মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তৈরি সিনেমা

‘চাকা’, ‘দিপু নাম্বার টু’, ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ এমন জনপ্রিয় সিনেমাগুলোর নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম। মৌ সন্ধ্যার প্রতিবেদনে রঙবেরঙের এই সংখ্যায় আমরা আলো ফেলবো মোরশেদুল ইসলাম নির্মিত ‘খেলাঘর’ সিনেমায়।

মুক্তির আলোয় ‘খেলাঘর’

মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট নিয়ে কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘খেলাঘর’ অবলম্বনে মোরশেদুল ইসলাম নির্মাণ করেছেন ‘খেলাঘর’ সিনেমাটি। ১৩০ মিনিট দৈর্ঘ্যরে এই সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল ২০০৬ সালে। চলচ্চিত্র সমালোচকদের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয় চলচ্চিত্রটি। তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে এসব চলচ্চিত্রের কোনো বিকল্প নেই।

যাদের অভিনয়ে আলোকিত ‘খেলাঘর’

এক ঝাঁক প্রিয় মুখের দেখা মেলে এই চলচ্চিত্রে। সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন রিয়াজ, সোহানা সাবা, আরমান পারভেজ মুরাদ, গাজী রাকায়েত, আবুল হায়াত প্রমুখ। প্রত্যেকে তাদের অভিনয়ের মাধুরী ছড়িয়েছেন নিজের মতো করে। সিনেমাটির প্রযোজক ছিলেন কণা রেজা, মো. মোখলেছুর রহমান, হুমায়ুন কবির শিল্পী ও কাজী জাহিদ হাসান। চিত্রগ্রাহক ছিলেন এল. অপু রোজারিও। সম্পাদনায় ছিলেন রতন পাল ও পরিবেশক ছিল মমন চলচ্চিত্র।

কী আছে খেলাঘরে?

কেন সিনেমাটি দেখা প্রয়োজন। নতুন দর্শকদের মনে কিছুটা হলেও আগ্রহ তৈরি করবে সিনেমার এই মারমর্ম। নয় মাসব্যাপী চলে স্বাধীনতার যুদ্ধ। ষড় ঋতুর এই দেশে যুদ্ধের সময়টায় ছিল বর্ষাকাল। খেলাঘর সিনেমায় দেখা যায়, ১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত একটি গ্রামেও তখন ঝুম বর্ষাকাল। ইয়াকুব (রিয়াজ) আর মুকুল (আরমান পারভেজ মুরাদ) দুই বন্ধু। ইয়াকুব ঢাকা থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে গ্রামের কলেজে শিক্ষকতা করছে। মুকুল গ্রামেই পড়াশোনা করে গ্রামেই শিক্ষকের পেশা বেছে নিয়েছে। ইয়াকুব একটু ভীরু প্রকৃতির, দেশের প্রতি ভালবাসার অভাব না থাকলেও দ্বিধা ও সাহসের অভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া ওর পক্ষে সম্ভব হয়নি। মুকুল সরাসরি যুদ্ধে যোগ না দিলেও যুদ্ধের সাথে জড়িত হয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করাই ওর প্রধান কাজ। দুই বন্ধুর দিন কেটে যেত অনেকটা নিস্তরঙ্গভাবে, যুদ্ধের ডামাডোল আর দুর্গম গ্রামে অবস্থান করায় নিরাপত্তার মাঝে।

এমনি সময় শহর থেকে একদল শরণার্থীর সাথে গ্রামে আসে রেহানা (সোহানা সাবা)। রেহানা ইয়াকুবের বন্ধুর বোন, কিন্ত কখনও দেখা হয়নি ওদের। বন্ধুর অনুরোধ, আশ্রয় দিতে হবে রেহানাকে, ক’দিনের জন্য। রেহানা হাসিখুশি চঞ্চল মেয়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো, ২৫শে মার্চে ছিল রোকেয়া হলে। মাঝে মাঝেই কেমন বিমর্ষ হয়ে যায় ও, কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। কী এক গোপন ব্যথা যেন সবসময় তাড়িয়ে বেড়ায় ওকে, ভেঙে দিতে চায় ওর সুন্দর-স্বপ্নময় জীবনটাকে। রেহানাকে আশ্রয় দেওয়া নিয়ে বিপদে পড়ে যায় দুই বন্ধু। অবশেষে গ্রামের এক প্রান্তের একটি পরিত্যক্ত জমিদার বাড়িতে রেহানাকে নিয়ে আশ্রয় নেয় ইয়াকুব। চারিদিকে তখন বর্ষার পানি, গাছপালা আর বন-জঙ্গলে ঘেরা বহুকালের পুরানো, জীর্ণ বাড়িতে এক তরুণ-তরুণীর হৃদয়ের রক্তক্ষরণ আর ভালবাসার গল্প রচিত হয় দু’দিনের খেলাঘরে। রেহেনা যেন বাংলাদেশের প্রতিকৃতি। একবুক ভালবাসা দিয়ে কীভাবে আগলে রাখবে ইয়াকুব? সবমিলিয়ে যুদ্ধ আর ভালবাসার চিরন্তন কাহিনি নিয়ে নির্মাণ হয় ‘খেলাঘর’।

বিদেশের মাটিতে ‘খেলাঘর’

শুধু দেশেই নয় বিশে^র আরও কয়েকটি দেশে প্রদর্শিত হয়েছে ‘খেলাঘর’। প্রশংসা কুড়িয়েছে। দেশে মুক্তির পর সিনেমাটি ২০১০ সালে লন্ডনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। একই বছর সুইজারল্যান্ডে জেনেভায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। ২০১১ সালে কলকাতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। ২০১২ সালে আগরতলা ও নতুন দিল্লিতেও প্রদর্শিত হয় চলচ্চিত্রটি। একই বছর শ্রীলঙ্কায় সার্ক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় সিনেমাটি।

খেলাঘর নিয়ে মূল্যায়ন

সিনেমাটি নিয়ে বিভিন্ন সময় রিভিউ লিখেছেন অনেকেই। ২০১৯ সালে গৌতম কে শুভ খেলাঘর নিয়ে লেখা এক আলোচনায় একটা বিষয় উল্লেখ করেন। সেখানে বলা হয়, ‘মাহমুদুল হকের ‘খেলাঘর’ আর মোরশেদুল ইসলামের ‘খেলাঘর’ আলাদা দুটি ক্যানভাস। তবে এই দুই খেলাঘরের মধ্যে দু’জন স্রষ্টার চেতনার ঐক্য আছে, সেই চেতনার নাম ‘মুক্তিযুদ্ধ’। সেই কারণেই হয়তো এই উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মনের ভাষার সাথে চলচ্চিত্র পরিচালক সৃষ্ট চরিত্রদের মধ্যে চমৎকার বোঝাপড়া দেখা যায়। সিনেমাটি দেখে অবশ্য মনে হয়, কিছু জায়গায় বেশ তাড়াহুড়া ছিলো। অবশ্য গল্পটি পুরো রেহানাকেন্দ্রিক হওয়ায় তার কোনো ঘটনা যাতে বাদ না পড়ে সেজন্য হয়তো উপন্যাসের তুলনায় সিনেমাতে অন্য চরিত্রগুলোকে পরিমিত মাত্রায় পর্দায় হাজির করা হয়েছে।

এই সিনেমার কেন্দ্রীয় তিন চরিত্রের মধ্যে সোহানা সাবার অভিনয় সবচেয়ে বাস্তবসম্মত ছিল। পর্দায় আরমান পারভেজ মুরাদের চেয়ে রিয়াজের উপস্থিতি বেশি থাকলেও অভিনয়ে স্বতঃস্ফূর্ততার দিক থেকে রিয়াজ কিছুটা পিছিয়ে ছিলেন। গঠনের দিক থেকে ‘খেলাঘর’ অন্যসব মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের গল্প থেকে খানিকটা আলাদা। পর্দায় যুদ্ধকে সরাসরি তেমন হাজির না করলেও পাকসেনাদের বর্বরতা এবং তা থেকে সৃষ্ট বিপর্যয় ভালোভাবেই তুলে ধরা হয়েছে। সবদিক দিয়ে দেখলে এই সিনেমাকে যুদ্ধদিনের প্রেমের দলিল বলা যায়।’

একনজরে মোরশেদুল ইসলাম

মোরশেদুল ইসলাম বরেণ্য একজন চলচ্চিত্রকার। তার নির্মিত সিনেমায় ফুটে উঠে বাংলাদেশের সৌন্দর্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, মাটি ও মানুষের গল্প এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। দীর্ঘ চলচ্চিত্রজীবনে তিনি উপহার দিয়েছেন অনেক কালজয়ী সিনেমা। দেশে-বিদেশে অর্জন করেছেন অনেক স্বীকৃতি। ১ ডিসেম্বর এই গুণী চলচ্চিত্রকারের জন্মদিন। ১৯৫৭ সালে পুরান ঢাকার লালবাগের উর্দু রোডে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। শিক্ষাজীবন শুরু পুরান ঢাকার চাঁদনীঘাট এলাকার একটি প্রাইমারি স্কুলে। এরপর তিনি ভর্তি হন এক সময়ের বিখ্যাত নবকুমার ইনস্টিটিউশনে। এখানে তিনি সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পরে ওয়েস্টার্ন হাইস্কুল থেকে ১৯৭৪ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হন। পরে পরিবারের ইচ্ছায় তিনি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এর দুই মাস পর আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগে ভর্তি হন।

১৯৮৪ সালে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আগামী’ পরিচালনার মাধ্যমে চলচ্চিত্রাঙ্গনে যাত্রা শুরু করেন মোরশেদুল ইসলাম। ১৯৮৫ সালে সিনেমাটি তাকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে সেরা পরিচালকের স্বীকৃতি এনে দেয়। নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত ১০ম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও চলচ্চিত্রটি প্রদর্শিত হয় এবং তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালনার জন্য ‘রৌপ্য ময়ূর’ অর্জন করেন। ১৯৯৩ সালে সেলিম আল দীন রচিত ‘চাকা’ গল্প অবলম্বনে নির্মাণ করেন কালজয়ী সিনেমা ‘চাকা’। এটি এক লাশ বহনকারী গরুর গাড়ি এবং গাড়োয়ানের গল্প। চলচ্চিত্রটি মানহাইম-হেইডেলবার্গ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং তিনি পরিচালনার জন্য আন্তর্জাতিক জুরি পুরস্কার লাভ করেন। পরের বছর ডানকার্ক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে চলচ্চিত্রটি প্রদর্শিত হয় এবং শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে ‘গ্রাঁ প্রিঁ’ ও পরিচালনার জন্য আন্তর্জাতিক জুরি পুরস্কার অর্জন করে। ১৯৯৬ সালে মুহম্মদ জাফর ইকবাল রচিত কিশোর উপন্যাস ‘দীপু নাম্বার টু’ অবলম্বনে নির্মাণ করেন ‘দীপু নাম্বার টু’ সিনেমা। দুই কিশোরের দুঃসাহসিক ভ্রমণ ও দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রক্ষার পটভূমি নিয়ে এই ছায়াছবির গল্প। চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্রে অভিনেতা ও শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। এটি ঢালিউড ইতিহাসে অন্যতম একটি সফল সিনেমা।

পরের বছর তার নিজের লেখা কাহিনি নিয়ে নির্মাণ করেন ‘দুখাই’। প্রাকৃতিক দুর্যোগ পরিস্থিতিতে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবনসংগ্রাম এই ছায়াছবির উপজীব্য বিষয়। চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ ৯টি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। ২০০৪ সালে জনপ্রিয় সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ রচিত উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করেন ‘দূরত্ব’। চলচ্চিত্রটি শিশুশিল্পী বিভাগে শ্রেষ্ঠ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। চলচ্চিত্রটি ২০০৬ সালে লন্ডনে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। ২০০৬ সালে মাহমুদুল হক রচিত উপন্যাস ‘খেলাঘর’ অবলম্বনে নির্মাণ করেন ‘খেলাঘর’ সিনেমা। ২০০৯ সালে হুমায়ূন আহমেদ রচিত ‘প্রিয়তমেষু’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করেন ‘প্রিয়তমেষু’। দুই নারীর প্রতিবাদের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এই চলচ্চিত্রে। সিনেমাটি ২০১২ সালে সার্ক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। চলচ্চিত্রটি ২০১৪ সালে বাচসাস পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ও শ্রেষ্ঠ পরিচালকসহ ৭টি বিভাগে পুরস্কার লাভ করে। ২০১১ সালে মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করেন ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ সিনেমা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন এক কিশোরের যুদ্ধে অবদান চিত্রিত হয়েছে এই ছায়াছবিতে। চলচ্চিত্রটি ২০১২ সালে নয়াদিল্লিতে আয়োজিত ৩য় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। ২০১৩ সালে প্রদত্ত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ৩টি বিভাগে পুরস্কার অর্জন করে। এছাড়া ২০১৫ সালে চলচ্চিত্রটি জয়পুরহাটে আয়োজিত ১ম শিশু চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়।

২০১৫ সালে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করেন ‘অনিল বাগচীর একদিন’। একই বছর চলচ্চিত্রটি কলম্বো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব এবং ব্যাংককের ওয়ার্ল্ড ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয়। ২০১৬ সালে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব প্রদর্শিত হয় এবং জুরি স্পেশাল মেনশনে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার অর্জন করে। এছাড়া ৪০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র এবং শ্রেষ্ঠ পরিচালক বিভাগে পুরস্কার লাভ করেন। অনেক দিন নতুন সিনেমা নির্মাণ করেননি মোরশেদুল ইসলাম। তার নতুন চমকের অপেক্ষায় আছেন দর্শক।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

five + 18 =