এশিয়ার সিংহাসনে বসবে কে

উপল বড়ুয়া

শুরুতে ছিল তিন দল, ৩৯ বছরের ব্যবধানে এশিয়া কাপ প্রথমবারের মতো আয়োজিত হচ্ছে ৬ দল নিয়ে। ভবিষ্যতে হয়তো সংখ্যাটা আরও বাড়বে। ১৯৮৪ সালে শারজায় প্রথমবার আয়োজিত হয় এশিয়ান ক্রিকেটের এই শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। গতবছরও হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। এবারের এশিয়ার কাপের আয়োজক পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা।

অথচ এককভাবে ২০২৩ এশিয়া কাপের আয়োজন করার কথা পাকিস্তানের। কিন্তু ভারত আগে থেকে হুমকি দিয়ে রাখে শত্রভূমি পাকিস্তানে যাবে না তারা। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) কম চেষ্টা করেনি ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডকে (বিসিসিআই) বোঝাতে। পাকিস্তানও হুমকি দিয়েছিল, ভারত এশিয়া কাপ খেলতে না এলে তারাও অক্টোবরে বিশ্বকাপ খেলতে ভারতে যাবে না।

তবে শেষ পর্যন্ত এ যুদ্ধে জিতেছে ভারত। বিশ্বকাপে না খেলা মানে যে পাকিস্তানেরই ক্ষতি! আর ভারতের কারণে নিরপেক্ষ ভেন্যু হিসেবে এশিয়া কাপে থাকছে শ্রীলঙ্কা। আগামী ৩০ আগস্ট থেকে শুরু এশিয়া কাপের ১৬তম আসর। ১৩ ম্যাচের এই লড়াই শেষ হবে ১৭ সেপ্টেম্বর। যার মধ্যে চার ম্যাচ হবে পাকিস্তানে, বাকি ৯ ম্যাচ শ্রীলঙ্কায়। ‘এ’ গ্রুপে পড়েছে দুই পরাশক্তি ভারত, পাকিস্তান ও নবাগত নেপাল। ‘বি’ গ্রুপে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তান।

গ্রুপ পর্ব থেকে শীর্ষ দুই দল জায়গা করে নেবে সুপার ফোরে। সেখান একে অপরের মুখোমুখি হওয়ার পর পয়েন্ট তালিকায় শীর্ষে থাকা দুই দল খেলবে ফাইনালে। সে হিসেবে ভারত-পাকিস্তান ফাইনালে গেলে দুই দল মুখোমুখি হতে পারে তিনবার। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে হওয়া গত এশিয়া কাপও একই ফরম্যাটে হয়েছিল। তবে সেবার হিসাব উল্টে দেয় শ্রীলঙ্কা। এবার ভেন্যু হিসেবে আছে চারটি। পাকিস্তানের মুলতান ও লাহোর, শ্রীলঙ্কার কলম্বো ও কেন্ডি। ফাইনাল হবে কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে। প্রারম্ভিক আলোচনা শেষ, চলুন এবার দেখে নেওয়া যাক দলগুলোর রণকৌশল ও স্কোয়াড।

বাংলাদেশ

গত জুলাইয়ের শুরুতে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের মাঝপথে হঠাৎ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা, পরে ওয়ানডে নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়া; গত দুই মাসে তামিম ইকবালকে যেতে হয়েছে এসবের ভেতর দিয়েই। দায়িত্ব না ছাড়লে এশিয়া কাপে তিনিই নেতৃত্ব দিতেন। তবে আপাতত তিনি ফিটনেস ফিরে পেতে অনুশীলনে। তামিম সরে দাঁড়ানোয় ওয়ানডেতে দল সামলানোর ভার পড়েছে সাকিব আল হাসানের ওপর। আগে থেকেই তিনি টেস্ট ও টি-টোয়েন্টির অধিনায়ত্ব করছেন। কদিন আগে সাকিব, লিটন দাস লঙ্কা প্রিমিয়ার লিগ খেলে এসেছেন। তার আগে কানাডায় গ্লোবাল টি-টোয়েন্টি। বাইরের ফ্র্যাঞ্চাইজিতে খেলার অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগাতে চাইবেন এশিয়া কাপে।

বাংলাদেশ দলে আলাদাভাবে চোখ থাকবে তাওহীদ হৃদয়ের ওপর। প্রথমবার বাইরের লিগে খেলতে গিয়ে বেশ সফল এই মিডলঅর্ডার ব্যাটার। এক ঝাঁক তরুণকে নিয়ে লঙ্কায় যাবেন সাকিব। হৃদয়, তানজিম সাকিব, তানজিদ হাসান তামিম, শরীফুল ইসলামেরা প্রথমবার আইসিসি ট্রফি এনে দিয়েছেন। অনুর্ধ্ব১৯ বিশ^কাপ চ্যাম্পিয়ন তারা। এবার যদি বাংলাদেশকে প্রথমবার এশিয়া কাপটাও এনে দিতে পারেন! ইবাদত হোসেন ছিটকে যাওয়ায় স্ট্যান্ডবাই থেকে স্কোয়াডে ঢুকেছেন তানজিম সাকিব। তবে জায়গা হয়নি মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের। পঞ্চপাণ্ডবদের মধ্যে সাকিব ছাড়া আছেন শুধু মুশফিকুর রহিম। বাংলাদেশ প্রথমবার এশিয়া কাপ খেলে ১৯৮৬ সালে। এরপর থেকে প্রতি আসরেই খেলেছে। তিনবার ফাইনাল খেলেও শিরোপা জিততে পারেনি। তার মধ্যে ওয়ানডে ফরম্যাটে ২০১২ ও ২০১৮ সালে। ২০১৬ সালে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে। প্রথমবার পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ দু’বার টানা ভারতের বিপক্ষে। এবারের এশিয়া কাপে কেন্ডির পালেকেলেতে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে অভিযান শুরু করবেন সাকিবরা।

বাংলাদেশ স্কোয়াড: সাকিব আল হাসান (অধিনায়ক), লিটন দাস, তানজিদ হাসান তামিম, নাজমুল হোসেন শান্ত, তাওহীদ হৃদয়, মুশফিকুর রহিম (উইকেটরক্ষক), আফিফ হোসন ধ্রুব, শামীম হোসেন পাটোয়ারি, মেহেদি হাসান মিরাজ, তাসকিন আহমেদ, মোস্তাফিজুর রহমান, মোহাম্মদ নাঈম শেখ, মাহেদী হাসান, শরীফুল ইসলাম, তানজিম সাকিব, হাসান মাহমুদ, নাসুম আহমেদ। বিকল্প: তাইজুল ইসলাম ও সাইফ হাসান।

ভারত

ভারতের সবচেয়ে বড় শক্তি তাদের ডিপ-লাইং ব্যাটিং অর্ডার। দলে আছেন রোহিত শর্মা-বিরাট কোহলির মতো অভিজ্ঞ ব্যাটার। পেস ইউনিটে প্রায় এক বছর পর দলে ফেরা জসপ্রীত বুমরাহ শক্তিটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে তাদের। নিজেদের মাটিতে অক্টোবরে অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপের আগে এশিয়া কাপ দিয়ে নিজেদের পরখ করতে নামবে টিম ইন্ডিয়া। চোট কাটিয়ে দলে ফেরা দুই ব্যাটার লোকেশ রাহুল ও শ্রেয়াস আয়ারও বিশ্বকাপের আগে নিজেদের প্রমাণ করতে মুখিয়ে থাকবেন। গত এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে প্রায় তিন বছরের সেঞ্চুরি খরা কাটান কোহলি। এরপর থেকে দুর্দান্ত ফর্মে সাবেক অধিনায়ক। গত বছর ফাইনাল খেলা হয়নি। তবে এবারও ফেবারিটের তালিকায় সবার ওপরেই থাকবে ভারতের নাম। এশিয়া কাপের প্রথম আসরের চ্যাম্পিয়ন তারা। সর্বোচ্চ ৭ শিরোপাও জিতেছে ভারত। রোহিতরা টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচ খেলবে ০২ সেপ্টেম্বর, কেন্ডিতে। প্রতিপক্ষ চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান।

ভারত স্কোয়াড: রোহিত শর্মা (অধিনায়ক), শুবমান গিল, বিরাট কোহলি, শ্রেয়াস আয়ার, সুর্যকুমার যাদব, লোকেশ রাহুল, ইশান কিষাণ, হার্দিক পান্ডিয়া (সহ-অধিনায়ক), রবীন্দ্র জাদেজা, শার্দুল ঠাকুর, অক্ষর প্যাটেল, কুলদীপ যাদব, জসপ্রীত বুমরাহ, মোহাম্মদ শামি, মোহাম্মদ সিরাজ, প্রাসিধ কৃষ্ণ। বিকল্প: সঞ্জু স্যামসন।

পাকিস্তান

‘আনপ্রেডিক্টেবল’ শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে পাকিস্তানের নামের আগে। হারতে বসা ম্যাচ নাটকীয়ভাবে জিতে যাওয়া বা জিততে বসা ম্যাচ হাত ফসকে মাটিতে ফেলে দেওয়া; পাকিস্তান ছাড়া আর কে পারবে! তবে বাবর আজমদের প্রজন্মের এই দলটি বেশ ভারসাম্যপূর্ণ। গত এশিয়া কাপ ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালিস্ট তারা। অবশ্য দু’বারই হেরেছে। তবে এবার সেই আক্ষেপ ঘোচাতে চাইবে। এমনিতে এশিয়া কাপ পুরোপুরি আয়োজন করতে না পারায় ক্ষুব্ধ পাকিস্তান। সেই রাগটা তারা দেখাতে চাইবে মাঠে। সবসময়ের মতো এবারও পাকিস্তানের বড় শক্তি নাসিম শাহ-শাহীন শাহ আফ্রিদির মতো তরুণদের নিয়ে গড়া পেস ইউনিট। সঙ্গে বাবর আজম-ফখর জামানদের মতো বিশ্বমানের ব্যাটাররা নিজেদের দিনে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলে প্রতিপক্ষের জন্য ডেকে আনবে সমূহ বিপদ। তবে চাপের মুখে তাদের ভেঙে পড়াও নতুন। উদ্বোধনী দিনে মুলতানে নেপালের বিপক্ষে শক্তি দেখাতে নামবে পাকিস্তান।

পাকিস্তান স্কোয়াড: বাবর আজম (অধিনায়ক), আবদুল্লাহ শফিক, ফখর জামান, ইমাম-উল-হক, সালমান আলী আঘা, ইফতিখার আহমেদ, তৈয়ব তাহির, মোহাম্মদ রিজওয়ান (উইকেটরক্ষক), মোহাম্মদ হারিস, শাদাব খান, মোহাম্মদ নওয়াজ, উসামা মীর, ফাহিম আশরাফ, হারিস রউফ, মোহাম্মদ ওয়াসিম জুনিয়র, নাসিম শাহ, শাহীন শাহ আফ্রিদি।

শ্রীলঙ্কা

এশিয়া কাপের দ্বিতীয় সফল তারা। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নও। গত বছর দেশ যখন অর্থনৈতিক মন্দায় ধুঁকছে তখন পাকিস্তানকে হারিয়ে এশিয়া কাপ জিতে ঘরে ফিরেছিলেন শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটাররা। মাহেলা জয়াবর্ধনে-কুমার সাঙ্গাকারা পরবর্তী প্রজন্মের এটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য। গত কয়েক বছর ধরে নিজেদের হারিয়ে খুঁজছে লঙ্কানরা। এই জয় তো এই হার, এমন শোচনীয় অবস্থা তাদের। আগামী বিশ্বকাপের টিকিটও কেটেছে বাছাইপর্ব পেরিয়ে। তবে এবার যেহেতু ঘরের মাঠে এশিয়া কাপ শিরোপা সংখ্যাটা ৭ করে ভারতকে ছুঁতে চাইবেন দাসুন শানাকারা। উদ্বোধনীর পরের দিন কেন্ডিতে বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচ অভিযান শুরু হবে লঙ্কানদের। এই প্রতিবেদনের আগ পর্যন্ত, এশিয়া কাপের জন্য দল ঘোষণা করেনি তারা।

শ্রীলঙ্কা সম্ভাব্য স্কোয়াড: দাসুন শানাকা (অধিনায়ক), পাথুম নিশানকা, কুশল মেন্ডিস (উইকেটরক্ষক), চারিথ আসালাঙ্কা, ধনাঞ্জয়া ডি সিলভা, নুয়ানিদো ফার্নান্দো, অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস, আশেন বান্দ্রা, সাদিরা সামারাবিক্রমা (উইকেটরক্ষক), চামিকা করুনারত্নে, ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা, মহীশ থিকশানা, কাসুন রাজিথা, লাহিরু কুমারা, দিলশান মাধুশঙ্ক।

আফগানিস্তান

নিজেদের দিনে যে কাউকে হারিয়ে দিতে পারে আফগানিস্তান। যুদ্ধবিধ্বস্ত হলেও হাঁটিহাঁটি পা পা করে আজ তারা সীমিত ওভারের ক্রিকেটে পরাশক্তির পথে। তবে ওয়ানডেতে একটু হলেও পিছিয়ে। গ্রুপে থাকা বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার পথে বড় বাধা হবে আফগানরা। দলে আছে মোহাম্মদ নবীর মতো অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার, রশিদ খানের মতো লেগি। আইপিএলে খেলার সুবাদে লেট মিডল-অর্ডারে নেমে বড় ক্যামিও খেলতে পারেন তিনি। ওপেনিংয়ে রহমানউল্লাহ গুরবাজ বেশ বড় শট খেলতে পারেন। সঙ্গে থাকবেন ইব্রাহিম জাদরান। গত বাংলাদেশ সফরে এই দুজনের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড গড়েছে আফগানরা। নিজেদের তৃতীয়বারের মতো সুপার ফোরেই দেখতে চাইবে তারা। ৩ সেপ্টেম্বর লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের বিপক্ষে টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচ খেলবে রশিদ-নবীরা।

আফগানিস্তান সম্ভাব্য স্কোয়াড: ইব্রাহিম জাদরান, রহমানউল্লাহ গুরবাজ, হাসমতউল্লাহ শহীদি (অধিনায়ক), রহমত শাহ, নাজিবুল্লাহ জাদরান, ইকরাম আলী খিল (উইকেটরক্ষক), আজমতউল্লাহ ওমরজাই, মোহাম্মদ নবী, রশিদ খান, নুর আহমেদ, মুজিব উর রহমান, ফজলহক ফারুকি, ফরিদ আহমেদ মালিক, আবদুল রহমান।

নেপাল

বাছাইপর্ব খেলে এশিয়া কাপে এসেছে। নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্ট এখন পর্যন্ত। তবে যেভাবে এগোচ্ছে নেপাল, একদিন হয়তো টেস্ট স্ট্যাটাসটাও পাবে। ক্রিকেটের প্রতি নিজেদের সিরিয়াসনেসটা বাছাইয়ে দেখিয়েছে তারা। গ্রুপে ভারত-পাকিস্তান থাকায় তাদের সুপার ফোরে যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে বলা তো যায় না, ক্রিকেটে অঘটনের ঘটনা তো কম নেই। আপাতত ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’-এর চেয়ে উপভোগ করাটার দিকে মনোযোগ দিয়ে এশিয়া কাপ খেলতে নামবে নেপাল। উদ্বোধনী বড় পরীক্ষায় নামতে হবে তাদের, প্রতিপক্ষ যে পাকিস্তান!

নেপাল স্কোয়াড: রোহিত পোডেল (অধিনায়ক), কুশল ভার্টেল, আসিফ শেখ, ভীম শারকি, কুশল মল্ল, আরিফ শেখ, দীপেন্দ্র সিং আইরি, গুলশান ঝা, সোম্পেল কামি, কারান কেসি, সন্দীপ লামিচানে, ললিত রাজবংশী, প্রতীশ জিসি, মওসুম ঢাকাল, সুন্দীপ জোরা, কিশোর মাহাতো, অর্জুন সৌদ।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: খেলার মাঠ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

16 − 16 =