পিংকির কুইন অফ কেক

নাহিন আশরাফ

জন্মদিন যেন কেক ছাড়া কল্পনাই করাই যায় না। শুধু জন্মদিন কেন বিয়ে, বিবাহবার্ষিকী, প্রোমোশন, পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট সকল আয়োজনের সাথে এখন কেক জড়িত। কেক কেটেই এখন যেকোনো আনন্দ উদ্্যাপন শুরু হয়। প্রাচীন গ্রিসে সর্বপ্রথম কেক দেখা যায় বলে ধারণা করা হয়। পরবর্তীতে পুরো পৃথিবীতে কেক একটি জনপ্রিয় খাদ্য হয়ে যায়। এখন বাংলাদেশও কেকের বাজার খুব ভালো। কারণ কেক এখন আর শুধু ইউরোপের না, বাঙালির সাথে জড়িয়ে গেছে।

একটা সময় ছিল যখন কিছু জনপ্রিয় কেকের দোকান থেকে মানুষ কেক কিনত। কিন্তু এখন কেক তৈরি হচ্ছে ঘরে। যাকে বলা হয় হোম মেইড কেক। বেশ কয়েক বছর ধরেই এই হোম মেইড কেক ঢাকা শহরে বেশ জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছে। হোম মেইড কেক নিয়েই কাজ করছেন ঢাকার শান্তা ইসলাম পিংকি। করোনার সময় যখন পুরো পৃথিবী গৃহবন্দী তখন থেকেই তার কেক বানানোর যাত্রা শুরু। রান্নাবান্না করতে ভালোবাসতেন পিংকি। তার হাতের রান্না খেয়ে সকলে অনেক প্রশংসা করতেন। প্রশংসা শুনে খুব উৎসাহ পেতেন নিজের কিছু করার। রান্নাবান্নার উপর কিছু কোর্স করেন তিনি। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে কেক বানানো কখনো শেখেননি। নতুন ধরনের কেক বানাতে ভালোবাসতেন। সেই থেকে পথচলা শুরু তার অনলাইন ভিত্তিক কেকের পেইজ ‘কুইন অফ কেক: পিংকি’।

শান্তা ইসলাম তৈরি করে থাকেন দৃষ্টিনন্দন বিভিন্ন কেক। যা শুধু খেতেই মজা না বরং দেখলে মন জুড়িয়ে যাবে। তিনি নিখুঁতভাবে কেক ডিজাইন করে থাকেন। বিভিন্ন থিমের উপর তিনি কেক তৈরি করেন। যেমন বাচ্চাদের জন্য কার্টুন চরিত্র, মেকআপ প্রেমিদের জন্য মেকআপ টিম, ফুটবল প্রেমিদের জন্য আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল কেক। কাস্টমার যখন যা চাহিদা করে সবই তিনি নিখুঁত হাতে করে দেন। তবে আজকাল দেখা যায় কেক সুন্দর করতে গিয়ে অনেকেই মান ও স্বাদের দিক বিবেচনা করেন না। কিন্তু পিংকি সবসময় খেয়াল রাখেন যাতে কেক দেখতে আকর্ষণীয় হওয়ার পাশাপাশি খেতেও যাতে মজাদার হয়। গ্রাহককে ভালো কিছু দেওয়া তার প্রথম উদ্দেশ্য। তাই তিনি সবসময় খেয়াল রাখেন কোথায় ভালো পণ্য পাওয়া যায়, আরো ভালো মানের কেক তৈরি করা যায়। খুব বেশি ব্যবসা তিনি করেন না। কারণ কেক ভালো না হলে তিনি নিজেই সন্তুষ্ট থাকতে পারেন না। তাই অর্থের চাইতে তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কেক কতটা নিখুঁত হলো।

তিনি সবসময় কেক নিয়ে নানা ধরনের এক্সপেরিমেন্ট করেন। যাতে করে তিনি প্রতিদিন আরো নতুন ধরনের কেক বানাতে পারেন। কেক বানানো একটা শিল্প বলে মনে করেন শান্তা ইসলাম পিংকি। কারণ একটা সময় মানুষ খুব সাদামাটা কেক খেত। কেক খেতে ভালো হলেই হতো। এর আউটলুক নিয়ে কারো মাথা ব্যথা ছিল না। কিন্তু এখন সবাই কেকের আউটলুক নিয়ে বেশ সচেতন। যেকোনো অনুষ্ঠানের থিমের উপর নির্ভর করছে কেক কেমন হবে। গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের কেক একরকম আবার বিবাহবার্ষিকীর কেক আরেক রকম। সবাই চায় এখন কেক যেন ভিন্ন ধরনের হয়। বৈচিত্র্য আনা সহজ কাজ না, করতে হয় সাধনা। অনেক ধৈর্য ও কালার কম্বিনেশন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান নিয়ে একটি কেক তৈরি করতে হয়। তিনি জানান, কেক তৈরি করতে কখন কোন ধরনের কালার ব্যবহার করতে হবে এটি না জানলে কেকের আউটলুক নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আর কেক যদি দেখতে সুন্দর না হয় তাহলে তা খাবার ব্যাপারে মানুষের তেমন আগ্রহ থাকবে না।

শুধুমাত্র নিজের শখ পূরণ করবেন বলেই শান্তা ইসলাম পিংকি কেকের পেইজ খুলেন। কিন্তু ছোটবেলায় ইচ্ছে ছিল অনেক কিছুই হবার। সেই সুযোগ আর হয়ে উঠেনি। উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ছোটবেলার ঘর ছেড়ে চলে আসেন শশুর বাড়ি। বিয়ের কিছুদিন পরেই কোল জুড়ে আসে প্রথম ছেলে সন্তান। তখন তার মনে হয় যে, না পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে হবে। মিরপুর বাংলা কলেজে অনার্সে ভর্তি হন। স্বামী, সংসার ও সন্তান সবকিছু সামলে পড়ালেখাটাও শেষ করেন। ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতেন মডেল হবেন। সে সূত্র ধরেই ২০১৯ সালে “গজঝ টঘওঠঊজঝ ইঅঘএখঅউঊঝঐ” এ অংশগ্রহণ করে সেরা ২০ জনের মধ্যে আসেন তিনি। সর্বগুণে গুণান্বিত বলা যায় তাকে। নিজের বাড়ির ছাদে বাগানও করেন তিনি। একটা সময় অনেক সবজি তিনি ছাদ বাগানে ফলাতেন। কিন্তু দ্বিতীয় সন্তান হবার পর বাগানে আর বেশি সময় দিতে পারতেন না। পিংকি বলেন, বিয়ের পর থেকেই আমার শশুর বাড়ির সকলে ও আমার স্বামী বেশ সহযোগিতা করেছেন। আমার যখন যা ইচ্ছা করে আমি তাই করেছি। কোনোদিন তারা আমাকে বাধা দেননি বরং উৎসাহ দিয়েছেন। জয়েন্ট ফ্যামিলিতে থাকবার সুবাদে যখন ইচ্ছা কাজে যেতে পেরেছি, আমার সন্তানদের শাশুড়ি দেখাশোনা করতেন।

২০২১ সালে তিনি বেশ কয়েকজনকে কেক বানানো শেখান। কিভাবে কাজ করলে ভালো করা যাবে সব কিছুর ব্যাপারে ধারণা দেন। তার মাধ্যমে অনেকে কেক বানিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছে যা তাকে বেশ আনন্দ দেয়। কেকের ব্যবসায় কি ধরনের ঝামেলায় পড়তে হয় জানতে চাইলে পিংকি বলেন, সবচেয়ে বেশি ঝামেলা হয় ডেলিভারি দিতে। কারণ কেক অনেক সংবেদনশীল। খুব সাবধানে এটি নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দিতে হয়। তাই ডেলিভারিতে খুব বেশি টাকা খরচ হয়, যা অনেক সময় কাস্টমারা বুঝতে চায় না। পিংকি এক সময় অনেক বেশি কেকের অর্ডার নিতেন, দিন রাত কাজ করতে করতে তিনি প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি অর্ডার নেওয়া কমিয়ে দেন। যেকোনো অনুষ্ঠানের অত্যন্ত তিনদিন আগে তার কাছে কেকের অর্ডার নিশ্চিত করতে হয়।

সংসার, বাচ্চা সামলে কিভাবে কাজ করেন এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সময় ব্যবস্থাপনা করতে পারলে সব কাজই করা সম্ভব। একটা সময় আমি নিজেও খুব রাত জেগে কাজ করতাম, ফলে প্রায় সময় অসুস্থ হয়ে যেতাম। যা এখন একদমই করি না। রাতে দ্রুত ঘুমিয়ে গিয়ে খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে কাজ শুরু করি। বাচ্চাকে নাস্তা খাইয়ে স্কুলে দিয়ে নিজের পেইজের কাজ করি। এছাড়া আমি নিয়মিত জিম করি, তখন বাচ্চাকে আমার শাশুড়ির কাছে রেখে যায়ই। আমি পরিবারের প্রতিটা মানুষের কাছে খুব কৃতজ্ঞ। কারণ তারা সহযোগিতা না করলে কোনদিনও এতো কিছু সামলানো সম্ভব ছিল না। আমি যখন কেকের অর্ডার নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকি তখন স্বামী বাচ্চাদের খাওয়া দাওয়া এবং স্কুল থেকে নিয়ে আসার সকল দায়িত্ব পালন করেন। স্বামীর সহযোগিতা ছাড়া একটা মেয়ের জীবন অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়ে। স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য একটা মেয়ের পিছনে তার স্বামীর সহযোগিতা অনেক বেশি প্রয়োজন।

যারা কেক নিয়ে কাজ করতে চান তাদের উদ্দেশ্য শান্তা ইসলাম পিংকি বলেন, প্রথমে পণ্য সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকতে হবে। ক্রিয়েটিভিটি না থাকলে হোমমেইড কেক বানানোর ব্যবসায় না আসাই ভালো। কারণ একটি কেকের নকশা তৈরি করা বেশ কষ্টসাধ্য। এবং অনেক বেশি ধৈর্য থাকতে হবে। কেকের টেস্ট যাতে ভালো থাকে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ অনেকে কেক আকর্ষণীয় করতে গিয়ে টেস্টের ব্যাপারে আপোষ করে ফেলে।

চকলেট স্পঞ্জ কেক

উপকরণ

ময়দা ১ কাপ, কর্নফ্লাওয়ার ২ টেবিল চামচ, কোকো পাউডার ২ টেবিল চামচ, ডিম ৪টি, পাউডার সুগার ১ কাপ, তেল/বাটার ১/৪ কাপ, দুধ ১/৪ কাপ, ভ্যানিলা পাউডার ১ চা চামচ, বেকিং পাউডার ১ চা চামচ।

প্রণালি

ডিমের সাদা অংশ বিট করুন আর ৩ বারে পাউডার সুগার দিন। স্টিফ পিক হবে। এবার কুসুম দিয়ে ১০ সেকেন্ড বিট করুন। ময়দা, তেল, দুধ ৩ বারে পর্যায়ক্রমে বিট করা ডিমের সাথে মেশান ১৬০ ডিগ্রি প্রিহিটেড ওভেনে ৩৫/৪০ মিনিট বেক করুন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ইন্টারপ্রেনিওর

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

18 − two =