প্রিন্সেস ডায়ানা অফ ওয়েলস…

নাহিন আশরাফ

১৯৬১ সালে রাজ পরিবারের সাথে সম্পর্কিত এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ডায়ানা। তার বাবা অ্যাডওয়ার্ড স্পেন্সার ছিলেন রাজা চার্লস দ্বিতীয়র বংশধর। মাফ্রান্সিস ভিসকাউটেস অ্যালথর্প একজন মার্কিন বংশদ্ভূত রাজ পরিবারের সদস্য। ১৯৮১ সালে ডায়ানা প্রিন্স চার্লসকে বিয়ে করেন। তখন চার্লস তার থেকে ১৩ বছরের বড়। প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ তাদের রাজকীয় বিয়ের অনুষ্ঠান উপভোগ করেছিল। ডায়ানা ১৯৮১ সালে রাজপুত্র চার্লসকে বিয়ে করে ‘প্রিন্সেস ডায়ানা অফ ওয়েলস’ উপাধি গ্রহণ করেন। তার গর্ভেই এসেছেন ব্রিটিশ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী প্রিন্স উইলিয়াম ও প্রিন্স হ্যারি। ডায়ানা যখন খুব ছোট তখনি তার বাবা মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। তখন সে তার দুইভাইসহ তার বাবার কাছে থাকতেন। যখন হবু স্বামী রাজপুত্র চার্লসের সাথে তার পরিচয় হয়, তখন ডায়ানা লন্ডনে একটি নার্সারি স্কুলের খণ্ডকালীন সহকারী শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু খুব বেশিদিন তার সাথে সংসার করতে পারেননি প্রিন্সেস ডায়ানা। ১৯৯২ সালে প্রিন্স চার্লসের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তার।

লেডি ডায়ানার চার্লসের সঙ্গে প্রথম দেখা হয় ১৯৭৭ সালে। যখন ডায়ানার বয়স মাত্র ১৬ বছর। তখন প্রিন্স চার্লস ডায়ানার বড় বোন লেডি সারাহ’র সঙ্গে ডেট করছিলেন। এর কিছুদিন পরই একটি সপ্তাহান্তিক গ্রীষ্ম অবকাশে অতিথি হিসেবে এসেছিলেন চার্লস ডায়ানা দুজনই। সেই দেখাতেই চার্লস ডায়ানাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। ডায়ানাকেই রাজপরিবারের রাজবধূ করে নেওয়ার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি নেন। চার্লসের এই ভালো লাগার পরিণতিই বোধহয় ডায়ানাকে এনে দেয় হাজার হাজার মানুষের ভালোবাসা। চার্লস-ডায়ানা বিবাহিত জীবনের শুরুর মিষ্টি দিনগুলো কাটে কেসিংটন প্যালেস এবং হাইগ্রোড হাউসে। প্রিন্সেস ডায়ানার প্রথম গর্ভধারনের কথা প্রকাশ হয় ১৯৮১ সালের ৫ নভেম্বর। ১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসে গর্ভধারণের ঠিক ১২ সপ্তাহের মাথায় ডায়ানা নিজ বাসস্থানের সিঁড়ি থেকে পড়ে যান। এতে ডায়ানা প্রচণ্ড আঘাত পেলেও ভ্রুণ ছিল আনইনজুরড। তবে পরবর্তীতে ডায়ানা স্বীকার করেন তিনি এই কাজটা স্বেচ্ছায় করেছিলেন। কারণ হিসেবে জানা যায় ডায়ানা নিজে ওই সময়টায় খানিকটা উপেক্ষিত অনুভব করছিলেন এই সত্যি প্রমাণের জন্যই তিনি কাজটি করেছেন।

ডায়ানা ছিলেন এমন অদ্ভুত এবং খানিকটা একগুঁয়ে স্বভাবের একজন মানুষ। নিজেকে অবহেলার পাত্র হিসেবে মেনে নিতে পারতেন না কখনোই। তখনকার সময়ের চিরচেনা ডায়ানার আধুনিকতা আজো সারা বিশ্বজুড়ে অসংখ্য মানুষের মুগ্ধতা। অত্যন্ত আধুনিক এই রাজবধূ ছিলেন সেসময়ে সবচেয়ে জনপ্রিয়। এমনকি ডায়ানার জনপ্রিয়তা ছাড়িয়ে গিয়েছিল প্রিন্স চার্লসের চেয়েও। ডায়ানা জনপ্রিয় ছিলেন সাধারণ মানুষের কাছে। যাদের কাছে গেলে ডায়ানা তাদের সঙ্গে মিশে যেতেন সহজে। এই সহজতর সম্পর্কই ডায়ানাকে বিখ্যাত করে তুলেছিল পৃথিবীব্যাপী।

১৯৮২ সালের ২১ জুন চার্লস-ডায়ানার প্রথম সন্তান প্রিন্স উইলিয়ামের জন্ম হয়। এর দুবছর পর জন্ম প্রিন্স হ্যারির, ১৯৮৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। কিন্তু চার্লস বরাবরই ডায়ানার কাছে একটা রাজকন্যা চাইতেন। কিন্তু ডায়ানা ততোদিনে জেনে গিয়েছিলেন তার গর্ভের সন্তান উইলিয়ামের মতোই আরো একটি ছেলে সন্তান। তবে ডায়ানা এ সম্বন্ধে রাজপরিবারের কাউকে কিছু জানাননি। এমনকি প্রিন্স অব ওয়েলসকেও না। পরবর্তীতে হ্যারির জন্ম চার্লসকে খুব একটা সুখকর অনুভূতি দেয়নি। ডায়ানার অটোগ্রাফিতে বলছিলেন, ‘চার্লস হ্যারিকে দেখে শুকনো মুখে বলছিল ও একদম তোমার মতো দেখতে হয়েছে। এমনকি ওর সোনালি চুলও।’

সেসময় একটি মিথ্যা গুজব ছড়িয়েছিল ডায়ানাকে নিয়ে। হ্যারি ডায়ানা-জেমস হেয়ুইতের ছেলে বলে ভাবছিল অনেকে। তবে কিছুদিন পর তথ্য অনুযায়ী জানা যায় ডায়ানা-হেয়ুইতের প্রেম হয়েছিল হ্যারির জন্মের বেশকিছু দিন পরে।

ডায়ানার কাছে সন্তানদের চাইতে প্রিয় কিছু ছিল না। তিনি বেশিরভাগ সময়টুকুই দিতেন তার দুই ছেলেকে। ডায়ানা বলতেন, ‘আমি আমার সবটুকু দুঃখ, একাকীত্ব ভুলে থাকতাম আমার সন্তানদের দিকে তাকিয়ে।’

বিয়ের ৫ বছরের মাথায় চার্লস ডায়ানা দম্পতির মতের অমিল ও ১৩ বছর বয়সের পার্থক্য খুব প্রকটভাবে দেখা দিতে থাকল। ওই সময়টাতেই চার্লস তার সাবেক প্রেমিকা ক্যামিলা পারকারের সঙ্গে প্রেম শুরু করেন। এবং পরবর্তীতে ডায়ানাও জেমস হেয়ুইতের সঙ্গে প্রেমে জড়ান।

১৯৯৬ সালের ২৮ আগস্ট প্রিন্সেস ডায়ানা এবং প্রিন্স চার্লসের অফিশিয়ালি ডিভোর্স হয়। কিন্তু আলোচনা থেকে তবু ছিটকে যাননি এই আধুনিক রাজবধূ। তার প্রতি কৌতূহল ছিল সেই সময়ের পুরোটা জুড়ে। এমনকি এখনো তাকে নিয়ে আগ্রহের ছিটেফোঁটাও কমেনি ভক্তদের।

তার ব্যক্তিগত জীবন ছাড়াও প্রিন্সেস ডায়ানার ফ্যাশন সেন্স অনেক প্রশংসা পেয়েছিল। সব সময় তাকে বেশ স্টাইলিশ আইকনিক রুপে দেখতে পেতেন ভক্তরা। সে সময় তার মতো স্টাইলিশ ও এমন ফ্যাশন সচেতন মানুষ খুঁজে পাওয়া খুব কষ্টকর করছিল। অনেকে তাকে ‘ফ্যাশন আইডল’ বলতেন। তার বিখ্যাত হেয়ার স্টাইল ও পোশাক অনেকেই অনুসরণ করার চেষ্টা করত। তিনি এত সুন্দরি ছিলেন মেকআপ বা তেমন সাজসজ্জা প্রয়োজন ছিল না। খুব সাধারণ কিছু পরিধান করলেও তাকে অসাধারণ লাগতো।

প্রিন্সেস ডায়না সাজসজ্জা নিয়ে বেশ সচেতন ছিলেন, তিনি জানতেন কি করলে তাকে দেখতে সুন্দর লাগবে। প্রিন্সেস ডায়ানার সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন মেকআপ আর্টিস্ট ম্যারি গ্রিনওয়েল। ডায়ানার বেশ কিছু আইকনিক লুকের কাজ তার হাত দিয়ে হয়েছে। প্রিন্সেস ডায়ানার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল তার চোখ! যেকোনো ছবিতে তার চোখ দুটো উজ্জ্বলতা ছড়াত। এছাড়া তার ত্বক এত বেশি পরিষ্কার ও উজ্জ্বল ছিল যে খুব বেশি মেকআপ প্রয়োজন হতো না। তবে বিশেষ ফটোশুটের সময় তিনি কনসিলার, আই শ্যাডো, মাসকারা এবং অন্যান্য সব ধরনের মেকআপও অনেক সময় ব্যবহার করেছেন। এমন তথ্য মেকআপ আর্টিস্ট ম্যারি গ্রিনওয়েল সংবাদমাধ্যম এবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান।

সুগন্ধির উপর তার অনেক ঝোঁক ছিল। সবসময় সুগন্ধি ব্যবহার করতে ভালোবাসতেন প্রিসেন্স ডায়ানা। কুয়েলকো ফ্লর এল অরিজিনাল, হার্মিস ২৪ ফোবর্গ, এল এয়ার ডু টেম্পস ও ডিওরিসিমো ইত্যাদি সুগন্ধি ব্যবহার করতেন তিনি। বিয়ের দিন তিনি কুয়েলকো ফ্লর এল অরিজিনাল সুগন্ধি ব্যবহার করেছিলেন। ডায়ানা অনেক স্বাস্থ্য সচেতন ছিলেন। তার ত্বক ভালো রাখার জন্য তিনি মেকআপ ও বিভিন্ন স্কিন কেয়ার ছাড়াও খাদ্যাভ্যাস ও ডায়েটের উপর কড়া নজর রাখতেন। সব সময় মেকআপ কিংবা সাজসজ্জায় নতুনত্ব নিয়ে আসতে ভালোবাসতেন। কিন্তু তাকে যেটাতে মানাবে না তিনি কখনোই সেটা করতে না, সব সময় তাকে যেটাতে মানাবে সেদিকে বিশেষ নজর রাখতেন।

ডায়ানার বিয়ের পোশাক নিয়ে রয়েছে নানা ধরনের জল্পনা। আকর্ষণীয় ও বিশ্ববিখ্যাত সেই বিয়েতে ডায়ানার পোশাক নজর কেড়েছিল কোটি কোটি মানুষের। বিয়ের পোশাক নকশা করেছিলেন ডেভিড ও এলিজাবেথ এমানুয়েল। ইতিহাসের পাতায় সবচেয়ে বিখ্যাত পোশাকগুলোর মধ্যে একটি পোশাক হচ্ছে ডায়ানার বিয়ের সেই আকর্ষণীয় পোশাক। বিয়ের পোশাক ছাড়াও তার নিত্যদিনের পোশাকও ছিল অনেক আকর্ষণীয় ও নজরকাড়া। ডায়ানার পোশাক সবচেয়ে বেশি নকশা করেছেন ফরাসি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ডিজাইনার ক্যাথেরিন ওয়াকার। ডায়ানার পুত্রবধূ কেট মিডলটন ডায়ানার ফ্যাশন অনুসরণ করেন।

বিশ্ববিখ্যাত হলেও মানবতার দিকে তিনি ছিলেন অত্যন্ত উদার। সাধারণ মানুষের সাথে খুব অল্প সময় মিশে যাওয়ার অসাধারণ গুণ ছিল তার। বিশেষ করে অসুস্থ ব্যক্তিদের প্রতি ছিল তার আলাদা সহানুভূতি। মানুষের প্রতি এত প্রেম তাকে করেছিল অন্য সবার থেকে ভিন্ন।

১৯৯৭ সালে মধ্য রাতে এক সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে ফ্রান্সের পিটি সালপিত্রিও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। তার মৃত্যু নিয়ে রয়েছে অনেক রহস্য। এটি কি আসলেই দুর্ঘটনা নাকি ছিল কোনো হত্যাকাণ্ড?  শুধু ব্রিটেনের রাজ পরিবারের পুত্রবধূ হিসেবে নয় তার মানুষের প্রতি অসাধারণ ব্যবহার, সৌন্দর্য ও ফ্যাশন সচেতন হওয়ার কারণে মৃত্যুর এত বছর পরেও তিনি ভক্তদের হৃদয় বেঁচে আছেন এখনো।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে হবে ক্লিক করুন: সেলিব্রেটি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

2 × four =