বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও বঙ্গবন্ধু

অনুপম হায়াৎ : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) যেমন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, তেমনি তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের ভিত্তিভূমি ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা’ (বিএফডিসি)র প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৫৭ সালে এই সংস্থা গঠনের মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আধুনিক চলচ্চিত্র শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। এর আগে এই অঞ্চলে চলচ্চিত্র নির্মাণের কোনো স্থায়ী স্টুডিও ছিল না। বঙ্গবন্ধু যখন পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম ও দুর্নীতি দমন মন্ত্রী হন, তখন এদেশের সিনেমা হলে প্রদর্শিত হতো আমেরিকার হলিউড, ফ্রান্স, ব্রিটেন, রাশিয়া, মিশর, ইতালি প্রভৃতি দেশ এবং কলকাতা, মুম্বাই, মাদ্রাজ, করাচি ও লাহোরে নির্মিত বিভিন্ন চলচ্চিত্র। এই অঞ্চলে তখন কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণের সুযোগ-সুবিধা ছিল না। অবশ্য এর আগে ১৯৩১ সালে ঢাকার নবাব পরিবারের উদ্যোগে নির্বাক কাহিনীচিত্র ‘দি লাস্ট কিস’ বা ‘শেষ চুম্বন’ এবং ১৯৫৬ সালে আবদুল জব্বার খানের পরিচালনায় প্রথম সবাক বাংলা কাহিনীচিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ ও কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়। এসব ছিল বিছিন্ন ঘটনা।
১৯৫৩-৫৪ সালে ঢাকায় জনসংযোগ বিভাগের অধীনে একটি চলচ্চিত্র ইউনিট চালু হয়। এজন্য তেজগাঁও বিজি প্রেসের সঙ্গে অস্থায়ী স্টুডিও স্থাপন করা হয়। এই চলচ্চিত্র বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন বেতার ব্যক্তিত্ব নাজীর আহমদ (১৯২৫-১৯৯০)। ১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু হন এই সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম ও দুর্নীতি দমন বিভাগের মন্ত্রী। চলচ্চিত্র ছিল তখন শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন। নাজীর আহমদ ছিলেন চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ। তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে ঢাকায় একটি স্থায়ী আধুনিক ফিল্ম স্টুডিও স্থাপনের দাবি তোলেন। বঙ্গবন্ধু তখন তাঁকে এ সংক্রান্ত কাগজপত্র তৈরির নির্দেশ দেন জরুরি ভিত্তিতে। কারণ, তখন প্রাদেশিক আইন পরিষদের অধিবেশনের শেষ দিন ছিল।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ‘চলচ্চিত্র সংস্থা’ গঠন সংক্রান্ত কাগজপত্র দ্রুত তৈরি করে বঙ্গবন্ধুর কাছে দেন। অবশেষে ১৯৫৭ সালে ৩ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক আইন পরিষদে ‘পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংস্থা’ বিল আকারে পেশ করেন। বিলটি সামান্য সংযোজন-বিয়োজনের পর সর্বসম্মতভাবে আইন পরিষদে পাস হয়। যুগান্তকারী এই বিলের ওপর বঙ্গবন্ধু ছাড়াও পর্যালোচনায় অংশ নেন পরিষদ সদস্য আবদুল মতিন, মো. এমদাদ আলী, মনীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। বিল পাসের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ‘পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা’র চেয়ারম্যান আজগর আলী শাহ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল খায়ের এবং নির্বাহী পরিচালক হন নাজীর আহমদ। সরকারিভাবে এ ধরনের চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠানের জন্ম ছিল পৃথিবীতে প্রথম।
১৯৮৫ সালের ১৬ই জানুয়ারি সচিত্র বাংলাদেশ পত্রিকায় প্রকাশিক এক সাক্ষাৎকারে নাজীর আহমদ এই লেখককে বলেছিলেন:
‘…তাঁর (বঙ্গবন্ধু) উৎসাহ না থাকলে বোধহয় এদেশে এফডিসির জন্ম হতো না। আর জন্ম হলেও হতো অনেক দেরিতে।’
চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা প্রতিষ্ঠার পরপরই বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী থাকাকালে চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নের স্বার্থে অনেকগুলো গঠনমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এসব সিদ্ধান্তের ফলে দ্রুত চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশ সম্ভব হয়, নির্মিত হতে থাকে একের পর এক চলচ্চিত্র, নতুন প্রযোজক-পরিচালক, শিল্পী, কুশলীরা এগিয়ে আসেন নতুন পেশায়, এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানি প্রযোজক-পরিচালকরাও এখানে ছবি নির্মাণ করতে আসে। প্রতিষ্ঠার পর এফডিসিতে কয়েকটি জীবনবাদী ও সৃজনশীল ছবির কাজ শুরু হয়। এসবের মধ্যে ছিল- ফতেহ লোহানীর ‘আসিয়া’, আখতার জং কারদারের (পশ্চিম পাকিস্তান ও যুক্তরাজ্যবাসী) ‘জাগো হুয়া সাভেরা’, মহীউদ্দিনের ‘মাটির পাহাড়’, এহতেশামের ‘এদেশ তোমার আমার’ পশ্চিম পাকিস্তানি জনৈক পরিচালকের ‘হামসফর’।
বঙ্গবন্ধু ওই সময় মহান ভাষা আন্দোলন ও একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণেরও ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি ফতেহ লোহানীকে নির্দেশও দিয়েছিলেন বলে কামাল লোহানী সূত্রে জানা যায়। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিত্বের সময় শুরু হওয়া চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে ‘আসিয়া’ পরে শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি হিসেবে পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট পদক (১৯৬০) পায়। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতায় (১৯৫৯) পায় দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ স্বর্ণ পদক। অন্য ছবিগুলো পায় প্রশংসা। ১৯৫৯ সাল থেকে এফডিসি থেকে নিয়মিতভাবে ছবি মুক্তি পেতে থাকে এবং তা বর্তমানেও অব্যাহত রয়েছে। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল এফডিসি প্রতিষ্ঠার দিনটির স্মরণে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার ২০১২ সালে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
দুই.
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। বঙ্গবন্ধু সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও ষড়যন্ত্রকারীরা বেছে নেয় অগণতান্ত্রিক ও নৃশংসতার পথ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তারা আক্রমণ চালায় নিরীহ বাঙালির ওপর। ২৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে। অতঃপর অব্যাহত বিশ্বজনমতের চাপে বাঙালির মরণপণ মুক্তিযুদ্ধ ও দাবির মুখে বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ফিরে আসেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে। বঙ্গবন্ধু ও বাঙালির এই সংগ্রাম মুখর ঘটনাবলি ১৯৭০ সালের নির্বাচন থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত বিধৃত হয়ে আছে দেশি-বিদেশি মুভি ক্যামেরায়। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা, প্রতিবাদ, জনসভা, সংবর্ধনা, অসহযোগ আন্দোলন, সাক্ষাৎকার, ৭ মার্চের ভাষণ চলচ্চিত্রের উপাদান হয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়েছে। পরবর্তীতে তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্রে এসব ব্যবহƒত হয়েছে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সপরিবারে নিহত হওয়ার দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ও চলচ্চিত্র নানা আলোকে উদ্ভাসিত। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় চলচ্চিত্র নতুন করে ভিত্তি ও ব্যঞ্জনা পায়। এসময় বাড়তে থাকে নতুন চলচ্চিত্রের সংখ্যা। নির্মিত হতে থাকে নব্যধারা ও মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র, সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্র, অসাম্প্রদায়িক চেতনার চলচ্চিত্র। অন্যদিকে পুনর্গঠিত হয় এফডিসি, সেন্সর বোর্ড, ডিএফপি, গণযোগাযোগ অধিদপ্তর, বিটিভি, সংযোজিত হয় সেন্সর নীতিমালা, গঠিত হয় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট, প্রচেষ্টা চলে ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও আর্কাইভ প্রতিষ্ঠার, বিদেশে প্রেরিত হয় চিত্র প্রতিনিধি দল, বিদেশি মেলায় ও প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, দেশে অনুষ্ঠিত হয় বিদেশি চিত্র মেলা, চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়, নতুন প্রযোজক-পরিচালক-শিল্পী-কুশলীরা এগিয়ে আসেন এই পেশায়।
বঙ্গবন্ধুর আমলে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নবতম সংযোজন হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই যাত্রা শুরু হয়। ১৯৭২ সাল থেকে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাহিনীচিত্র নির্মাণ। এসবের মধ্যে রয়েছে- ওরা ১১ জন (১৯৭২), অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী (১৯৭২), রক্তাক্ত বাংলা (১৯৭২), বাঘা বাঙালি (১৯৭২), ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩), আমার জš§ভূমি (১৯৭৩), আবার তোরা মানুষ হ (১৯৭৩), আলোর মিছিল (১৯৭৪), সংগ্রাম (১৯৭৪)।
‘সংগ্রাম’ ছবিতে বঙ্গবন্ধুকে দেখা যায়। সে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। অন্যদিকে মুক্তি পায় ‘জয়বাংলা’ (১৯৭২)। এছাড়া তাঁর আমলে নির্মিত হয় কালজয়ী উপন্যাসভিত্তিক ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ (১৯৭৩), ‘ঈশা খা’ (১৯৭৪), ‘লালন ফকির’ (১৯৭২) এবং আরো বহু রুচিশীল চলচ্চিত্র। অন্যদিকে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর থেকে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও সমাজগঠনমূলক বিষয়ে অনেক প্রামাণ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্যচিত্র নির্মিত হয়। তিনি দেশীয় চলচ্চিত্রের স্বার্থে ভারতীয় ছবির আমদানি ও প্রদর্শন বন্ধ করেছিলেন।
পরিশেষে এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বঙ্গবন্ধু সেই পাকিস্তান আমলে চলচ্চিত্রের গুরুত্ব অনুধাবন করে ‘চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা’ গঠন করেছিলেন আর ১৯৭৪ সালে তথ্য ও বেতার প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দীন ঠাকুরকে ভারতে পুনায় পাঠিয়েছিলেন বাংলাদেশে ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও আর্কাইভ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তথ্য ও জ্ঞান লাভের জন্য। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এক হয়ে আছে। এ ব্যাপারে আরো বিস্তারিত গবেষণা হতে পারে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

18 − one =