সিসিমপুর এখন সিজন ১৬ তে

শবনম শিউলী

প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক পর্যায়ের শিশুদের শেখা আনন্দদায়ক ও উপভোগ্য করার লক্ষ্য নিয়ে ‘সিসিমপুর’ নামের আয়োজনটি শুরু হয়েছিল। দেখতে দেখতে ২০ বছর হয়ে গেল শিশুতোষ এই আয়োজনটির। টেলিভিশনে সিসিমপুরের প্রথম প্রচারের দিন হিসেবে প্রতি বছর ১৫ এপ্রিল তারিখটিকে ‘সিসিমপুর দিবস’ হিসেবে উদ্্যাপন করা হয়। নিউ ইয়র্কভিত্তিক সিসেমি স্ট্রিট নামক শিক্ষামূলক টেলিভিশন-ধারাবাহিকের সহপ্রযোজনা সিসিমপুরের কার্যক্রম বাংলাদেশে পরিচালনা করছে সিসেমি ওয়ার্কশপ, বাংলাদেশ। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করেছে এবং করছে সিসিমপুর। এছাড়া সিসিমপুরের পথচলায় পাশে আছে ইউএসএআইডি, বাংলাদেশ সহ আরও কিছু দাতা সংস্থা।

কবে থেকে চলছে

২০০৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, যাত্রা শুরু করে সিসিমপুর নামের শিশুতোষ এই আয়োজন। এই অনুষ্ঠানটি মূলত টেলিভিশন অনুষ্ঠান সেসামি স্ট্রিট-এর বাংলাদেশি সংস্করণ। এটির নতুন নতুন পর্ব প্রতি শুক্রবার বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠানটি আরটিভি এবং দুরন্ত টিভিতে সম্প্রচার শুরু হয়। প্রথম মৌসুমে সিসিমপুরের মোট ২৬টি পর্ব নির্মিত হয়। দ্বিতীয় মৌসুমে ৩৬টি পর্ব নির্মিত হয়। ইউএসএইড এই অনুষ্ঠানটি নির্মাণে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকে। অনুষ্ঠানটির ১২টি মৌসুমে ৭০০ এরও অধিক পর্ব প্রচারিত হয়েছে। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এর ১৫তম মৌসুম শুরু হয়। ২০২৪ এ এসে শুরু হয় সিজন ১৬।

গল্পে গল্পে শেখানো

সিসিমপুর তার নিজস্ব স্টাইলে গল্পে গল্পে শিশুদের নানা জিনিস শেখায়। যা একটি শিশুর কিছু শেখা ও তার বেড়ে ওঠার জন্য সহায়ক। মুদ্রিত বিভিন্ন উপকরণের মাধ্যমে শিশুকে বর্ণ চেনা, শব্দ থেকে বর্ণ চিহ্নিত করা, বর্ণ দিয়ে শব্দ মেলানো, শব্দ দিয়ে বাক্য তৈরি করতে সাহায্য করে। চারপাশের পরিবেশ থেকে উপকরণ খুঁজে নিয়ে সেগুলোর মাধ্যমে বর্ণ ও শব্দ চিনতে সাহায্য করে। যেমন: বল, ঘর, কলা, আম, টেবিল, ঘড়ি, গরু, গাছ, পাতা, কলম, বই ইত্যাদি শিশুর পরিচিতি বিভিন্ন শব্দ কোন বর্ণ দিয়ে শুরু হয়, তা বিনোদন ও খেলার ছলে শেখানো হয়।

সিসিমপুরের চরিত্রগুলোর মাধ্যমে পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান থেকে বিভিন্ন আকার-আকৃতির নাম, রঙের নাম, গাণিতিক ধারণা ইত্যাদি শেখানো হয়। বাংলাভাষার শুদ্ধ উচ্চারণের বিষয়টিকে সিসিমপুর সবসময়ই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে থাকে।  শিশুরা এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রমিত বাংলা শোনার ও চর্চা করার সুযোগ পায়। আবার একইসাথে বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা, ঐতিহ্য আর জীবনযাপনকেও তুলে ধরা হয়। যাতে করে শিশুরা সমানভাবে আঞ্চলিক ভাষা-সংস্কৃতি এবং ভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতির মানুষের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হয়। কার্টুন চরিত্ররা বিভিন্ন সমস্যায় পড়ে ও নিজেরাই সেখান থেকে সমাধান বের করে ফেলে। এভাবেই শিশুরা নিজের সমস্যা নিজে মোকাবেলা করার শিক্ষা পেয়ে থাকে।

শুধু কার্টুন চরিত্র নয়

শুধু কার্টুন চরিত্ররাই নয় এখানে বিভিন্ন মানুষও আসেন। তারা সিসিমপুরেই থাকেন এবং বিভিন্নভাবে কার্টুন চরিত্রগুলোকে সাহায্য করেন। যেমন লাল মিয়া একজন ডাকপিয়ন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা একটি যুবক ও উদ্যোক্তা মুকুল। সিসিমপুরের স্কুলের শিক্ষক সুমনা। মিষ্টির দোকানদার গুণী ময়রা। সিসিমপুরে একটি গ্রন্থাগার আছে। সেখানে গ্রন্থাগারিক হিসেবে কাজ করে গুণী ময়রার স্ত্রী আশা। গুণী ও আশার একটি ছেলে আছে যার নাম শান্ত। আর সিসিমপুরের একজন ফেরিওয়ালাও আছেন যার নাম বাহাদুর। যেকোনো সমস্যা সমাধান করতে এই চরিত্রগুলো বিভিন্নভাবে কার্টুন চরিত্রগুলোকে সাহায্য করে। এছাড়া তারাও গল্প-কথা-কাজ ও গানের তালে শিশুদের বিভিন্ন জিনিস শেখায়।

নতুন নতুন চরিত্ররা

‘ছন্দে ছন্দে পনেরো এলো – সবাই মিলে এগোই চলো’ সেøাগানে ২০২৩ সালে সিসিমপুরের নতুন সিজন শুরু হয়। নতুন এই মৌসুমে হালুম, টুকটুকি, ইকরি ও শিকু হাজির হয় নতুন নতুন সব গল্প নিয়ে, আর তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় তাদের নতুন বন্ধু জুলিয়া। চরিত্রটি সিসিমপুরে বিশেষ সংযোজন। তার মধ্যে আছে অটিজম বিষয়ক বৈশিষ্ট্য। সিসিমপুরে বাংলাদেশের অটিজমসম্পন্ন শিশুদের প্রতিনিধিত্ব করছে জুলিয়া। শিশুদের সবাইকে সমান ভাবার মনোভাবটা গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে জুলিয়া চরিত্রটির মাধ্যমে। সবাইকে অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং নিজের প্রতি যত্নশীল হওয়া – এই বিষয় দুটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সাজানো হয়েছিল সিসিমপুরের পঞ্চদশ মৌসুম।

এছাড়া মজার মজার গল্পের মাধ্যমে প্রাক-গণিত, প্রাক-পঠন, অটিজম, পুষ্টিকর খাবারের গুরুত্ব, বিশ্লেষণী চিন্তা-ভাবনা, জেন্ডার বিষয়ক প্রচলিত সংস্কার জয় করা এবং ভিন্ন ভিন্ন ভাবপ্রকাশের উপায়কে সম্মান দেখানোর মতো বিষয়গুলোকে তুলে ধরা হয় এই আয়োজনে। সাথে ছিল গণিত, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও বিজ্ঞান নিয়ে দারুণ সব এনিমেশন। আর শিশুদের নিয়ে লাইভ অ্যাকশন ফিল্ম। এছাড়া ‘ইকরির সাথে বর্ণ চেনা’ এবং ‘টুকটুকির সাথে সংখ্যা চেনা’র প্রতিটি পর্বে ইকরি একটি করে বর্ণ এবং টুকটুকি একটি করে সংখ্যা চিনিয়েছে শিশুদের।

কারা এলো এবছর

২০২৪ সালে আবারও সিসিমপুর এসেছে নতুন নতুন গল্প আর এপিসোড নিয়ে। সবাইকে অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং নিজের প্রতি যত্নশীল হওয়ার মতো দুটি বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সাজানো হয়েছে সিসিমপুরের এবারের আয়োজন। এবারে হালুমদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাদের নতুন বন্ধু আমিরা। সে একজন স্বভাবজাত নেতা ও তুমুল আত্মবিশ্বাসী একজন শিশু। বেশির ভাগ সময় সে ক্রাচে ভর দিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর অন্য সময় সে হুইল চেয়ার ব্যবহার করে। এছাড়া থাকছে প্রতিবন্ধী, প্রান্তিক এবং আদিবাসী শিশুরাও। এই সিজনের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য কিছু পর্বে ব্যবহার করা হয়েছে ইশারা ভাষা।

সিসিমপুর পেল পুরস্কার

বিশ্বজুড়ে সমাদৃত ইন্টারন্যাশনাল অ্যানথেম অ্যাওয়ার্ড। ২০২১ সাল থেকে অর্থপূর্ণ কাজের মাধ্যমে সমাজ ও বিশ্বে ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এই পুরস্কার দিচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি অফ ডিজিটাল আর্টস অ্যান্ড সায়েন্স। ২০২৪ সালে এই পুরস্কারটি জিতে নিয়েছে সিসিমপুর। বৈচিত্র্য, সাম্য ও অন্তর্ভুক্তির বার্তার মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখায় সিসিমপুরকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়। ‘ফিল্ম, ভিডিও, টেলিভিশন এবং শো’ ক্যাটাগরিতে সিসিমপুর এ পুরস্কার পায়। এবারের প্রতিযোগিতায় ৪৪টি দেশের প্রায় ২ হাজার অনুষ্ঠান ও কার্যক্রমের মধ্য থেকে বিজয়ী হয় বাংলাদেশের সিসিমপুর। ২০২২ সালে ছোটদের অস্কারখ্যাত কিডস্ক্রিন অ্যাওয়ার্ড জিতেছিল সিসিমপুর। তারও আগে ২০১০ সালে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস ট্রাস্ট পরিচালিত জরিপে শিশুতোষ অনুষ্ঠান হিসেবে সেরা এবং সামগ্রিকভাবে তৃতীয় জনপ্রিয় অনুষ্ঠান নির্বাচিত হয়েছিল শিশুতোষ এই অনুষ্ঠানটি।

বইমেলায় ইকড়ি হালুম

প্রতি বছর বইমেলায় আয়োজন করা হয় শিশু প্রহরের। প্রতি শুক্র আর শনিবার সকাল, বিকাল ও সন্ধ্যায় সিসিমপুরের বিশেষ আয়োজন থাকে শিশুদের জন্য। এখানে একটি স্টেজ থাকে সেখানে নেচে গেয়ে শিশুদের আনন্দ দেয় সিসিমপুরের সদস্যরা। টিভির পর্দায় দেখা ইকরি, হাকুম, টুকটুকি আর শিকু মিলে শিশুদের নানান জিনিস শেখায়। কখনো স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণের গান, কখনো হাত ধোয়া আবার কখনো শরীর চর্চা শেখায় তারা। শিশু প্রহরে সত্যিকারের ইকড়ি, শিকু, হালুম আর টুকটুকিকে দেখে শিশুরা মেতে ওঠে মহানন্দে। তাদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণ। ২০২২ সালে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বই প্রকাশের উদ্যোগ নেয় সিসিমপুর। সিসিমপুরের জনপ্রিয় ১০টি বই ব্রেইল পদ্ধতিতে প্রকাশিত হয় সেবার। সিসিমপুরের জন্য এই ১০টি ব্রেইল বই তৈরি করেছিল স্পর্শ ফাউন্ডেশন।

পর্দা আর বইমেলা ছাপিয়ে

শুধু টিভি পর্দা আর বইমেলাতেই সীমাবদ্ধ নয় সিসিমপুরের আয়োজন। বর্তমানে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার ৫টি উপজেলার ২৫০টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কাজ করছে সিসিমপুর। ইউএসএআইডি, বাংলাদেশের আর্থিক সহযোগিতায় এসব স্কুলের শিশুদের বিশেষ করে প্রান্তিক শিশুদের শেখার দক্ষতা বৃদ্ধি ও স্কুলে বৈষম্যহীন শিশুবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে কাজ করছে। এজন্য স্কুলগুলোর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, স্কুলগুলোতে শিক্ষা উপকরণ প্রদান ও সিসিমপুর পাঠাগার তৈরি, অভিভাবক ও কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করতে অভিভাবক সমাবেশসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করছে সিসিমপুর।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: দিবস

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

16 − fourteen =