ফাহিম মুহাম্মদ রাফিউল ইসলাম: শিশুদের ক্যান্সার রোগ কোনো সাধারণ বিষয় নয়। প্রাপ্ত বয়স্কদের তুলনায় শিশুদের ক্যান্সার কিছুটা ভিন্ন। মূলত জেনেটিক কারণেই শিশুরা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকে। কোষের জিনগত পরিবর্তন, অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধির ফলে শিশুদের ক্যান্সার হতে পারে। সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও শিশুদের ক্যান্সার রোগের প্রকোপ বাড়ছে। শিশুদেরও যে ক্যান্সার হতে পারে, অনেক অভিভাবকের এই ধারণাটাই ছিল না। ভ্রুণ অবস্থায় শিশুরা ক্যান্সার আক্রান্ত হবে এ ধরনের জিন নিয়ে বেড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে সেটা প্রকট আকার ধারণ করে। তবে আশার কথা হচ্ছে, বেশির ভাগ শিশুর ক্যান্সার নিরাময়যোগ্য। যদি সময়মতো অভিজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা উন্নত চিকিৎসা গ্রহণ করা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বে অন্তত তিন লাখ শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। এদের মধ্যে ৮০% শিশুকেই চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা সম্ভব। তবে স্বাস্থ্যসেবার অভাবে নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে ৯০ ভাগ ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুই মারা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, শিশুদের ক্যান্সার বা চাইল্ডহুড ক্যান্সার বলতে ১৮ বছরের কম বয়সীদের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়াকে বোঝায়। শিশুদের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার হারও কম। বিশ্বে ক্যান্সার আক্রান্তদের মধ্যে ০.৫% থেকে ৪.৬% আক্রান্তরা শিশু। জিনগত কারণে অনেক সময় শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এ ধরণের ক্যান্সার সাধারণত জাতিগত ভাবে বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা যায়। জেনেটিক্সের উপর ভিত্তি করে ব্যক্তিভেদে সংবেদনশীলতা ভিন্ন হওয়ার কারণেও এটি হতে পারে। কিছু গবেষণায় জানা যায় যে, হেপাটাইটিস বি, হিউম্যান হার্পিস এবং এইচআইভি ভাইরাসও শিশুদের মধ্যে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
শিশুদের ক্যান্সার বিভিন্ন ধরনের
শিশুদের সাধারণত ব্লাড ক্যান্সার বেশি হয়। তবে লসিকাগ্রন্থি, কিডনি এবং চোখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া শিশুর সংখ্যাও কম নয়। শিশুদের মধ্যে সাধারণ ক্যান্সারের মধ্যে রয়েছে:
লিউকেমিয়া ও লিম্ফোমা (রক্তের ক্যানসার): এটি এক ধরনের ক্যান্সার যা অস্থিমজ্জায় শুরু হয় এবং রক্ত প্রবাহের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এটি আরও দুই প্রকারে বিভক্ত। তীব্র লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া: শ্বেত রক্তকণিকাগুলিকে প্রভাবিত করে এক ধরনের ক্যান্সার। এটি ঘটে যখন অস্থি মজ্জা কোষের ডিএনএতে ত্রুটি থাকে। ২. তীব্র মায়লয়েড লিউকেমিয়া: এক ধরনের ক্যান্সার যা অত্যন্ত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং মায়লয়েড কোষগুলি শ্বেত রক্তকণিকা, প্লেটলেট এবং লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদনে হস্তক্ষেপ করে।
মস্তিষ্ক (মেডুলোব্লাস্টোমা) এবং কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের টিউমার: এই টিউমারগুলি শরীরের মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ড (মেরুদণ্ড অঞ্চল) থেকে শুরু হয়। গ্লিওমাস গ্লায়াল কোষে শুরু হওয়া এক ধরনের ক্যান্সার (স্নায়ু কোষের চারপাশে আঠালো সহায়ক কোষ এবং তাদের কাজ করতে সাহায্য করে)।
মেডুলোব্লাস্টোমা: এটি শিশুদের মধ্যে দেখা মস্তিষ্কের ক্যান্সারের সবচেয়ে সাধারণ প্রকার। এটি মস্তিষ্কের নিচের অংশে শুরু হওয়া একটি টিউমার, যা সেরিবেলাম নামে পরিচিত।
নিউরোব্লাস্টোমা: এটি বিশেষ ধরনের স্নায়ুর টিস্যুর একটি ক্যান্সার যা কিডনির চারপাশে পাওয়া যায়।
লিম্ফোমা: এই ধরনের ক্যান্সার লিম্ফোসাইট (এক ধরনের শ্বেত রক্তকণিকা), লিম্ফ নোড এবং অন্যান্য লিম্ফ টিস্যুতে শুরু হয়। লিম্ফোমাস দু ধরনের হতে পারে: ১. হজকিন লিম্ফোমা: একটি নির্দিষ্ট ধরনের অস্বাভাবিক কোষ যা রিড-স্টার্নবার্গ সেল নামে পরিচিত, এই ধরনের লিম্ফোমাতে উপস্থিত থাকে। নন-হজকিন লিম্ফোমা: এই ধরনের লিম্ফোমাতে রিড-স্টার্নবার্গ কোষ ধরা পড়ে না।
উইলমের টিউমার: এটি কিডনির ক্যান্সারের একটি প্রকার।
হাড়ের ক্যান্সার: হাড়ের ক্যান্সারের সবচেয়ে সাধারণ প্রকার হলো: ১. অস্টিওসারকোমা: এটি হাড়ের ক্যান্সারের একটি প্রকার যা সাধারণত লম্বা হাড়গুলিতে দেখা যায় যা পা এবং বাহু তৈরি করে। ২. ইভিং সারকোমা: এই ধরনের হাড়ের ক্যান্সার সাধারণত বাহু, পা এবং শ্রোণির হাড় (পেট বা পেটের নিচের অংশ) থেকে শুরু হয়। ৩. চন্দ্রসার্কোমা: এটি সংযোগকারী টিস্যু এবং পেশির ক্যান্সার যেমন লিগামেন্ট এবং টেন্ডন।
রেটিনোব্লাস্টোমা (চোখের ক্যানসার): এটি রেটিনার একটি ক্যান্সার, যা চোখের পিছনে উপস্থিত আলো-সংবেদনশীল টিস্যু।
শিশুর ক্যানসারের কারণ
শিশুদের ক্যান্সারের সঠিক কারণ অজানা। ক্রমবর্ধমান কোষে কিছু জেনেটিক পরিবর্তনের (মিউটেশন) কারণে শিশুদের ক্যান্সার হতে পারে বলে মনে করা হয়। শিশুর ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বংশগত কারণকেই প্রধান মনে করা হয়। এ কারণগুলোও রয়েছে: বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ, অভিভাবকের ধূমপানের অভ্যাস, গর্ভকালে মায়ের ভুল খাদ্যাভ্যাস, শিশুর অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, হেপাটাইটিস বি, হিউম্যান হার্পিস এবং এইচআইভি ভাইরাসও শিশুদের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়, ডাউন সিনড্রোম (একটি জেনেটিক ডিসঅর্ডার যা বৌদ্ধিক এবং বিকাশের বিলম্বের কারণ), বিকিরণ এক্সপোজার, নির্দিষ্ট পরিবেশগত রাসায়নিক বা বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শ।
শিশুর ক্যানসারের লক্ষণ
শিশুদের বেশিরভাগ ক্যান্সারেই তেমন কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ থাকে না। যার কারণে দেরিতে শনাক্ত হয়। তবে শিশুদের মধ্যে কিছু লক্ষণ রয়েছে, যা একেবারেই অবজ্ঞা করা উচিত নয়। এগুলোই হতে পারে ক্যানসারের পূর্বলক্ষণ। উপসর্গগুলি ক্যান্সারের ধরনের উপর নির্ভর করে। বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের লক্ষণগুলি হলো: ক্লান্তি, হাড়ের ব্যথা, সংযোগে ব্যথা, রক্তপাত, ফ্যাকাশে চামড়া, জ্বর, ওজন কমা, রক্তপাত, ক্ষত। বমি বমি ভাব, বমি, মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, হাঁটতে অসুবিধা, দিগুন দর্শন, ঝাপসা দৃষ্টি। হাড়ের ব্যথা, পেট ফোলা, জ্বর। ওজন কমা, ক্লান্তি, ঘাম, কুঁচ এবং বগলে বা ঘাড়ে ফুসকুড়ি বা ফুলে যাওয়া লিম্ফ নোড। চোখের অস্বাভাবিক চেহারা, ফ্ল্যাশ ফটোগ্রাফির সময় চোখ লালের পরিবর্তে গোলাপি বা সাদা দেখা যায়।
উপরের লক্ষণগুলো যদি এক মাস বা দু‘মাস থাকে এবং কোনোভাবেই ভালো হচ্ছে না; তখন পরীক্ষা করাতে হবে। তবে পরীক্ষার আগ পর্যন্ত কোনভাবেই নিশ্চিত করে বলা যাবে না যে, আসলে কী কারণে এমন হচ্ছে।
শিশুদের ক্যান্সার নির্ণয়
শারীরিক পরীক্ষা: ডাক্তার প্রথমে রোগীর শারীরিক পরীক্ষা করবেন এবং উপস্থিত লক্ষণগুলি পরীক্ষা করবেন। রোগীর চিকিৎসা ইতিহাস এবং পারিবারিক ইতিহাসও লক্ষ্য করা যায়।
রক্ত পরীক্ষা: রক্তের গুরুত্বপূর্ণ পরামিতিগুলি পরীক্ষা করা হয়। এই পরামিতিগুলির একটি অস্বাভাবিক স্তর, সংক্রমণ বা রোগ নির্দেশ করতে পারে।
বায়োপসি: সন্দেহজনক টিস্যু বৃদ্ধির একটি ছোট অংশ নিয়ে ক্যান্সার কোষ আছে কি না তা পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়।
অস্থিমজ্জা অ্যাসপিরেট: সূচ দিয়ে একটি ছোট পরিমাণ অস্থিমজ্জা নিয়ে পরীক্ষা করা হয়।
কটিদেশীয় পাঞ্চার: একটি সূঁচ দিয়ে মেরুদণ্ডের তরল (মেরুদণ্ড এবং মস্তিষ্কের চারপাশে একটি পরিষ্কার তরল) নিয়ে পরীক্ষা করা হয়।
ইমেজিং পরীক্ষা: এক্স-রে, আল্ট্রাসাউন্ড, সিটি স্ক্যান, এমআরআই স্ক্যান, পিইটি স্ক্যান করে শরীরের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলির ইমেজ পরীক্ষা করা হয়।
শিশুর ক্যানসার প্রতিরোধে করণীয়
অভিভাবকের সচেতনতাই শিশুকে বাঁচাতে পারে ক্যানসার থেকে। পারিবারিক জীবনধারার পাশাপাশি শিশুর জীবনধারায় সাধারণ কিছু পরিবর্তন আনার মাধ্যমে এই ঝুঁকি কমানো সম্ভব। বর্তমানে ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশে প্রায় ১৩ থেকে ১৫ লাখ ক্যান্সার আক্রান্ত শিশু রয়েছে। ২০০৫ সালেই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে শিশু মৃত্যুর হার ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। সচেতন না হলে ২০৩০ সালে এ হার দাঁড়াবে ১৩ শতাংশে। শিশুদের সঠিক চিকিৎসার পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবার যেমন পালং শাক, ব্রকলি, ডিমের কুসুম, মটরশুটি, কলিজা, মুরগির মাংস, কচুশাক, কলা, মিষ্টিআলু, কমলা, শালগম, দুধ, বাঁধাকপি, বরবটি, কাঠবাদামের মতো ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ভিটামিন, মিনারেল এবং আয়রনসমৃদ্ধ খাবার খাওয়াতে হবে। তাজা ফল, সতেজ শাকসবজি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। খেলাধুলা, ছোটখাটো কাজ প্রভৃতির মাধ্যমে ছোটবেলা থেকেই শারীরিক পরিশ্রমের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। সরাসরি সূর্যের আলোতে শিশুকে বেশিক্ষণ থাকতে দেওয়া যাবে না। শিশুকে চর্বিজাতীয় খাবার কম খাওয়ানো, নিয়মিত ব্যায়াম করানো, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। নিজে যেমন ধূমপান বা মদ্যপানের অভ্যাস ত্যাগ করবেন, তেমনি শিশুও যেন এই অভ্যাসে না জড়ায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শিশুকে ছোটবেলাতেই হেপাটাইটিস বি টিকা প্রদান করতে হবে।
শিশুদের ক্যান্সারের চিকিৎসা
শিশুদের ক্যান্সারের জন্য যে ধরনের চিকিৎসা করা হয় তা ক্যান্সারের ধরন, ক্যান্সারের তীব্রতা এবং রোগীর সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উপর নির্ভর করে।
বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি
অস্ত্রোপচার: টিউমার এবং আশেপাশের কিছু টিস্যু অপসারণের জন্য অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচারের লক্ষ্য হলো পুরো টিউমার এবং টিউমারের চারপাশের টিস্যু অপসারণ করা। সুস্থ টিস্যুতে কোনো টিউমার না রেখে।
বিকিরণ থেরাপি: এই পদ্ধতিতে উচ্চ শক্তির এক্স-রে বা প্রোটন ব্যবহার করে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা হয়। কখনও কখনও, অস্ত্রোপচারের পরে রেডিয়েশন থেরাপি করা যেতে পারে। ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য কেমোথেরাপির সাথে রেডিয়েশন থেরাপিও ব্যবহার করা যেতে পারে।
কেমোথেরাপি: এই পদ্ধতিতে ক্যান্সার কোষকে মেরে ফেলার জন্য ওষুধ ব্যবহার করা হয়। টিউমারের কোষগুলি সঙ্কুচিত করার জন্য কখনও কখনও অস্ত্রোপচারের আগে কেমোথেরাপি করা যেতে পারে, যার ফলে সেগুলি সহজেই অপসারণ করা যায়। কেমোথেরাপি অস্ত্রোপচারের পরেও করা যেতে পারে। রেডিয়েশন থেরাপির সাথে কেমোথেরাপি ব্যবহার করা যেতে পারে।
ইমিউনোথেরাপি: এই পদ্ধতি ক্যান্সার কোষ মেরে ফেলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (রোগ-প্রতিরোধ) বাড়ানো হয়।
অস্থি মজ্জা প্রতিস্থাপন/স্টেম সেল প্রতিস্থাপন: এটি ক্যান্সার-আক্রান্ত অস্থিমজ্জার প্রতিস্থাপনের একটি বিশেষ পদ্ধতি, যাকে বলা হয় হেমাটোপয়েটিক স্টেম সেল, যা সুস্থ অস্থিমজ্জায় পরিণত হয়।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং বেসরকারিভাবে কয়েকটি হাসপাতালে বিশেষজ্ঞরা শিশুদের ক্যান্সারের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। শিশুদের ক্যান্সার সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য যদি সঠিক সময়ে, সঠিক নিয়মে, সঠিক চিকিৎসকের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: দিবস