কবিগুরুর প্রয়াণের দিনে চলে গেলেন কবি

‘সব শালা কবি হবে, পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে উড়বেই, দাঁতাল শুয়োর এসে রাজাসনে বসবেই’ কবি মোহাম্মদ রফিকের কবিতার এই লাইনগুলো সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের আসন কাঁপিয়ে দিয়েছিলো। সেই কবি সবাইকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন ২০২৩ সালের ৬ আগস্ট। একুশে পদক জয়ী এই কবি দীর্ঘদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। জীবনের আশিটি বসন্ত পৃথিবীতে কাটিয়ে ওপারের যাত্রী হলেন তিনি। তার কাছে জগতের শ্রেষ্ঠতম কবি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কাকতালীও ভাবেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবসে পরপারে পাড়ি জমালেন মোহাম্মদ রফিক। কবির জন্য শোক ও শ্রদ্ধা জানাচ্ছে রঙবেরঙ। তরুণ প্রজন্মের অনেক সাহিত্যপ্রেমীরাই জানেন না কবি মোহাম্মদ রফিকের কথা। তুলে ধরা হলো নন্দিত এই লেখকের কথা।

বাগেরহাটের অবাক কিশোর

কবি মোহাম্মদ রফিকের জন্ম ১৯৪৩ সালের ২৩ অক্টোবর। বাগেরহাট জেলার বৈটপুরে পিতা সামছুদ্দীন আহমদ ও মা রেশাতুন নাহারের ঘর আলোকিত করে এসেছিলেন তিনি। আট ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। বাগেরহাটেই কেটেছে কবির শৈশব ও কৈশোর। বেশ বর্ণিল একটা ছেলেবেলা কাটিয়েছেন তিনি। ছেলেবেলা থেকেই কবিতার প্রতি ঝোঁক ছিল মোহাম্মদ রফিকের। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার লেখালেখির শুরু নবম শ্রেণিতে, আমাদের গ্রাম বৈটপুরে। ওই সময় দেখলাম, আমি যা লিখি, সেগুলো কবিতার মতো হয়ে যায়! তো, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় থেকে জীবনানন্দ দাশ আমাকে দখল করলেন। পড়ালেখার সূত্রে দেশের নানা অঞ্চলে থেকেছি, বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে মিশেছি। এভাবেই বামপন্থী রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়লাম। উচ্চ মাধ্যমিকের পর যখন রাজশাহী কলেজে ভর্তি হয়েছি, ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। আইয়ুব খানের আমলে রাজশাহী কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা ছিলাম আমি। সে সময় আমার একদিকে ছিল রাজনীতি, অন্যদিকে সাহিত্য। তখন আবার জেলও খাটছি। রাতভর বই পড়তাম, ভোরে উঠে রাজনীতি করতাম, এই ছিল রুটিন। পরে ষাট দশকের মধ্যভাগে মস্কো ও চীন এই দুই শিবিরে যে মুহূর্তে পূর্ব বাংলার সমাজতান্ত্রিক কর্মীরা ভাগ হয়ে গেলেন, এই ভাগ আমার ঠিক সহ্য হলো না, আমার বন্ধুবান্ধব দুই শিবিরেই ছিলেন। ফলে একধরনের হতাশা থেকে রাজনীতি ছেড়ে দিলাম। বুঝে ফেললাম, সব রাজনীতিই অমানবিক। তারপর ঠিক করলাম, পুরোপুরি লেখালেখিতে মনোযোগ দেব। ততদিনে আমি ঢাকায় চলে এসেছি। যুক্ত হয়েছি কণ্ঠস্বর ও স্বাক্ষর-এর সঙ্গে।’

পড়ালেখা ও পেশা

সেই সময় ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকার নটরডেম কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন মোহাম্মদ রফিক। তবে সেখানে পড়া হয়নি তার। পরে ঢাকা কলেজে মানবিক বিভাগে ভর্তি হন। এ সময় কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয় যা তার সাহিত্যিক মনকে উদ্বেলিত করে। বিএ পাস করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে এমএতে ভর্তি হন। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করার পর তিনি জাহাঙ্গীরনগর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন।

মুক্তিযোদ্ধা ও প্রতিবাদি কবি

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মন দিয়েই কবিতা চর্চা শুরু করেন মোহাম্মদ রফিক। তিনি ১৯৬০-এর দশকের শুরুতে সমকাল, কণ্ঠস্বর, স্বাক্ষর, অচিরা ইত্যাদি পত্র-পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন। ১৯৭০ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বৈশাখী পূর্ণিমা’ প্রকাশিত হয়। তার কবিতায় নৈসর্গিক আবহে লালিত আধুনিক মানস-চেতনার ছাপ পাওয়া যায়। যেন শহরে নয়, গাঁয়ে থেকে গাঁয়ের কাব্যবয়ান করেছেন, নদীর পাশে বসে লিখেছেন নৌকোর দৌড়াদৌড়ি, নদীনির্ভর জীবনের ব্যস্ততা। ‘গাওদিয়া’ তার একটি বহুলপঠিত কাব্যগ্রন্থ। তিনি প্রধানত কবি হলেও কিছু গদ্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। কবিতা চর্চা করতে গিয়ে বার বার নিজেকে ভেঙেছেন আবার গড়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ তার কবিতার মধ্যে অন্যরকম এক পরিবর্তন এনে দেয়। এক সাক্ষাৎকারে কবি বলেছিলেন সে বিষয়ে, ‘১৯৭০ সালে বের হলো আমার প্রথম কবিতার বই বৈশাখী পূর্ণিমা। তবে তুমি বৈশাখী পূর্ণিমা আর ধুলোর সংসারে এই মাটি; আমার প্রথম ও দ্বিতীয় বইটি যদি পড়ো, দেখবে একদম আলাদা। এই যে আলাদা হলাম, এটি ঘটল ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের কারণে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ আমার ভেতরে আত্মবিশ্বাস এনে দেয়, যা আগে ছিল না। তখন মনে হয়েছিল, আমার মাটি-জল-হাওয়া আমি খুঁজে পেয়েছি। এখান থেকেই নতুনভাবে আমার অভিযাত্রার শুরু। এরপর কীর্তিনাশা থেকে তো ঘুরতে শুরু করল মোড়।’

এছাড়া তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘খোলা কবিতা’ ‘ধুলোর সংসারে এই মাটি’, ‘কীর্তিনাশা’, ‘কপিলা’, ‘স্বদেশী নিঃশ্বাস তুমিময়’, ‘মৎস্যগন্ধা’, ‘বিষখালী সন্ধ্যা’, ‘কালাপানি’, ‘নোনাঝাউ’, ‘ত্রয়ী’, ‘চিরহরিতের উপবাস’। কবিতার পাশাপাশি তার রয়েছে বেশ কয়েকটি গদ্যগ্রন্থ। এর মধ্য ‘ভালোবাসার জীবনানন্দ’ (২০০৩), ‘আত্মরক্ষার প্রতিবেদন’ (২০০১) ও ‘স্মৃতি বিস্মৃতির অন্তরাল’ (২০০২) অন্যতম। কবি মোহাম্মদ রফিক আয়ওয়াতে ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেন ১৯৯৩ সালে। মার্কিনিদের আয়ওয়া শহরের অভিজ্ঞতা, ভিন দেশের লেখকদের সঙ্গে কবির মতবিনিময়, দেশ-বিদেশের সাহিত্যের খবর ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয় তার ‘দূরের দেশ নয় আয়ওয়া’ বইটি। নব্বইয়ের দশকে বেশ কিছু ছোটগল্প লেখেন তিনি।

যে কবিতার জন্য আলোচিত রফিক

কবি হিসেবে চিরকালই প্রতিবাদি মোহাম্মদ রফিক। সেই পাকিস্তানের সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। পাকিস্তানের সামরিক আদালত তাকে দশ বছরের কারাদণ্ড দেয়, কিন্তু এমএ পরীক্ষার জন্য তিনি ছাড়া পান। ১৯৭১ সালে তিনি প্রথমে মুক্তিযুদ্ধের ১নং সেক্টরের কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। পরে স্বাধীন বাংলা বেতারে কাজ শুরু করে। কবি রফিক শুধু একজন কবিই ছিলেন না রাজ পথের লড়াকু সৈনিক ছিলেন তিনি। এ ছাড়া মননশীল আধুনিক কবি হিসেবে পরিচিত রফিক আলোচিত হয়ে আছেন গত শতকের আশির দশকে সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের বিরাগভাজন হয়ে। এরশাদকে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন ‘খোলা কবিতা’ নামে আলোড়ন তোলা কবিতা, যার কয়েকটি পঙক্তি ছিল এমন ‘সব শালা কবি হবে, পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে উড়বেই, দাঁতাল শুয়োর এসে রাজাসনে বসবেই’। এই কবিতা তখন কেউ ছাপাতে সাহস পায়নি। গোপনে তা ছাপানো হয় এক ছাপাখানায়। নিউজপ্রিন্টে এক ফর্মায় ছাপানো সেই কবিতা গোপনে বিলি করেন মোহাম্মদ রফিকের ছাত্র-ছাত্রীরা। এভাবে হাতে হাতে সেই কবিতা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। মোহাম্মদ রফিকের যে কবিতা ক্ষিপ্ত করেছিল এরশাদকে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে কাব্যিক রসদ জুগিয়ে তোলা এই কবিতার জন্য মোহাম্মদ রফিককে সেনানিবাসে ডেকে নেওয়া হয়েছিল। তার নামে হুলিয়াও জারি হয়। তাকে কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছিল।

প্রপ্তি-অপ্রাপ্তি

১৯৮১ সালে আলাওল পুরস্কার, ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ২০১০ সালে একুশে পদকসহ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন কবি মোহাম্মদ রফিক। ২০১৭ সালে কবি মোহাম্মদ রফিক জেমকন পুরস্কার পান। ২০১৮ সালে সৃজনশীল শাখায় মোহাম্মদ রফিকের কবিতার বই ‘মানব পদাবলি’ পেয়েছে প্রথম আলো বর্ষসেরা বই পুরস্কার। ২০২০ সালে এই লেখক ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়া নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত তিনি।

মোহাম্মদ রফিকের পরিবার

ব্যক্তিজীবনে মোহাম্মদ রফিকের সহধর্মিনী ছিলেন জিনাত আরা রফিক। যিনি ২০০৫ সালের ৭ ডিসেম্বর মারা যান। দুই ছেলে শুভস্বত্ব রফিক ও শুদ্ধস্বত্ব রফিক। অবসর জীবনে কবি তার উত্তরার নিজ বাড়িতে বসবাস করতেন। মোহাম্মদ রফিকের পরিবারের অনেকেই দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। রফিকের ভাইদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক অর্থ সচিব মোহাম্মদ তারেক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মোহাম্মদ নাসের।

গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে অসুস্থ

মৃত্যুর তিন দিন আগে নিজের ছেলের সাথে বাগেরহাটে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন মোহাম্মদ রফিক। সেখানে দিয়ে হঠাৎ করেই অসুস্থ বোধ করলে প্রথমে বাগেরহাটের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে বরিশাল মেডিকেলে নেওয়া হয়। তারপর চিকিৎসকের পরামর্শে ঢাকায় আনার পথে তার মৃত্যু হয়। পরে গ্রামে নিয়ে আসা হয় তার মরদেহ।

বাবা-মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় কবি

বাগেরহাট সদর উপজেলার বেমরতা ইউনিয়নের চিতলী-বৈটপুর গ্রামে নিজ বাবা-মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি মোহাম্মদ রফিক। চিতলী-বৈটপুর এলাকায় উদ্দিপন বদর সামছু বিদ্যা নিকেতনে নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। আর স্বশরীরে কোথাও দেখা যাবে না কবিকে। তিনি বেঁচে থাকবেন তার কবিতায়।

 লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্মৃতিচারণ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

five × four =