সুমন সরকার: একজন মেধাবী চিত্রগ্রাহক

বর্তমান সময়ের মেধাবী চিত্রগ্রাহকদের একজন সুমন সরকার। ধারাবাহিকতা বজায় রেখে প্রতিটি কাজে সৃজনশীলতার জানান দিচ্ছেন। ক্যামেরার পিছনে কাজ করছেন এক যুগের বেশি সময় ধরে। ‘ন ডরাই’ সিনেমায় কাজ করার মাধ্যমে বড় পর্দায় অভিষেক হয়। প্রথম সিনেমায় অসাধারণ কাজ করে পেয়েছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। নুরুল আলম আতিকের ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক হিসেবে পেয়েছেন দ্বিতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এবারের ঈদে রায়হান রাফি নির্মিত ‘সুড়ঙ্গ’ সিনেমায় চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। সুমন সরকার সম্পর্কে জানাচ্ছেন গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত।

সুমন সরকার খুলনা জেলার সন্তান। জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা সবকিছুই এই জেলায়। হয়তো বাবা-মা চেয়েছিলেন ছেলে বড় হয়ে ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে। বাবা-মায়ের স্বপ্ন সত্যি করার জন্য খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়াশোনাও সম্পন্ন করেছিলেন তিনি। কিন্তু সুমন সরকারের মন পড়ে ছিল শিল্পের ভেতরেই। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা শেষ করার পর ২০১০ সালে ভর্তি হলেন বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটে; ফিল্ম মেকিং শেখার জন্য। শেখার ফাঁকে ফাঁকে কাজ করেছেন অনেকের সাথে।

২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত গুণী নাট্যনির্মাতা কৌশিক শংকর দাশের সঙ্গে কাজ করেছেন সুমন সরকার। তারপর সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন তুহিন হোসেন ও আলভি রহমানের সাথে। সুমন সরকার বললেন, ‘আমি যখন সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করা শুরু করলাম তখন বুঝতে পারলাম এটা আসলে লাইফ না। নাটকের প্রি প্রোডাকশন, শুটিংসহ এক সপ্তাহ পরিশ্রম করে হাতে পেতাম ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা। তখন উপলব্ধি করলাম, যারা আসলে নিজে কিছু করে দেখাতে পারবে না বলে স্থির করে ফেলেছে তাদের জন্য এই জায়গা। আমি তখন এসব থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে ফেলি।’ ২০১১ সালের শেষের দিকে তিন বন্ধু মিলে তৈরি করেছিলেন ‘মিথোনমিয়া’ নামের একটি প্রোডাকশন কোম্পানি। পরিচিত মানুষদের নানান ধরনের কাজ করে দিতেন তখন সুমন সরকার।

২০১৩ সালে টেলিকম অপারেটর কোম্পানি রবি আয়োজন করে ‘রবি শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’। সারা বাংলাদেশ থেকে শর্ট ফিল্ম মেকাররা তাদের সিনেমা জমা দেয় এই আয়োজনে। সুমন সরকার বন্ধুদের নিয়ে ‘সিন্স উই সেপারেট’ নামের শর্ট ফিল্ম জমা দেয় ফেস্টিভ্যালে। সুমন সরকার নির্মিত শর্ট ফিল্মটি তার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এই আয়োজনে জুরি বোর্ডের সদস্য ছিলেন অমিতাভ রেজা চৌধুরী। অমিতাভ রেজা একদিন অফিসে ডাকেন সুমনকে। একসাথে কাজ করার কথাও জানান। সুমন সরকার কি আর সেই সুযোগ হাতছাড়া করতে পারেন। অমিতাভ রেজা চৌধুরীর সঙ্গে যখন যুক্ত হলেন তখন তিনি ‘আয়নাবাজি’ সিনেমার স্ক্রিপ্টের কাজ করছিলেন। সুমন সরকার ও তার বন্ধু সুপ্ত দুই মাসের বেশি সময় কাজ করেছেন আয়নাবাজি সিনেমার স্ক্রিপ্ট নিয়ে।

২০১৪ সালে অমিতাভ রেজা চৌধুরী ভরসা করলেন তরুণ সুমন সরকারের ওপর। ‘সারফেস’ নাটকে চিত্রগ্রাহক হিসেবে যুক্ত করলেন। নাটকটি সেই বছর মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার পেয়েছিল ক্রিটিক ক্যাটাগরিতে। অমিতাভ রেজা চৌধুরীর সঙ্গে ২০১৬ সালে ‘শেষ আড্ডা’ নামের একটি নাটকেও কাজ করেছেন সুমন সরকার। আজ থেকে দশ বছর আগে ৭উ ডিএসএলআর ক্যামেরা ছিল সুমন সরকারের। ক্যামেরা থাকার সুবাদে অনেকের প্রজেক্টের বিহাইন্ড দ্য সিন তৈরি করে দিতেন; আর পাশাপাশি ছবি তুলেও দিতেন। সেভাবেই অনেকের সাথে কাজ করা হয়েছে। কাজ করতে করতে সুমন সরকার একদিন ঠিক করলেন তিনি ডিওপি হিসেবেই এই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে চান। ধ্যান মন সবকিছু ঢেলে দিলেন এটাতে। তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন, তার আলাদা একটা ভাষা তৈরি করতে হবে কাজের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের খ্যাতিমান চিত্রগ্রাহক রাশেদ জামান ক্যারিয়ারের সূচনালগ্নে বেশ সহায়তা করেছেন পরামর্শ দিয়ে। ক্যারিয়ারের শুরুতে সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করেছেন বিবিসি মিডিয়া অ্যাকশনের সঙ্গে।

সুমন সরকার ক্যারিয়ারের শুরুতে মিউজিক ভিডিও নিয়ে কাজ করেছেন অনেক। একসময় পরিচয় হয় মিউজিক ভিডিও ডিরেক্টর তানিম রহমান অংশুর সঙ্গে। মিউজিক ভিডিও নির্মাণের ক্ষেত্রে সেই সময়ে তিনি বেশ জনপ্রিয়। অনেক মিউজিক ভিডিওতে তানিম রহমান অংশুর সঙ্গে কাজ করেছেন সুমন সরকার। তানিম রহমান অংশু যখন ‘ন ডরাই’ সিনেমা নিয়ে কাজ শুরু করার পরিকল্পনা করছিলেন তখনই সুমন সরকারকে বলেন লং টার্ম একসাথে কাজ করা যায় কি না। সেখান থেকেই বড় পর্দায় চিত্রগ্রাহক হিসেবে সুমন সরকারের অভিষেক। সার্ফিং নিয়ে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সিনেমা নির্মাণ হয়। সিনেমা জুড়ে নিখুঁত ক্যামেরার কাজ দেখা গিয়েছে। সিনেমায় করা প্রথম কাজই সুমন সরকারকে এনে দিয়েছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ৪৪তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার আয়োজনে শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক হিসেবে সম্মাননা পান।

চিত্রগ্রাহক সুমন সরকার জানান, টেকনিক্যাল দিক থেকে আমার প্রথম সিনেমা নুরুল আলম আতিক ভাইয়ের ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’। কেননা সিনেমাটির শুটিং হয়েছিল ২০১৬ সালে কিন্তু মুক্তি পেয়েছিল ২০২১ সালে। আবার মুক্তির দিক থেকে চিন্তা করলে প্রথম সিনেমা ‘ন ডরাই’। ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ সিনেমাতেও সুমন সরকার নিজের জাত চিনিয়েছেন। ‘ইতিবৃত্ত’ নামের এক শর্ট ফিল্ম দেখে নুরুল আলম আতিক সুমন সরকারকে খুঁজে পেয়েছিলেন। শর্ট ফিল্মটা মূলত ডিএসএলআর দিয়ে জিরো লাইটে শুট করেছিলেন তিনি। বিষয়টা দেখে বিস্মিত হয়ে তিনি সুমন সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তার সিনেমার সম্পর্কে জানান। নুরুল আলম আতিকের সঙ্গে সুমন সরকারের পরিচয়টা এভাবেই। চিত্রগ্রাহক হিসেবে এই সিনেমায় কাজ করার জন্য যৌথভাবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন সুমন। রায়হান রাফির স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের গল্প নিয়ে নির্মিত ‘দামাল’ সিনেমায়ও যুক্ত ছিলেন তিনি। ২০২৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘অ্যাডভেঞ্চার অব সুন্দরবন’ সিনেমাতেও চিত্রগ্রাহকের আসনে ছিলেন তিনি।

এবারের ঈদে বড় পর্দায় ফিরছেন আফরান নিশো ‘সুড়ঙ্গ’ সিনেমা দিয়ে। রায়হান রাফির নির্মিত এই সিনেমায় চিত্রগ্রাহক হিসেবে নিজের দক্ষতার পরিচয় ইতিমধ্যে সিনেমার শর্ট টিজারগুলোতে দিয়ে ফেলেছেন। সুনামগঞ্জের অপরূপ সৌন্দর্য ফ্রেমবন্দি করেছেন সুমন সরকার। এই সিনেমার মাধ্যমে বাংলাদেশি সিনেমায় প্রথমবারের মতো ব্যবহৃত হচ্ছে অ্যালেক্সা মিনি এলএফ ক্যামেরা। ‘সুড়ঙ্গ’ সিনেমার শুটিং করা হয়েছে এই ক্যামেরায়। বিশ্ববাজারে এই ক্যামেরার দাম লেন্স ও অ্যাকসেসরিজসহ দুই কোটি টাকার আশেপাশে। দৈনিক ভিত্তিতে ভাড়া নিলেও দিনপ্রতি প্রায় সত্তর থেকে আশি হাজার টাকা গুণতে হয় এই ক্যামেরার পেছনে। কেন এত ব্যয়বহুল এবং আধুনিক ক্যামেরার ব্যবহার এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, ‘নতুন একটা এক্সপেরিয়েন্স দর্শককে দেওয়ার জন্য। দর্শক পর্দায় নতুন এক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হবেন। যেটা বাংলাদেশের সিনেমায় আগে কখনও দেখা যায়নি। আমরা সাধারণত যেসব অ্যালেক্সা ক্যামেরা ব্যবহার করি সেগুলোতে ১.২৭ ক্রপ ফ্যাক্টর আছে, যে কারণে আমরা কখনোই ফুল ফ্রেম পেতাম না। এই ক্যামেরায় সেন্সর বড়। আমরা দর্শকদের বড় পর্দায় আরও সিনেম্যাটিক ফিল দিতে চেয়েছি, লেন্সের অ্যাকচুয়াল ম্যাগনিফিকেশন পেতে তাই এই ক্যামেরা দিয়ে লার্জ ফরম্যাটে শ্যুট করেছি। অন্যান্য অ্যালেক্সা ক্যামেরায় যেখানে ২.৮ কে ‘র’ ফুটেজ পেতাম সেখানে এই ক্যামেরায় আমরা ‘র’ ফুটেজই পেয়েছি ৪.৫ কে। আশা করছি দর্শকরা টেক্সচার ও টোনালিটির দিক থেকে দারুণ সিনেম্যাটিক একটা এক্সপেরিয়েন্স পাবেন।’ সুমন সরকার নিজের কাজ নিয়ে কতোটা যত্নশীল তা মুক্তিপ্রাপ্ত সুড়ঙ্গ সিনেমার দিকে তাকালেই আন্দাজ করা যায়। মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে নিয়ামুল মুক্তার ‘বৈদ্য’ সিনেমা। সিনেমাটিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন গুণী অভিনেতা মোশাররফ করিম। সিনেমাটির চিত্রগ্রহণের কাজ ইতিমধ্যে সম্পন্ন করে ফেলেছেন সুমন সরকার। এবছরের শেষ নাগাদ সিনেমাটি মুক্তি পাবে।

বড় পর্দার পাশাপাশি সমানতালে ওটিটিতে কাজ করছেন সুমন সরকার। ‘ঊনলৌকিক’ অ্যান্থোলজি ওয়েব সিরিজের একটি পর্বের চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে ওটিটিতে নাম লেখান সুমন সরকার। অমনিবাস চলচ্চিত্র ‘জাগো বাহে’র ‘শব্দের খোয়াব’ পর্বটি পরিচালনা করেছেন সিদ্দিক আহমেদ। এই কাজটিতে যুক্ত ছিলেন সুমন সরকার। এছাড়া রায়হান রাফির ওয়েব ফিল্ম ‘সাত নাম্বার ফ্লোর’ ও ‘ফ্রাইডে’, রবিউল আলম রবির ওয়েব ফিল্ম ‘ক্যাফে ডিজায়ার’, সামিউর রহমানের ওয়েব ফিল্ম ‘কুহেলিকা’ তে কাজ করছেন সুমন সরকার। এছাড়াও দেশের বাহিরে ও ভারতীয় বেশ কয়েকটি প্লাটফর্মের সঙ্গে কাজ করার কথা চলছে।
সুমন সরকার বিজ্ঞাপন জগতের পরিচিত মুখ। এখন অব্দি দুই শতাধিক বিজ্ঞাপনে কাজ করেছেন চিত্রগ্রাহক হিসেবে। বাংলাদেশের প্রথম সারির প্রতিটি কোম্পানির জন্য কাজ করা হয়েছে তার। এখনো সিনেমার কাজের মাঝে বিজ্ঞাপনের কাজ করে থাকেন তিনি। ২০১৪ সালে গ্রামীণফোনের জন্য অমিতাভ রেজা চৌধুরীর নির্মাণ করেন ‘নির্ঘুম চোখ’ শিরোনামের একটি মিউজিক ভিডিও। সেই ভিডিওতে গিটার বাজিয়ে গান গাইতে দেখেছিলেন যাকে তিনি কিন্তু এই সুমন সরকার। সুমন পর্দার সামনে আসুন আরো বহুবার। কিন্তু পর্দার অন্তরাল থেকে সুমন সরকার ক্যামেরা হাতে আমাদের মুগ্ধ করে যাবেন আরো বহুদিন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: অন্তরালে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

eight − 4 =