সফল নারী উদ্যোক্তা কুমকুম

জীবনে চলার পথে কত কিছু দেখেছি ভুল করেছি, আবার শিখেছি, আবার ভুল করেছি…এমনিভাবে চলছে জীবন। মাঝে মাঝে মনে হয় জীবন আমাকে চালাচ্ছে, নাকি আমি জীবনকে চালাচ্ছি; শুরুতেই এ কথা বলেন উদ্যোক্তা দেলোয়ারা ইব্রাহিম ফকির। যাকে সবাই কুমকুম নামেই চেনে। তিনি একটি বুটিক হাউজ চালান, পাশাপাশি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা নিয়ে কাজ করছেন। এছাড়া তিনি লেখালেখি করতে ভালোবাসেন। নাহিন আশরাফের প্রতিবেদনে দেলোয়ারা ইব্রাহিম ফকিরের সাথে কথা হয় রঙবেরঙের।

একান্নবর্তী পরিবারে বেড়ে উঠেন দেলোয়ারা ইব্রাহিম ফকির। তারা ছয় বোন ও এক ভাই। একান্নবর্তী পরিবার হবার কারণে বাবা ছাড়া চাচার আদর্শেও তারা বড় হয়েছেন। জীবন ছিল একদম রুটিনের মধ্যে। সকালের নাস্তা খাওয়া থেকে রাতে ঘুমাতে যাওয়া সব হওয়া চাই রুটিন মতো। বাবা কোনো অজুহাতই শুনতেন না। তার মনে পড়ে না কখনও স্কুল মিস করেছেন। ছয় বোন এক ভাইকে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য মা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। কচিকাঁচার কাকলী স্কুলে দেলোয়ারা ইব্রাহিমের শিক্ষাজীবন শুরু। এসএসসি পাস করেন লালমাটিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে। সেখানেই উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক। এরপর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। নিয়ম মানা আর হাসি খেলার মধ্যে দিয়ে শৈশব কৈশোর কেটে যায় তার। মা-বাবার পাশাপাশি চাচাদের ভালোবাসাও পেয়েছেন সমানভাবে। তাই কুমকুমের জীবনের গল্পে বারবারই তাদের নাম এসেছে।

ছোট কুমকুম যখন বড় হয়ে গেলেন, বাবার পছন্দ করা ছেলের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন। কুমকুমের স্বামী আফতাব উদ্দিন আহমদ একজন চিকিৎসক। অল্প বয়সেই বিয়ে হয় তার। বিয়ে মানে জীবনে কিছু নতুন মানুষ ও দায়িত্ব। তবে তার সবসময় ইচ্ছা ছিল নিজে কিছু করবেন। উদ্যোক্তা হবার স্বপ্নটা তার ছোটবেলা থেকেই ছিল। কিছু একটা করার পরিকল্পনা করতে করতে তার কোল জুড়ে দুটি মেয়ে সন্তান এলো। স্বামী সংসার সন্তান সবকিছুতে ব্যস্ত হয়ে গেলেও নিজে কিছু করার ইচ্ছা কমেনি মোটেও। প্রথমে চাকরি করেন একটি কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে। বেশ কিছুদিন পর, ইন্টারভিউ দেন মেধাকুঞ্জ স্কুল অ্যান্ড কলেজে। এছাড়া একটি এনজিওতে ভলেন্টারি কাজ করেন প্রায় এক বছর। শিক্ষক হিসেবে তিনি জীবনে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। প্রতিদিন তিনি নতুন অনেক কিছু শেখেন। যা পরবর্তীতে তার জীবনে কাজে লেগেছে।

কুমকুম সবসময় নিজের ডিজাইন করা পোশাক পরতেন। হঠাৎ তার মনে হলো তিনি যেহেতু পোশাক ডিজাইন করতে পছন্দ করেন, তাহলে এক্সিবিশন করলে কেমন হয়। শুরু হলো এক্সিবিশন, ডিজাইন করা ড্রেস এবং দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করা। প্রথমেই যে তিনি কাজে খুব দক্ষ হয়ে গেছেন এমন না; অনেক কিছু জানতে হয়েছে, শিখতে হয়েছে। অধ্যাবসায় থেকে তিনি ফ্যাশন ডিজাইনিং শিখেছেন, কারণ কাজগুলো দক্ষতার সাথে করতে চেয়েছিলেন। এরপর তিনি ‘ইউনিগুডস’ নামে একটি অনলাইন পেইজ খুলেন। একটা পেইজকে সচল রাখার যা করা দরকার হয় সব করলেন। পাশে পেলেন তার বন্ধু আসমা আজগরকে, যিনি তাকে অনেক কিছুতে সহযোগিতা করেছেন। ধীরে ধীরে ব্যবসার পরিসর বাড়তে থাকে। এরপর নিজের ডিজাইন করা ড্রেস তিনি অস্ট্রেলিয়াতে পাঠান এবং সেখানে বেশ সাড়া পায়। এতে তার উৎসাহ ও উদ্দীপনা বেড়ে যায়। ড্রেসগুলো বিক্রি করে প্রায় ১ লাখ টাকা পান। কিন্তু এইভাবে বিদেশে পোশাক পাঠানো বেশিদিন সম্ভব হয়নি। এরপর মোহাম্মদপুরে তিনি ‘ইউনিগুডস’ নামে একটি শো রুম চালু করেন। বর্তমানে সেটি মিরপুর ডিওএইচএস-এ চালু আছে। ইউনিগুডসের পোশাক বিদেশেও রপ্তানি হয় ।

দেলোয়ারা ইব্রাহিম ফকিরের উদ্যোক্তার গল্প কিন্তু এই বুটিক হাউজে শেষ নয়। তার চাচা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন। তিনি একদিন বললেন, আমি পথশিশুদের জন্য কিছু করতে চাচ্ছি, তাদের শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে চাচ্ছি, তুমি ওদের পড়াতে পারবে? কুমকুম সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলেন। এমন একটি ভালো কাজের সাথে থাকলে তার নিজেরও ভালো লাগবে। তিনি বস্তিতে গিয়ে বাচ্চাদের পড়ালেখার ব্যাপারে আগ্রহী করতেন। নিজের বাসার গ্যারেজে নিয়ে তাদের পড়াতেন। সেই স্কুলের নাম দেওয়া হলো ‘সন্ধানী’। তিনি মেধাকুঞ্জ থেকে যে বেতন পেতেন তার পুরোটা দিয়ে দিতেন বাচ্চাদের খাতা-কলম কিনতে। স্কুলটি ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল। কিন্তু ঢাকার মধ্যে স্কুল চালান সম্ভব ছিল না। তাই স্কুলটি সরিয়ে নেওয়া হয় নারায়ণগঞ্জে। সেই স্কুল চালাচ্ছেন তার চাচাতো বোন। কোভিডের সময় পুরো বিশ্ব আটকে আছে, সেই সময় দেলোয়ারা ইব্রাহিম ফকির অনলাইনে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে লাইভ করেন। উপস্থাপনার দায়িত্ব নিজেই পালন করেছিলেন।

এরপর শুরু হয় জীবনের আরেকটি অধ্যায়, যা তাকে দিয়েছে সম্মান ও নতুন পরিচয়। ‘সুতা কথন’ নামের এক নারী উন্নয়ন সংস্থার অর্গানাইজিং সেক্রেটারি হন। সভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌসের সাথে সুবিধাবঞ্চিত নারী, পথশিশু, আটিস্টিকদের দেশীয় শাড়ি, দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ শুরু করেন। এই সংস্থার মাধ্যমে বহু নারীকে সহযোগিতা করেছেন তারা। যে নারী ভালো সেলাই করতে পারে কিন্তু সেলাই মেশিন কেনার সামর্থ্য নেই, তাকে কিনে দেওয়া হয়েছে সেলাই মেশিন। কিংবা কেউ ভালো কেক বানাতে পারে, তাকে দেয়া হয়েছে ওভেন। যাতে করে নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে।

সম্প্রতি ভারত থেকে ইন্টারন্যাশনাল ইন্দিরা গান্ধী পিসি পুরস্কার পেয়েছেন দেলোয়ারা ইব্রাহিম ফকির। তিনি বলেন, আমরা যারা সমাজে ভালো অবস্থানে আছি, যাদের পরিবারে একটু সচ্ছলতা আছে তারা সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জন্য কিছু একটা করতে পারি। সে ব্যবস্থা সুতাকথন নারী উন্নয়ন সংস্থা করে থাকে। যারা স্বচ্ছল তাদের থেকে অল্প টাকা নিয়ে ফান্ড তৈরি করি। তারপর যে মেয়েটি যে কাজ ভালো পারে সেটি শেখাই এবং আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকি। সচ্ছল পরিবারগুলো যদি এগিয়ে আসে এসব সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জন্য কিছু করা সহজ হয়ে যাবে।

তিনি আরো বলেন, নারীরাই পারে নারীকে সাহায্য করতে। যদি একজন নারীকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলতে পারি সেখানেই আমার সার্থকতা। বর্তমানে অবহেলিত নারীদের সংখ্যা আগের থেকে অনেক কমেছে। সরকারের কাছ থেকে আমরা যদি বঞ্চিতদের জন্য কিছু অনুদান পাই তাহলে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়েতে বেশিদিন সময় লাগবে না।

তিনি সব নারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমার সবসময় একটা কথা মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, শিক্ষামন্ত্রী নারী, তাঁরা যদি দেশ চালাতে পারেন; তাহলে আমরা কেন ঘরে বসে থাকবো? আমরাও পারবো সরকারি অনুদান এবং সচ্ছল পরিবার থেকে কিছু অনুদান নিয়ে সুবিধাবঞ্চিত নারীদের পাশে দাঁড়াতে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ইন্টারপ্রেনিওর

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

9 − two =