সীমিত হলেও ক্রিকেট বাংলাদেশের বড় অর্জন

সালেক সুফী : ৫০ বছর মরণপণ স্বাধীনতা যুদ্ধ, জনযুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাংলাদেশের জীবনে দীর্ঘ একটা সময় না। ঝরাপালকের ধ্বংসস্তুপ থেকে ঘুরে দাঁড়ান বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই কাক্সিক্ষত মাত্রায় বিকশিত হয়নি, হয়তো পায়নি প্রকৃত পেশাদারী অবয়ব। তার্কিকরা বলবেন কিছু খেলা যেমনÑ ফুটবল, হকি, ভলিবল, অ্যাথলেটিক্স, সাঁতার, শুটিং এবং জলক্রীড়ায় সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দ্যুতি ছড়াতে পারে নাই। কারণ হতে পারে সরকারের প্রাধিকারে খেলাধূলা উপেক্ষিত থাকা, সঠিক নীতিমালার আওতায় ব্যাক্তিখাতকে সংযুক্তি করার জন্য উপযোগী নীতি না থাকা। এর মাঝেও ক্রীড়াশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানের ক্রীড়া প্রতিভা গড়ে উঠার জন্য সেনা প্রশাসক প্রয়াত হোসাইন মুহাম্মদ এরশাদকে সাধুবাদ দিতেই হবে। স্বল্প পরিসরে সব খেলাধূলা নিয়ে সার্বিক আলোচনা করা যাবে না। আজকের এই প্রয়াসে শুধু ক্রিকেট নিয়েই লিখছি।
বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানের অংশ তখন ঢাকা ছিল পাকিস্তান ফুটবলের প্রাণকেন্দ্র। অবাঙালি কৃতি ফুটবলার ওমর, মুসা, আবিদ, কালা গফুর, তোরাব আলী, আলী নেয়াজদের পাশাপাশি নবী চৌধুরী, আশরাফ, কবির, মারি, পিন্টু, হাফিজ, প্রতাপ, টিপু ঢাকা মোহামেডান, ওয়ান্ডার্স, ভিক্টোরিয়া, এপিআইডিসিকে এশিয়া মানের পর্যায়ে উন্নীত করেছিল। সেই ধারা ১৯৭০, ১৯৮০, ১৯৯০ পর্যন্ত আবাহনী, ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবগুলোর উন্মেষ ঘটায় কিছুদিনের জন্য আধুনিকায়ন হয়েছিল। এখানে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য পুত্র, বীর মরহুম শেখ কামালের অবদানকে অস্বীকার করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধা কিন্তু সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাব এবং অনেকে বলবে ভ্রান্ত নীতির কারণে ফুটবল অনেকটা অন্তসার শূন্য হয়ে গেছে। একই অবস্থা এখন স্বভাবনাময় হকি, এথেলেটিক্সের মতো ফিল্ড গেমসগুলোতে। রাজনীতি, দুর্বৃত্তায়ন তরুণ সমাজকে ক্রীড়াবিমুখ করে ড্রাগস, মাদকের দিকে ধাবিত করছে।
একমাত্র ব্যতিক্রম ক্রিকেট। ভীরু পায়ে শুরু করে ১৯৭০ দশকের মাঝামাঝি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রবেশ করে বাংলাদেশ ক্রিকেট এখন সব ফরম্যাটে সেরা ১০টি দলের একটি। হয়তো এখানেও অপূর্ণতা আছে। প্রত্যাশা আর প্রপ্তির বিস্তর ব্যবধান। কিন্তু অনুর্ধ্ব ১৯ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, নারী ক্রিকেটে এশিয়া সেরা, ক্রিকেট বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল, টি২০ বিশ্বকাপ সেমি ফাইনাল, এশিয়া কাপ ফাইনাল খেলাÑ যে কোনো পরিমাপে বিশাল অর্জন। মাশরাফি, শাকিব, মুশফিক, তামিম, মাহমুদুল্লার হাত ধরে টিম টাইগার্সরা এখন প্রবাসী বাংলাদেশিদের গর্বের উপকরণ। ১৭ কোটি গুণমুগ্ধ বাংলাদেশিদের প্রাণের স্পন্দন।
বাংলাদেশ ক্রিকেটকে এই পর্যায়ে উপনীত করার জন্য সর্বজনাব দামাল ভাই, পল্টু ভাই, রইস ভাই, রেজা ভাই, সিজার ভাই, মাখন ভাই, বাহাউদ্দিন, সাবের চৌধুরী, আশরাফুল হক, তানভীর মাজহার তান্না, আমিনুল হক মনিদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হবে। একইভাবে স্মরণ করতে হবে বদরুল হুদা চৌধুরী, মিন্টু ভাই, হামিদ ভাই, কামরুজ্জামান, আতাউল হক মল্লিক, খোদা বক্স, বজলু ভাই, আলতাফ ভাই, সালাম ভাই, চাদ খান, জালাল চৌধুরীদের পরবর্তী প্রজন্ম ফাহিম, ইমরান, সালাহউদ্দিন, ওয়াহিদুল গনি, দীপু রায় চৌধুরীদের। একসময় শত বাধা, সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সাহসে বুক বেঁধে শামীম কবির, রকিবুল হাসান, হীরা, দৌলত, ইউসুফ বাবু, ওমর খালেদ, নজরুল কাদের, বাদশা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা ফেলেছিল। এই ধারাবাহিকতায় আমিনুল ইসলাম বুলবুল, আকরাম খান, গাজী আশরাফ লিপুদের গর্বিত পথে মাশরাফি, শাকিব, মুশফিক, তামিম, এখন বিশ্ব ক্রিকেট অঙ্গনে জ্বলজ্বলে তারকা। খুদে আশরাফুল একসময়ের বিস্ময় বালক, মাশরাফি তারুণ্যের প্রতীক, শাকিব সকল ফরম্যাটে সেরাদের সেরা। মুস্তাফিজ ‘ফিজ’ নামের বিস্ময়। বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে এখন বাংলাদেশের পরিচয়।
যখন বিশ্বের সেরা ক্রীড়াঙ্গনগুলোতে বাংলাদেশের পতাকার সঙ্গে জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ ধ্বনিত হয় তখন প্রবাসীদের থাকে বুক ভরা গর্ব আর চোখ ভেজা জল। স্মরণ হয় জুয়েল ভাই যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছে, ব্যাটে জয় বাংলা লিখে রকিবুল পাকিস্তান দলের ইনিংস সূচনায় নেমেছিল। কামরুজ্জামান ভাই বিলেতি ক্রিকেট লেখককে ঢাকা ক্রিকেট স্টেডিয়াম (বর্তমান বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম) ঘুরিয়ে দেখালেন। রবিন মার্লারের লেখনি বাংলাদেশ ক্রিকেটের পুনর্জাগরণে বড় ভূমিকা রাখলো । প্রথম আবির্ভাবে পাকিস্তানকে হারিয়ে দেয়া, প্রথম টেস্টে আমিনুল ইসলামের শত রান, ২০০৭ বিশ্ব কাপে ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে দেয়া, কনিষ্ঠতম ব্যাটসম্যান হিসাবে আশরাফুলের শত রান, বিশ্বসেরা অস্ট্রেলিয়া দলকে জ্বলজ্বলে সেঞ্চুরি করে হারিয়ে দেয়া। ২০১১, ২০১৫ বিশ্ব কাপে উপর্যুপরি ইংল্যান্ডকে হারানো, কোনটাকে বড় করে দেখবেন? বাংলাদেশের দিনে টিম টাইগারÑ অন্তত ওডিআই ক্রিকেটে যে কোনো দলের জন্য হুমকি। তরুণ ক্রিকেট দলের বিশ্ব সেরা হয়ে ওঠা, মেয়েদের ক্রিকেট বিস্ময়কর সাফল্য – এগুলোকেই আমি ৫০ বছর ক্রীড়াঙ্গনের সেরা অর্জন বলবো।
হয়তো বলতে পারেন লাগসই পরিকল্পনার অভাবে অভিষেকের ২১ বছর পরেও টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ এখনো তলানিতে। কিন্তু জনপ্রিয়তার থাকা ক্রিকেট সংগঠনে যোগ্যরা প্রতিষ্ঠিত হলে, গুণী-প্রবীণদের মূল্যায়ন করা হলে, দেশব্যাপী মানসম্মত ক্রিকেটার গোড়ার উদ্যোগ নেয়া হলে ক্রিকেট পুরো সমাজকে পাল্টে দিতে পারে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাফল্যের ধারাবাহিকতা সৃষ্টি করতে হলে বিভাগ পর্যায় আধুনিক সুবিধা সৃষ্টির পাশাপাশি বয়সভিত্তিক ক্রিকেট, জেলা ভিত্তিক ক্রিকেটে ব্যাপক আন্দোলন সৃষ্টি করতে হবে, ব্যক্তিখাতকে প্রণোদনা দিতে হবে। ভারত পারলে, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর নিউ জিল্যান্ড পারলে কেন পারবে না বাংলাদেশ?
সালেক সূফী, ক্রীড়া লেখক, প্রবাসী জ্বালানি বিশেষজ্ঞ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

5 × two =