ’। সর্বশেষ তিনি প্রয়াত খালিদ মাহমুদ মিঠুর নির্দেশনায় ‘জোনাকির আলো’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।
সংসারজীবন
মাসুদ আলী খান ১৯৫৫ সালে বিয়ে করেন তাহমিনা খানকে। তাদের ঘর আলোকিত করে এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে মাহমুদ আলী খান যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। আর মেয়ে নাজমা খান ধানমন্ডির বাসিন্দা। চাকরিজীবনে সরকারের নানা দপ্তরে কাজ করেছেন মাসুদ আলী খান। ১৯৬২ সালে শুরু করেন পর্যটন করপোরেশনের চাকরি। আর ১৯৮৮ সালে সচিব হিসেবে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন আরও এক যুগ। এর পর থেকে অভিনয়ই তার ‘পেশা’।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি
২০২৩ সালে শিল্পকলায় অবদানের জন্য একুশে পদক পান মাসুদ আলী খান। ২০২৪ সালে মেরিল প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কার পান। এছাড়া তিনি টিভি নাটক আর্টিস্ট অ্যান্ড প্লে রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন (টেনাসিনাস) থেকে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ডও পান।
মৃত্যু
মাসুদ আলী খান দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। শারীরিক অসুস্থতার জন্য অনেকবার তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা চলছিল তার। সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ৩১ অক্টোবর ২০২৪ পরপারে পাড়ি জমান তিনি। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর। ১ নভেম্বর ২০২৪ বর্ষীয়ান অভিনেতাকে মানিকগঞ্জের নিজ গ্রামে সমাহিত করা হয়েছে ।
স্মৃতিচারণ
দেশের প্রতিথযশা অভিনেতা মাসুদ আলী খানের মৃত্যুতে শোকার ছায়া পড়ে দেশের মিডিয়া পাড়ায়। শোক প্রকাশ করেছেন তার পথ চলার সঙ্গীরা। প্রয়াত এই অভিনেতাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন তারা। অভিনেতা, নাট্যকার ও নির্মাতা মামুনুর রশীদ বলেন, ‘মাসুদ আলী খানকে শেষবার দেখে এলাম। তিনি বেঁচে নেই, কিন্তু আমি বলব তিনি একটা জীবন্ত ইতিহাস। কারণ তার সৃষ্টিশীলতা, মেধা আরও অনেক বছর অভিনয়প্রেমী মানুষের মনে জীবন্তই থাকবে। খুবই মজার মানুষ ছিলেন মাসুদ ভাই। হাসতে ভালোবাসতেন, হাসাতেও ভালোবাসতেন। একইসঙ্গে আজীবন কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে কাটিয়েছেন। তার এই গুণ সবারই শেখার আছে। তাইতো তিনি চারটি প্রজন্মের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ তৈরি করতে পেরেছিলেন। তিনি আমাদের আগের প্রজন্মের সঙ্গে কাজ করেছেন, আমাদের প্রজন্মের সঙ্গে কাজ করেছেন, আমাদের পরের প্রজন্ম ও একেবারে তরুণ প্রজন্মের সঙ্গেও তিনি কাজ করেছেন।’
একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনেতা আবুল হায়াত বলেন, ‘মাসুদ আলী খান আমাদের নাটকের পথপ্রদর্শক। একজন সুশীল, সজ্জন ভদ্রলোক ছিলেন। ভালো মানুষ তো বটেই। ন্যাচারাল অভিনয়ের স্কুল যদি থাকে, সেই স্কুলের একজন তিনি। খবরটি শোনার পর থেকে খারাপ লাগছে। এক এক করে আমাদের সিনিয়ররা চলে যাচ্ছেন। কষ্ট লাগছে। আমরাও থাকব না। আমাদেরও চলে যেতে হবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম।’ স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘মাসুদ আলী খানের সঙ্গে আমার পরিচয় অনেক অনেক বছর আগে। দেখা হলেই বলতেন, হায়াত কেমন আছ? এখন আর কেউ বলবেন না। তার মুখ থেকে এই ডাকটি মিস করব। আমার বইয়ে তার কথা লেখা আছে। বইটি আগামী সপ্তাহে প্রকাশ হবে। কিন্তু তিনি দেখে যেতে পারলেন না। তার প্রতি শ্রদ্ধা।’
গুণী অভিনেতা তারিক আনাম খান বলেন, ‘অসম্ভব গুণী একজন অভিনেতাকে হারালাম। তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সম্মান। খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তার কাছ থেকে সারাজীবন শিখেছি। মানুষকে সম্মান করতেন। অভিনয় ভালোবাসতেন। সারাজীবন অভিনয় করে গেছেন। সবাইকে আপন করে নেওয়ার মতো বড় মন ছিল তার। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। অভিনয়ে তার অবদান আমরা ভুলব না। অনেক সাড়া জাগানো নাটকের শিল্পী ছিলেন তিনি। সৃষ্টিকর্তা তাকে জান্নাত নসিব করুন। যেখানে আছেন শান্তিতে থাকুন।’
অভিনেত্রী দিলারা জামান বলেন, ‘আমাদের পরম শ্রদ্ধার একজন মানুষ মাসুদ ভাই। উনি আমাদের অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে সিনিয়র ছিলেন। দেশের প্রথম নাটকের দল ড্রামা সার্কেলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। সিনেমাতেও অভিনয় করতেন। তিনি ছিলেন অনুকরণীয়। উনার সঙ্গে আমার অনেক কাজ হয়েছে। বেশির ভাগ সময় তিনি আমার স্বামীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন। কত স্মৃতি আমাদের। ব্যক্তি হিসেবেও তিনি এবং তার স্ত্রী খুব ভালো মানুষ। তাদের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। মাসুদ ভাইয়ের শ্বশুর বাড়িতেও গিয়েছিলাম বেড়াতে। মাসুদ ভাই আমার স্বামীকে ভাই বলতেন, তাই আমাকে ভাবি বলে ডাকতেন। আমি যে কতবার তাকে বলেছি, আমি আপনার কত ছোট, আমাকে কেন ভাবি ডাকেন। তিনি প্রায়ই আমার কাছে খাওয়ার আবদার করতেন। খুব মনে পড়ছে সেসব কথা। তার মৃত্যুর সংবাদটি শুনে থমকে যাই। এক এক করে আমাদের সব সাথিরা চলে যাচ্ছেন। ভাবতেই কষ্ট লাগছে।’
শেষ কথা
মাসুদ আলী খানের মৃত্যু ভাবনা দিয়েই শেষ করা যাক। গত বছর এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘মৃত্যু যথাসময়েই আসবে, এটা নিয়ে অযথা ভেবে মাথা খারাপ করার কোনো মানে হয় না। এখন আহ্বান করছি মৃত্যুর। মনে হয়, দেখলাম তো অনেক, আর কীই-বা দেখার আছে, পাওয়ার আছে। যদিও মানুষ বলে, পাওয়ার আকাক্সক্ষা কখনো শেষ হয় না। আমার তা কখনোই মনে হয় না। যথেষ্ট পেয়েছি। আমি সন্তুষ্ট। জীবন নিয়ে কোনো খেদ নেই আমার।’ ওপারে ভালো থাকুন সবার প্রিয় অভিনেতা।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্মৃতিচারণ