কিভাবে এলো চকলেট

গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত: বিশেষ দিনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে মিশে আছে মিষ্টান্ন। প্রিয় মানুষের জন্মদিনে চকলেট উপহার দেওয়া যেন নিয়ম হয়ে গেছে। গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে থালায় সাজিয়ে রাখা হয় বাহারি স্বাদের চকলেট। পাড়ার দোকান গুলোতে সাজান থাকে মুখরোচক চকলেট। দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় যেকোনো বয়সের মানুষের চোখ আটকে যাবে। বুড়ো কিংবা শিশু যেকোনো বয়সের মানুষের কাছে রয়েছে চকলেটের গ্রহণযোগ্যতা। এই চকলেট নিয়ে কিছু তথ্য তা জেনে নেওয়া যাক এবারের আয়োজনে।

এই খাবারটি এতটাই জনপ্রিয় যে আলাদা করে ‘চকলেট দিবস’ পালিত হয় নানা আয়োজনে। অবশ্য বিশ্বের একেক দেশে একেকদিন পালিত হয় এ দিবস। যদিও স্বীকৃত চকলেট দিবস ৭ জুলাই। ইউরোপে ১৫৫০ সাল থেকে এদিন চকলেট দিবস পালিত হয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় চকলেট দিবস পালিত হয় ২৮ অক্টোবর। ঘানাতে কোকো সেলিব্রেটস দিবস পালিত হয় ১৪ ফেব্রুয়ারি। তেতো মিষ্টি চকলেট দিবস ১০ জানুয়ারি, মিল্ক চকলেট দিবস ২৮ জুলাই, সাদা চকলেট দিবস ২২ সেপ্টেম্বর এবং চকলেট কভারিং দিবস ১৬ ডিসেম্বর।

এই দিনটি নিয়ে রয়েছে নানা ইতিহাস। তবে বেশি গ্রহণযোগ্য কাহিনি হলো, ১৫৫০ সালে ইউরোপে চকোলেট প্রবর্তনকে স্মরণ করতেই দিনটি পালিত হয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল কনফেকশনার্স অ্যাসোসিয়েশন চিনিযুক্ত খাবার উদ্যাপনের জন্য একটি বিশেষ দিন মনোনীত করে। কিছু সূত্র অনুযায়ী, ২০০৯ সালে প্রথম বিশ্ব চকোলেট দিবস পালিত হয়েছিল। অনেকের প্রশ্ন, চকলেট নাম আসলো কিভাবে। ‘চকলেটের সত্য ইতিহাস’ (থেমস এবং হাডসন, ২০১৩) বইয়ের লেখক ইতিহাসবিদ সোফি এবং মাইকেল কো’র মতে, চকলেট শব্দটি এসেছে অ্যাজটেক শব্দ ‘জোকোয়াটল’ থেকে।

ধারণা করা হয়, বোস্টনে ১৬৮২ সালে প্রথম আমেরিকান চকলেট হাউজ খোলা হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় বেশকিছু চকলেট উৎপাদকারী কোম্পানি তৈরি হয় বিশ্বের নানা অঞ্চলে। ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ‘বেকারস চকলেট’ আমেরিকার প্রথম চকলেট কোম্পানি। ২০৩০ সালে কাঁটায় কাঁটায় ২৫০ বছরে পা দিবে বৃহত্তর চকলেট কোম্পানিটি।

চকলেট তৈরির প্রধান কাঁচামাল কোকো গাছের ফল। ফলগুলোর একেকটিতে ৪০টির মতো বিন বা গুটি থাকে। গুটিগুলো শুকিয়ে, তারপর পুড়িয়ে বানানো হয় কোকো বিন। ১১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে মধ্য আমেরিকায় কোকো গাছ ও এই গাছের বীজ অত্যন্ত মূল্যবান বস্তু হিসেবে সবার কাছে পরিচিত ছিল। গ্রিক ভাষায় কোকো গাছকে বলা হয় ‘থিওব্রোমা ক্যাকাও’। উদ্ভিদটির বৈজ্ঞানিক নাম হলো ‘থিওব্রোমা কোকো’। এর অর্থ দেবতাদের জন্য খাদ্য। ৫০০ গ্রাম চকোলেট তৈরিতে ৪০০টি পর্যন্ত কোকো বীজ প্রয়োজন হয়। চকলেট তৈরির জন্য ব্যবহৃত বেশিরভাগ কোকো উৎপাদন হয় আফ্রিকার দেশ আইভরি ও ঘানাতে। শুধুমাত্র ইউরোপ ও আমেরিকাতে বছরে প্রায় ৩০ লক্ষ টনের বেশি কোকো বীজ কেনা-বেচা হয়ে থাকে। কোকো গাছের বীজ থেকে গাজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফ্লেভার উৎপন্ন করা হতো। তারপর তা শুকিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে তাপ দিয়ে বীজের খোসা ছাড়ান হতো। খোসা ছড়ানোর পর যা অবশিষ্ট থাকতো তা হলো নিব। আর এই নিবের সঙ্গেই বিভিন্ন মসলার সংমিশ্রণে তৈরি করা হতো চকলেট। বিজ্ঞানীদের মতে, ৪০০০ বছর আগে মেক্সিকোতে প্রথম কোকো গাছের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে অ্যাজটেকরা প্রথম চকলেট পানীয় হিসেবে পান করা শুরু করে ২৫০০ বছর আগে থেকে। সে হিসেবে চকলেটের ইতিহাস আড়াই হাজার বছর পুরোনো। যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথসোনিয়ার ন্যাশনাল মিউজিয়ামের কালচারাল আর্ট কিউরেটর হায়েস লেভিস জানান, খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকেই প্রাচীন ওলমেক সভ্যতার মানুষ নৌযান ভরে কোকো ফল নিয়ে আসতেন।

বিখ্যাত পরিব্রাজক কলম্বাস ইউরোপে কোকো বীজ প্রথম নিয়ে আসলেও বিখ্যাত স্প্যানিশ যোদ্ধা হার্নান কোর্টেসের মাধ্যমে ইউরোপে শোকোলাটল পানীয় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তিনি কোকো বীজ মেক্সিকো থেকে জাহাজে করে নিয়ে এসে শোকোলাটল তৈরি করে এটির সঙ্গে চিনি ও অন্যান্য সুগন্ধি জাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে স্পেনের রাজা পঞ্চম চার্লসকে খেতে দেন। এটি পান করে রাজা অত্যন্ত খুশি হন। ক্রমেই স্পেনের রাজ পরিবারে এই পানীয় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। স্প্যানিশ রাজকুমারী মারিয়া থেরাসা ও ফরাসি রাজা চতুর্দশ লুইয়ের মধ্যে বিয়ে ঠিক হলে মারিয়া থেরেসা উপহার হিসেবে এই কোকো বীজ ফরাসি রাজ পরিবারে পাঠায়। সেখান থেকে ফ্রান্সেও চকলেটের আদিরূপ শোকোলাটল ছড়িয়ে পড়ে।

চকলেট আবিষ্কারে প্রধান অবদান রেখেছে মধ্য আমেরিকার মায়া ও অ্যাজটেক সভ্যতা। তবে চকলেটের প্রসারে ও উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে ইউরোপীয়রা। মায়া সভ্যতার লোকেরা চকলেট শুধু পানই করতো না, একে খুব সমীহও করতো। বিশেষ লেনদেন চূড়ান্ত করার অনুষ্ঠানে চকলেট পানীয় পরিবেশন করা হতো। মায়া সভ্যতার সময়ে চকলেট ছিল ঘন ও ফেনাময়। এমনকি তার সঙ্গে লাল মরিচ, মধু কিংবা পানি মেশানো হতো। ঊনিশ শতকে এসে পানীয় চকলেট থেকে সলিড চকলেটের আবির্ভাব ঘটে।

১৪২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত অ্যাজটেক সভ্যতার মানুষ চকলেটকে আরেকটি স্তরে নিয়ে গেছেন। তারা বিশ্বাস করতেন, এটি স্বয়ং ঐশ্বরিক উপহার। মায়াদের মতোই তারাও সুসজ্জিত পাত্রে গরম ও ঠান্ডা ক্যাফেইন, স্পাইসড চকলেট পানীয় পান করতেন। খাবার ও অন্যান্য পণ্য কিনতে তারা মুদ্রা হিসেবেও কোকো বিন ব্যবহার করতেন। প্রাচীনকালে, কোকোয়া বীজ থেকে এক ধরনের তেতো স্বাদযুক্ত পানীয় তৈরি করা হতো। এই পানীয় তিক্ত হলেও তখনকার সময়ে এটি অভিজাত শ্রেণির মানুষের কাছে জনপ্রিয় ছিল। বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসবে এই পানীয় পান করা হতো। এই পানীয় অত্যন্ত মূল্যবান হওয়ায় তা সাধারণ মানুষের পক্ষে কিনে খাওয়া সম্ভব ছিল না। এই গাছ এতটাই মূল্যবান ছিল যে, কোকো গাছের বীজ মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার হতো। অ্যাজটেক সংস্কৃতিতে কোকো বিনকে স্বর্ণের চেয়ে দামি হিসেবে গণ্য করা হতো। অ্যাজটেক চকলেট ছিল মূলত উচ্চবিত্তের বিলাসিতা; যদিও বিয়ে কিংবা অন্যান্য অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে মাঝে মধ্যে নিম্নবিত্তরাও এর স্বাদ উপভোগ করতেন। অ্যাজটেক চকলেটের সমাদর করেছিলেন দাপুটে শাসক দ্বিতীয় মন্টেজুমার। ১৪৬৬ সালে জন্ম নেওয়া এই অ্যাজটেক শাসক বেঁচে ছিলেন ১৫২০ সাল পর্যন্ত।

১৫০০ দশকের শেষভাগে স্প্যানিশ দরবারে চকলেট বেশ সমাদৃত হয়। অন্যদিকে স্পেন চকলেট আমদানি শুরু করে ১৫৮৫ সালে। ইতালি ও ফ্রান্সসহ অন্য যেসব ইউরোপীয় দেশের অভিযাত্রীরা সেন্ট্রাল আমেরিকায় ভ্রমণ করতেন, তারাও সেখানে চকলেটের খোঁজ পান এবং নিজ নিজ দেশে নিয়ে আসেন। ১৬৪১ সালে একটি স্প্যানিশ জাহাজে করে ফ্লোরিডায় চকলেট আনা হয়। ধারণা করা হয়, ১৬৮২ সালে বোস্টনে প্রথম আমেরিকান চকলেট হাউস চালু হয়। ১৭৭৩ সালের দিকে একটি বড় আমেরিকান উপনিবেশে কোকো বিন আমদানি করা হয়। সেখানকার সব শ্রেণির মানুষ উপভোগ করতে থাকেন চকলেটের স্বাদ। ১৭৭৫ থেকে ১৭৮৩ সাল, আমেরিকান বিপ্লবের দিনগুলোতে সামরিক বাহিনীর রেশন তালিকায় যুক্ত হয় চকলেট; কখনো কখনো সৈনিকদের বেতন হিসেবে টাকার বদলে এটি দেওয়া হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও সৈনিকদের রেশন হিসেবে চকলেট দেওয়া হয়েছে। ১৮২৮ সালে ডাচ রসায়নবিদ কোয়েনরাড জোহানেস ভ্যান হাউটেন লবণের ক্ষারের সঙ্গে কোকো বিন মিশিয়ে এক ধরনের পাউডার চকলেট উদ্ভাবন করেন, যেটি খুব সহজেই পানিতে মিশিয়ে পান করা যেত। প্রক্রিয়াটি ‘ডাচ প্রসেসিং’ নামে খ্যাতি পায়। এভাবে বানানো চকলেটকে ডাকা হয় কোকো পাউডার বা ‘ডাচ কোকো’।

১৮৪৭ সালে জোসেফে ফ্রে বিশেষ উপায়ে চকলেট পেস্ট তৈরি করেন; যার মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠেন আধুনিক চকলেটের জনক। ঊনবিংশ শতকের বেশির ভাগ সময় চকলেটকে পানীয় হিসেবেই উপভোগ করা হতো; কখনো কখনো তাতে পানির বদলে মেশানো হতো দুধ। ১৮৪৭ সালে ব্রিটিশ চকলেট কোম্পানি জে এস ফ্রাই অ্যান্ড সন্স প্রথমবার চিনি, তরল চকলেট ও কোকো বাটার মিশিয়ে চকলেট বার উৎপাদন করে। ১৮৭৬ সালে সুইস চকলেট ব্যবসায়ী ড্যানিয়েল পিটার প্রথম চকলেটের সঙ্গে গুঁড়া দুধ মিশিয়ে মিল্ক চকলেট উৎপাদন করেন। এর কয়েক বছর পরই বন্ধু হেনরি নেসলের সঙ্গে তিনি ‘নেসলে’ কোম্পানি গড়ে তোলেন এবং মিল্ক চকলেটকে বড় পরিসরে বাজারে ছড়িয়ে দেন। ঊনবিংশ শতক ধরেই বাজারে চকলেট বেশ দাপট দেখালেও তখনো সেটি ছিল শক্ত, এবং চুষে খাওয়ার অনুপযুক্ত। ১৮৭৯ সালে, আরেক সুইস চকলেট ব্যবসায়ী রুডলফ লিন্ড এমন এক মেশিন উদ্ভাবন করেন, যেটি এমনভাবে মিশ্রণ ঘটাতে সক্ষম, যার ফলে চকলেট হয়ে ওঠে মসৃণ ও কোমল। ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ ও বিংশ শতকের প্রথমভাগে ক্যাডবুরি, মার্স, নেসলে ও হার্সলের মতো কোম্পানিগুলো বিপুল পরিমাণ মিষ্টি চকলেট উৎপাদন ও বাজারজাত করতে থাকে।

সম্প্রতি গবেষণা করা হয়েছে চকলেট কেন এতো জনপ্রিয়। ইংল্যান্ডে ইউনিভার্সিটি অব লিডসের একদল বিজ্ঞানী চকলেটের প্রাকৃতিক উপাদান বিশ্লেষণ করেছেন। তারা দেখেছেন, চকলেট মুখে পুরলে এতে থাকা চর্বি মুখের ভেতর একটা পাতলা আবরণ তৈরি করে। এই আবরণ মুখের ভেতর সৃষ্টি করে একটা কোমল অনুভূতি। আবার চকলেটের বিভিন্ন উপাদান ও লালা মিলেমিশে অনুভূতিটা করে তোলে আরও জমজমাট। মুখে চকলেট নেওয়ার পর যে কোমল অনুভূতির সৃষ্টি হয়, তাতে আদতে বেশ কিছু বিষয় কাজ করে থাকে। চকলেটের উপাদানগুলো ও লালাগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত লালা মিলে কিংবা আলাদাভাবে এ কোমল অনুভূতির সৃষ্টি করতে পারে। চকলেট জিবের সংস্পর্শে আসামাত্র চর্বি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একই সঙ্গে কোকোয়া বীজের শাঁস যখন মুখের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তা সংবেদনশীল স্পর্শের অনুভূতি সৃষ্টি করতে ভূমিকা রাখে। তবে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, চকলেটে চর্বির পরিমাণ কমালেও এর স্বাদে তেমন তারতম্য হবে না। লিডস ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক অন্বেষা সরকার বলেন, চকলেটে ৫ কিংবা ৫০ শতাংশ, যতটুকু চর্বিই থাকুক না কেন, ওই চকলেট মুখে নেওয়ার পরের অনুভূতির কোনো পরিবর্তন হয় না। এজন্যই এটা এতটা জনপ্রিয়। অন্যদিকে, চকলেট কিন্তু শরীরের জন্য খুবই উপকারী। ডার্ক চকলেট অ্যান্টি অক্সিডেন্টে পূর্ণ। যা রক্ত চাপ কমাতে ও কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্যের উন্নতি করে। তাই শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখতে খেতে পারেন ডার্ক চকলেট। চকলেট খেলে ভালো থাকবে আপনার হার্ট এবং ব্রেইনও।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: আবিষ্কার

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three × one =