ঈদ ও বৈশাখের বাহারি ফ্যাশন

নাহিন আশরাফ

এ বছর ঈদ ও পহেলা বৈশাখ এসেছে হাত ধরাধরি করে। ঠিক ঈদের পরপরই পড়েছে পহেলা বৈশাখ। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদ। আবার বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখ যেহেতু পুরো বাঙালি জাতির উৎসব তাই এই রোজায় মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা ছাড়া অন্য ধর্মের মানুষরাও কেনাকাটা করছে। দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলো যেন পেয়েছে সুবর্ণ সুযোগ। তাদের এবারের কালেকশনে চোখে পড়ছে ঈদ ও পহেলা বৈশাখের যুগলবন্দী। এবারের আয়োজন ঈদ ও বৈশাখ কেন্দ্র করে ফ্যাশন হাউজগুলো কেমন করে সেজে উঠেছে তা নিয়ে।

প্রতিবছর যেকোনো উৎসবে ফ্যাশন হাউজ গুলোর একটি বড় অংশ জুড়ে থাকে শুধু নারীর পোশাক। এ বছরও তার ব্যতিক্রম নয়। নারীদের জন্য ঈদ ও বৈশাখকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের পোশাকে পসরা সাজিয়ে বসেছে ফ্যাশন হাউসগুলো।

গরমের মধ্যে পড়ছে তাই এই বিষয়টাকে মাথায় রেখে বেশিরভাগ পোশাক তৈরি করা হয়েছে সুতি ও লিলেনের। ফ্যাশন হাউজগুলো ঘুরে দেখা যায় ক্রেতাদের বেশি চাহিদা সুতি পোশাকের। যেহেতু ঈদের পরপরই বৈশাখ তাই এবার পোশাকে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ছোঁয়া রেখেছে ডিজাইনাররা। বৈশাখের চিরাচরিত রঙ লাল ও সাদা। এ দুটি রঙ ছাড়াও এখন অনেকে নীল সবুজ হলুদ কমলা ইত্যাদি রঙের পোশাক পরে থাকে। কিন্তু অনেকে বৈশাখের লাল ও সাদা পরতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তাই এবার ফ্যাশন হাউজগুলোতে বড় অংশ জুড়ে লাল ও সাদা রঙের আধিক্য দেখা যাচ্ছে। নারীদের সালোয়ার কামিজের কাট ও ডিজাইনে এসেছে পরিবর্তন। কামিজের মধ্যে করা হচ্ছে ব্লক ও এমব্রয়ডারির নকশা। এবার ঈদে  তুলনামূলক বেশি শাড়ি বিক্রি হচ্ছে, কারণ সামনে পহেলা বৈশাখ। শাড়ির মধ্যে রয়েছে ব্লকের সুতির শাড়ি। যার মধ্যে নান্দনিকতা ফুটিয়ে তোলার জন্য তবলা, ঢাক-ঢোল, পাখি, ময়ূর ইত্যাদির নকশা করা হচ্ছে।

আবার শাড়ির পাড়ে করা হচ্ছে সুই সুতা দিয়ে হাতের কাজ। অনেকে বৈশাখের জন্য বেছে নিচ্ছে জামদানি শাড়ি। জামদানি শাড়ি আমাদের দেশীয় ঐতিহ্যকে বহন করে বলে এটি অনেকের প্রথম পছন্দ। এছাড়া নকশি কাঁথা ও মসলিন শাড়ির চাহিদাও রয়েছে। সালোয়ার-কামিজ ও শাড়ি ছাড়াও মেয়েদের জন্য রয়েছে কুর্তি, কটি, কাফতান, টি-শার্ট, স্কার্ট ইত্যাদি। ভিন্নধর্মী সাজের জন্য অনেকেই এখন শার্ট স্কার্ট পরে থাকেন। তাই নারীদের স্কার্ট ও শার্টের দেওয়া হয় দেশীয় ছোঁয়া। এছাড়া এ বছর শর্ট কামিজের ট্রেন্ড চলছে, শর্ট কামিজগুলো লম্বা হয় হাঁটু থেকে কিছুটা উপরে। সাধারণত জিন্স কিংবা ফর্মাল প্যান্টের সাথে শর্ট কামিজ পরা হয়। শর্ট কামিজের উপর ফুল, লতাপাতা ইত্যাদি মোটিফে কাজ করা হয়। নারীদের ওয়েস্টার্ন পোশাকে ঐতিহ্যর ছোঁয়া দেওয়ার জন্য কখনো গামছা প্রিন্টের কাজ করা হচ্ছে, আবার দেখা যাচ্ছে রিকশা প্রিন্ট কিংবা নকশি কাঁথার প্রিন্টের মোটিফ। এছাড়া হাফ সিল্কের শাড়ি কিংবা কুর্তিতে জামদানি মোটিফ কাজ করা হয়ে থাকে। কালেকশনের বড় অংশ জুড়ে থাকছে দেশীয় পোশাক। কয়েক বছর ধরে নারীদের পাকিস্তানি ও ইন্ডিয়ান পোশাকের প্রতি ঝোঁক বেড়েছে। যেহেতু ঈদের পরে পহেলা বৈশাখ তাই বিক্রেতা ও ফ্যাশন হাউজগুলো আশাবাদী এ বছর সবাই দেশীয় পোশাক কিনবে।

গরমের কারণে সবাই সুতির পোশাককে প্রাধান্য দিলেও মসলিন এবং সিল্কের কাপড় দিয়েও তৈরি করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের পোশাক। বিগত বছরগুলোর মতো এ বছরও লম্বা ও ওভার সাইজ পোশাক ট্রেন্ডে রয়েছে। দু সাইজ বড় পোশাককে ওভার সাইজ পোশাক বলা হয়। এ ধরনের পোশাকে গরমে যেমন আরাম পাওয়া যায় তেমন দেখতেও লাগে ফ্যাশনেবল। পোশাকের হাতায়ও দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্র্য। চওড়া লম্বা হাতা, নরমাল হাতা অথবা কেইপ হাতা, হাই নেক কলার, বোট নেক কিংবা সিøভলেসও থাকছে। যেহেতু সুতির মতো লিলেনও একটি আরামদায়ক কাপড় তাই লিলেনের চাহিদাও ব্যাপক। লিলেন কাপড়ের সালোয়ার-কামিজ ও শাড়ির মধ্যে বেশি লক্ষ্য করা যায় স্ক্রিনপ্রিন্ট। গরমের জন্য কাফতান কিনছে অনেকে, ঢিলেঢালা হবার কারণে এটি বেশ আরামদায়ক। এবছর পোশাকের মধ্যে গাঢ রঙ বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে পহেলা বৈশাখের জন্য। প্রতিটি পোশাকে লাল, হলুদ, নীল, মেরুন এমন রঙের প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে।

ঈদ হোক কিংবা বৈশাখ ছেলেদের প্রথম পছন্দ পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির গলা ও হাতায় নকশা করাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। পাঞ্জাবিতে এমব্রয়ডারির কাজও করা হয়ে থাকে। পাঞ্জাবির হাতা কিংবা গলায় দেখা যায় হাতের কাজ।  সুতি ছাড়াও জর্জেট, ক্রেপ জর্জেট, সিল্ক, হাফ সিল্ক, মসলিন, সাটিনের মতো কাপড় দিয়ে পাঞ্জাবি তৈরি করা হচ্ছে। পহেলা বৈশাখের জন্য ছেলেদের পাঞ্জাবিতে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে উজ্জ্বল রঙ। টাইডাইয়ের পাঞ্জাবি এখন ছেলেদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে। পাঞ্জাবি ছাড়াও কটি, কাবুলি, ক্যাজুয়াল শার্ট, ফর্মাল হাফ শার্ট, পলো-শার্ট থাকছে ছেলেদের পোশাকের আয়োজনে।

শিশুদের ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে আরামকে। পোশাক পরে তারা যাতে অস্বস্তি বোধ না করে সে কথা খেয়াল রেখেই ডিজাইনাররা নকশা করে থাকেন শিশুদের পোশাক। ফ্যাশন হাউজগুলোতে শিশুদের পোশাকের কালেকশন বেশি দেখা যাচ্ছে সুতি ও লিলেন কাপড়ে তৈরি পোশাক। অনেক বাবা-মায়েরা পয়লা বৈশাখের দিন শিশুদের শাড়ি পরাতে ভালোবাসে। এজন্য শিশুদের জন্য তৈরি করা হয় আলাদা শাড়ি যা তারা খুব সহজে ঝামেলা ছাড়া পরা যায়। এছাড়া বাবা কিংবা মায়ের পোশাকের সাথে মিল রেখেও তৈরি করা হচ্ছে শিশুর পোশাক।

গয়নার বাহার

পোশাকের সাথে চাই মানানসই গয়না। বিশেষ করে শাড়ি পরলে নারীদের গয়নার প্রতি টান আরও বেশি অনুভব করে। পহেলা বৈশাখ ও ঈদের জন্য বিভিন্ন ফ্যাশন হাউজগুলো ও অনলাইন উদ্যোক্তারা বাহারি গয়নার কালেকশন এনেছে। গয়নার মধ্যে এখন ট্রেন্ডে রয়েছে সিলভারের বড় ঝুমকা। সিলভার রঙের যে কোনো পোশাকের সাথে মানানসই বলে অনেকেই এখন সিলভার জুয়েলারি বেছে নিচ্ছে। গয়নায় নিয়ে আসা হয়েছে নানা ধরনের বৈচিত্র্য। পোশাকের মতো এখন গয়নাতে ও লক্ষ্য করা যায় জামদানি মোটিফ। জামদানি কাতান ইত্যাদি শাড়ির সাথে আভিজাত লুক তৈরির জন্য অনেকে বেছে নিচ্ছে কুন্দনের গয়না। ব্রাস মেটাল দিয়ে ডিজাইনাররা তৈরি করে থাকেন নানা ধরনের গয়না। অক্সিডাইজড গয়নার চাহিদা রয়েছে সবসময়। তার সাথে পরে নেওয়া হচ্ছে অক্সিডাইসের বড় ঝুমকা কিংবা মালা। অক্সিডাইজডের মধ্যে ময়ূর, লতা পাতা ইত্যাদির নকশা তুলে ধরা হচ্ছে। অক্সিডাইজড গয়নার মধ্যে নতুনত্ব আনতে মিররের কাজ করা হয়ে থাকে। এসব গয়না কানের দুল, মালা এবং আংটিসহ সেট আকারে বিক্রি করা হয়। আবার কেউ ইচ্ছে করলে আলাদা করেও নিতে পারে।

পহেলা বৈশাখের জন্য এবার গুরুত্ব পেয়েছে দেশীয় উপাদান দিয়ে তৈরি গয়না। বেশ কয়েক বছর ধরে কাঠের গয়না বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। শাড়ির সাথে কিংবা নিত্যদিন পরার জন্য অনেকে ব্যবহার করছে কাঠের গয়না। এ ছাড়া বাটিক, জামদানি ইত্যাদি কাপড় কেটে ও নানা ধরনের কাপড়ের গয়না তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়া হারিয়ে যাওয়া মাটির গয়নাও আবার ফিরে এসেছে। গয়নার মধ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে বীজ, কড়ি ও রুদ্রাক্ষ। পাটের তৈরি চুড়ি, মালা ও আংটি এখন বেশ ট্রেন্ডি।

কোথায় পাবেন

হাতের নাগালে যেকোনো ফ্যাশন হাউসেই মিলবে ঈদ ও বৈশাখের কালেকশন। তবে দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলো বেশি জোর দিচ্ছে বৈশাখ ও ঈদ কালেকশনে। যেমন আড়ং, অঞ্জন্স, বিশ্বরঙ, দেশাল, রঙ বাংলাদেশ, গাও গেরাম, বাংলার মেলা, যাত্রা, কে ক্রাফট ইত্যাদিতে রয়েছে বাহারি ঈদ ও বৈশাখ কালেকশন। এছাড়া পিংক সিটি, বসুন্ধরা সিটি, বেইলি স্টার ইত্যাদি মার্কেটের বিভিন্ন শোরুমে পাওয়া যাবে ঈদ ও বৈশাখ কালেকশন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ফ্যাশন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

4 × 5 =