শিমুল মুস্তাফা কণ্ঠই যার পরিচয়

মাসুম আওয়াল

দেশের আবৃত্তিশিল্প নিয়ে কথা বলতে গেলে সবার আগে যে নামটি সামনে চলে আসে তিনি হলেন শিমুল মুস্তাফা। দরাজ কণ্ঠই তার পরিচয় বলে দেয়। অতি সাধারণ কথামালাও তার কণ্ঠে ভিন্নমাত্রা পেয়ে যায়। শিমুল মুস্তাফা আবৃত্তিকে পেশা নয়, নেশা হিসেবেই নিয়েছেন। আশির দশকের গোড়ার দিক থেকেই জড়িয়ে পড়েন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে। কণ্ঠে আওয়াজ তোলেন। তার কণ্ঠ আজও ভয়হীন। শিল্প তার কাছে প্রার্থনা। আবৃত্তি তার মাধ্যম। এখন পর্যন্ত ৪০টি আবৃত্তির অ্যালবাম প্রকাশ হয়েছে। জেনে নেওয়া যাক এই গুণী মানুষটির জীবনের কিছু কথা।

রাজধানীতেই বেড়ে ওঠা

শিমুল মুস্তাফার জন্ম ১৭ অক্টোবর ১৯৬৪ ঢাকায়। বাবা প্রয়াত খান মোহম্মদ গোলাম মুস্তাফা ও মা আফরোজ মুস্তাফা। মা ও বাবা দু’জনই ছিলেন শিল্পমনা মানুষ। পরিবার থেকেই তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছেন। কবিতা ভালোবাসতেন ছোটবেলা থেকেই তাই শিল্প হিসেবে তিনি বেছে নেন কবিতা আবৃত্তিকে। শিমুল মুস্তাফা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল ও পরিবেশ বিষয়ে মাস্টার্স করেছেন।

মজার শৈশব

শিমুল মুস্তাফার বাবা প্রয়াত খান মোহম্মদ গোলাম মুস্তাফা এবং মা আফরোজ মুস্তাফা দুজনেই ছিলেন চারুকলার মানুষ। তাদের ভালোবাসায় দারুণ এক শৈশব কাটিয়েছেন শিমুল। এক সাক্ষাৎকারে শিমুল মুস্তাফা বলেন, ‘শৈশবে আমি খুব ডানপিটে ছিলাম।  আমার কোনো গোল ছিল না। ইস্কুল জীবনে যখন ক্লাস সেভেনে উঠেছি; জীবনের লক্ষ্য লিখতে দিয়েছিল ক্লাসে। আমি লিখেছিলাম, বড় হয়ে প্লেন হাইজ্যাকার হব। তখন একটা প্লেন হাইজ্যাক হয়েছিল। আমার কাছে খুব থ্রিল মনে হয়েছিল। আমি খেলাধুলা করতে পছন্দ করতাম। আমার বাসার কাছে বিশাল একটা মাঠ ছিল, সেখানে নিয়মিত খেলাধুলা করতাম। আমার বাবা-মা দুজনই স্ট্রাগল করা মানুষ। চাকুরিজীবী মধ্যবিত্ত পরিবার। বাড়িতে পড়াশোনার বেশ কড়াকড়ি ছিল। আমার ভাই-বোন খুব ভালো ছাত্র ছিলেন কিন্তু আমি পড়া-লেখায় ভালো ছিলাম না। বাবা-মা মনে করতেন, ‘একে কোনো রকমে পার করতে পারলেই হবে।’

আশির দশকে পথচলা শুরু

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই আবৃত্তি তার নেশা হয়ে যায়। আশির দশকের শুরুতে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় কবিতা আবৃত্তি এবং থিয়েটার বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সে সময় থেকেই তার আবৃত্তিচর্চার শুরু। একজন আবৃত্তিশিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে তখন থেকেই চেষ্টা করতে থাকেন। এরপর ধীরে ধীরে তিনি পরিচিত হন। বর্তমানে তিনি এদেশের একজন জনপ্রিয় আবৃত্তিকার।

আবৃত্তিই যখন আন্দোলনের হাতিয়ার

আবৃত্তির মধ্য দিয়েই বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন করেছেন শিমুল মুস্তাফা। তার কণ্ঠ আর কবিতার বাণীই হয়ে উঠেছে আন্দোলনের হাতিয়ার। আবৃত্তিতে তৈরি করেছেন নিজস্ব ঢঙ। এটাই তাকে নিয়ে পৌঁছে দিয়েছে অগণিত মানুষের কাছে। কবিতা ভালোবেসেই পড়েন শিমুল মুস্তাফা। যা পড়েন তা মনে-প্রাণে বিশ্বাসও করেন। তার আদর্শের সাথে মেলে না, এমন কবিতা তিনি পড়েন না। স্বাধীনতা, মূল্যবোধ আর দেশপ্রেমের কবিতায় তার দৃপ্ত উচ্চারণ অনুরণিত করে সর্বস্তরের শিল্পপ্রেমীদের।

কবিতা ও আবৃত্তি শিল্প

সাহিত্যেও একটি বড় মাধ্যম হলো কবিতা। কিন্তু কবিতা আবৃত্তি কী শিল্প? কবিতা ও আবৃত্তির সঙ্গে ঠিক সম্পর্কটা কী? এই বিষয়ে শিমুল মুস্তাফা বলেন, ‘কবিতা এবং আবৃত্তির সম্পর্ক অনেকটা মা-মাসির মতো। কবিতা জন্ম দেন কবি, তিনি মা। আর আবৃত্তিকাররা কবিতার মাসি অন্তত। জনক না হলেও স্নেহের জায়গাটা, প্রেমের জায়গাটা, আন্তরিকতার জায়গাটা, লালনের জায়গাটা একজন আবৃত্তিকারের কিন্তু কোনো অংশেই কম নয়। কবিতা মানুষের বোধের জায়গা তৈরি করে, মানুষকে উপলব্ধি করার জায়গা তৈরি করে। আমি কবিতাকে এভাবেই ধারণ করি।’

শিমুল মুস্তাফা সম্পাদিত বই

শিমুল মুস্তাফা বেশকিছু আবৃত্তি যোগ্য কবিতা সংকলন সম্পাদনা করেছেন। তার সম্পাদিত বই ‘শব্দরা কথা বলে: আবৃত্তির কবিতা ১’, ‘শব্দরা কথা বলে: আবৃত্তির কবিতা ২’। প্রকাশ করেছে চারুলিপি।  এছাড়া আরও একটি কবিতার সংকলন ‘আপস করিনি কখনোই আমি এই হলো ইতিহাস’। প্রকাশ করেছে কুঁড়েঘর প্রকাশনী।

বাংলাদেশের আবৃত্তিচর্চার পটভূমি

আবৃত্তি চর্চা নিয়ে নানা সময় কথা বলেছেন শিমুল মুস্তফা। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আবৃত্তিচর্চার ব্যাপারটা আসলে স্বাধীনতার আগে থেকেই শুরু হয়; কিন্তু আমি বলবো আবৃত্তির মূল বহিঃপ্রকাশ গোলাম মোস্তফা, ইকবাল বাহার চৌধুরী, হাসান ইমাম এদের হাত ধরে বাংলাদেশে শুরু হয়। এবং স্বাধীনতা পরবর্তী পর্যায়ে আবৃত্তি সেই অর্থে ভূমিকা না রাখলেও মধ্য সত্তরের দিকে কাজী আরিফ, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় প্রবীণ যে আবৃত্তিশিল্পীদের কথা বললাম, তারা মিলে আবার আবৃত্তিচর্চা শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আবৃত্তি বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল। সত্তরের দশকের রাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটের কারণে শিল্প চর্চায়ও একটি ধস নেমে আসে। দুর্ভাগ্য পঁচাত্তর থেকে আশি সাল পর্যন্ত শিল্পকলার প্রত্যেকটি মাধ্যম সেভাবে জেগে উঠতে পারেনি। অনেকটাই আস্থাহীন, হতাশায় পড়ে গিয়েছিল শিল্পীরা। বিগত দু’শ বছরে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় আমরা যেভাবে রুখে দাঁড়িয়েছি; কিন্তু এই পাঁচ বছরে আমাদের সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। একাশির পর আবার নতুন করে প্রেরণা, অনেক সাহস, নতুন উদ্দীপনা, নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে শিল্পকলায় অনেক পরিবর্তন এসে যায়। এবং এরই ধারাবাহিকতায় খুবই সক্রিয় হয়ে ওঠে থিয়েটার এবং সঙ্গে সঙ্গে আবৃত্তি। সেই সময় পথনাটক, মঞ্চনাটক কর্মীরা রাজপথে ছিলেন, তবে নেতৃত্বে ছিল আবৃত্তিশিল্পীরা। এরসঙ্গে কবিরাও সোচ্চার হয়ে ওঠেন। স্বৈরাচারি সরকার হটাতে তারাও উদগ্রিব হয়ে ওঠেন। তারই ফলশ্রুতিতে মধ্য আশিতে তৈরি হয় কবিতা পরিষদ। এবং শুরুতেই তখন বলা হয় যে, শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা। এই কথা প্রথম কবিরাই প্রকাশ করে। এর বছর দুয়ের মধ্যেই শুরু হয়ে যায় আবৃত্তি উৎসব, গঠিত হয় আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ। এ সময় অনেক কবি এবং আবৃত্তিকারকে জেল খাটতে হয়। হুলিয়া চলে আসে। অনেক কবিতা নিষিদ্ধ করা হয়। এ সময় কবিতা এবং আবৃত্তি একই সঙ্গে কাজ করেছে। নব্বইয়ের আন্দোলনের চরম মুহূর্তে প্রেমের কবিতাও প্রতিবাদের কবিতা হয়ে গেল একসময়। আমরা খুব রোমান্টিক কবিতাকেও মানুষের দাবিদাওয়া হিসেবেই তুলে ধরলাম। তখন নিষিদ্ধ ছিল কবিতা পড়া। আমরা কবিতা পড়তে গেলেই পুলিশ ধাওয়া করতো। গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হতো। সেই প্রেক্ষাপটেই আমার জন্ম। স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে করতেই আবৃত্তি করা, আশির দশকের গোড়ার দিক থেকে আমি আন্দোলনে সম্পৃক্ত হই। একানব্বইয়ের পরে আবৃত্তি আস্তে আস্তে সংগঠিত হলো। প্রেমের কবিতা যেভাবে প্রতিবাদের কবিতা হয়ে গিয়েছিল, আস্তে আস্তে তা আবার প্রেমের কবিতা হয়ে উঠল। প্রতিবাদের কবিতাগুলো আমরা ধীরে ধীরে পড়তে ভুলে গেলাম। আমরা আমাদের ক্লান্ত যাত্রার শেষ পরিচ্ছদ – বাহান্ন, একাত্তর, নব্বই এই আন্দোলন করতে করতে খুব ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। নব্বইয়ের পর যখন আমরা আলোর দিশা দেখলাম, তখন আমরা হুড়মুড় করে সেই দিশার দিকে ছুটতে শুরু করলাম। আমাদের অতৃপ্ত বাসনা পূরণের জন্য নেমে পড়লাম। অনেকে ভেবেছে আমাদের আর এভাবে চললে হবে না। তখন অনেকেই আর্থিকভাবে খুব স্বচ্ছল হয়ে উঠল। এর ফলে আমরা শিল্পীরা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলাম। একটি অংশ আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতি চর্চা করতে শুরু করল, আরেকটি অংশ আমরা আগের মতোই রয়ে গেলাম।’

প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

নন্দিত আবৃত্তিশিল্পী শিমুল মুস্তাফা আবৃত্তি প্রশিক্ষক ও সংগঠক হিসেবে কাজ করছেন। পেয়েছেন মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসা এবং বহু পুরস্কার-সম্মাননা। দেশের বাইরেও পেয়েছেন অনেক খ্যাতি। ২০২৪ সালে আবৃত্তির জন্য একুশে পদক পেয়েছেন দেশের জনপ্রিয় বাচিকশিল্পী শিমুল মুস্তাফা। এই পুরস্কার পেয়ে ভীষণ খুশি তিনি। আনন্দে ভেসেছেন তার ভক্তরাও।  একুশে পদক প্রাপ্তির আনন্দ প্রকাশ করে শিমুল বলেন, ‘এটা আমার জন্য সবচেয়ে আনন্দের ও বড় প্রাপ্তি। সেটা যে কারোর জন্যই সম্ভবত। আমিও তার বাইরে নই। পুরস্কারটি পেয়ে খুশি লাগছে। এই প্রাপ্তিতে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।’

তরুণদের উদ্দেশ্যে পরামর্শ

অনেক তরুণ আবৃত্তিশিল্পী স্বপ্ন দেখেন শিমুল মুস্তাফার মতো অনেক বড় মাপের আবৃত্তি শিল্পী হবেন। এক সাক্ষাৎকারে শিমুল মুস্তাফা বলেছিলেন, ‘আবৃত্তি পেশা হিসেবে দাঁড়াবে- এমনটা আমি চাই না। শিল্প যখন পেশা হয়ে যায় তখন শিল্পত্ব হানি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বাংলাদেশে একজন ক্ল্যাসিক্যাল শিল্পী আছেন পণ্ডিত গোলাম মোস্তফা। সংগীতটা তার প্রার্থনার মতো। টেলিভিশনের সামনে আসাটা তার জন্য জরুরি না। প্রার্থনাটা তার জন্য জরুরি। লালন যখন গান করেছেন, তিনি কিন্তু এই চিন্তা করে গান করেননি, যে পরবর্তীতে আরো অনেকে তার গান গাইবে। তিনি তার আত্মতৃপ্তির জন্য গেয়েছেন। সেরকম আবৃত্তি আসলে আত্মতৃপ্তির জন্যই করা উচিত।’

শেষ কথা

এখনো আগের মতই দরাজ কণ্ঠস্ব শিমুল মুস্তাফার। তিনি এখনো দুরন্ত, দুর্নিবার এবং আপোষহীন মানুষ হয়েই শিল্পের পথ পাড়ি দিয়ে চলেছেন। তার এই পথচলা আরও দীপ্তময় হোক।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ব্যক্তিত্ব

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

fifteen + eleven =