খ্রিষ্টীয় মাসের নামকরণ

জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল, মে, জুন, জুলাই, অগাস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর; সদ্য স্কুলের গণ্ডিতে পা দেওয়া শিশুও বলে দিবে বারো মাসের নাম এগুলো। প্রযুক্তির অগ্রগতির জন্য আমাদের ঘরের দেয়ালে ক্যালেন্ডার শোভা পায় না। কিন্তু নিজেদের মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে তারিখ আর মাসের হিসেব ভেসে থাকে। বর্তমানে যে ক্যালেন্ডার ব্যবহার করে থাকি তা মূলত গ্রেগরিয়ান বা খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডার।

মানুষ যখন প্রথম বর্ষ গণনা করতে শিখল, তারা বছর হিসাব করতো চাঁদের কথা মাথায় রেখে। অমাবস্যা, পূর্ণিমা ইত্যাদি বিচার করে বছর গোনা হতো। এরপর মিশরীয়রা প্রথম সূর্য দেখে বছর হিসাব করলো, যাকে বলে সৌরবর্ষ। গ্রিকদের কাছ থেকে বর্ষপঞ্জিকা পেয়েছিল রোমানরা। তারা কিন্তু ১২ মাসে বছর গুনত না, তাদের বছরে ছিল ১০ মাস। শীতের দুই মাস বাদ দিয়ে ৩০৪ দিনে বছর হিসাব করতো রোমানরা। ১ মার্চ উদ্যাপন করতো নববর্ষ। পরবর্তীতে রোমের সম্রাট নুমা জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাস দুটি রোমান ক্যালেন্ডারে অন্তর্ভুক্ত করেন। পরে মারসিডানাস নামে আরও একটি মাস যুক্ত করেন তিনি। তখন থেকে রোমানরা ১ জানুয়ারি নববর্ষ পালন করতে শুরু করে, কিন্তু সেটা আনুষ্ঠানিক ছিল না। ১ মার্চও নববর্ষ উদ্যাপিত হতো।

১৫৩ খ্রিষ্টপূর্বে প্রথম রোমানরা ১ জানুয়ারি নববর্ষ পালন করেছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে ১ জানুয়ারি নববর্ষ পালন শুরু হয় সম্রাট জুলিয়াস সিজারের আমল থেকে। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬ অব্দে সম্রাট জুলিয়াস সিজার একটি নতুন বর্ষপঞ্জিকার প্রচলন ঘটান। রোমানদের আগের বর্ষপঞ্জিকা ছিল চন্দ্রবর্ষের, সম্রাট জুলিয়াসেরটা হলো সৌরবর্ষের। তিনি মূলত মিশরীয় বর্ষপঞ্জিকা নিয়ে আসেন। জ্যোতির্বিদদের সঙ্গে আলাপ করে জুলিয়াস সিজার সে বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের মাঝে ৬৭ দিন ও ফেব্রুয়ারির পর ২৩ দিন যুক্ত করে ক্যালেন্ডার সংস্করণ করেন। এই ক্যালেন্ডার জুলিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। এখানে মার্চ, মে, কুইন্টিলিস ও অক্টোবর মাসের দিন সংখ্যা ৩১ এবং জানুয়ারি ও সেক্সটিনিস মাসের সঙ্গে দু’দিন যুক্ত করে ৩১ দিন করা হয়। ফেব্রুয়ারি মাস গণনা হতে থাকে ২৮ দিনেই। ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতি চার বছর পরপর যুক্ত করা হয় একদিন। এভাবে আসে লিপইয়ার। রোমানদের দরজা ও ফটকের দেবতা ছিলেন জানুস। তার নামের সঙ্গে মিলিয়ে জানুয়ারি মাসের নাম হওয়ায় জুলিয়াস ভাবলেন নতুন বছরের ফটক হওয়া উচিত জানুয়ারি মাস। সেজন্য জানুয়ারির ১ তারিখে নববর্ষ উদ্যাপন শুরু হয়।

খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডারের মাসগুলোতে পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রধানত উঠে এসেছে রোমানদের জীবনধারা, দেবদেবীর প্রতি মান্যতা। আজ থেকে কতশত বছর আগে এই দিন-মাসের গণনা শুরু হয়েছিল। তারপর থেকে পরিবর্তিত হতে হতে আজকের এই ক্যালেন্ডার এসেছে। যুগ যুগ ধরে যে মাসের নামগুলো আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে সেসব নামের পাশে আছে এক একটি ইতিহাসসহ নানা জানা অজানা বিষয়।

নতুন বছরের উৎসব আকিতু

নতুন বছরকে আনন্দ-উৎসবে বরণ করে নেওয়ার রীতি সেই প্রাচীনকালের। পৃথিবীর প্রাচীনতম সর্বজনীন উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম এই নববর্ষ উদ্যাপন। এই রীতি প্রায় চার হাজার বছরের পুরোনো। প্রাচীন ব্যাবিলনে যেদিন সূর্যের আলো-অন্ধকার সমান, দিন ও রাত একই সমান তাকে ‘ভার্নাল একুইনোক্স’ বলা হতো। এমন দিনটির পর প্রথম পূর্ণচন্দ্র দৃশ্যমান হওয়ার দিনকে ধরা হতো নতুন বছরের শুরু হিসেবে। নতুন বছরকে বরণ করে নিতে ১১ দিন ধরে উৎসব চলতো যার নাম ছিল আকিতু।

রোমান দেবতার নামে জানুয়ারি মাস

জানুয়ারির ১ তারিখ। পুরোনো বছরের শেষ এবং একটি নতুন বছরের শুরু। জানুয়ারি মাসের নাম রাখা হয় এক দেবতার নামে। ‘জানুস’ নামের একজন রোমান দেবতার নামে এই মাসের নাম রাখা হয়। রোমান শাস্ত্র অনুসারে জানুস ছিলেন পথ, দরজা এবং দিশানির্ণয়কারী দেবতা। দুদিকে দুটো মুখ থাকার জন্য সম্ভবত তিনি হয়ে উঠেছিলেন পরস্পরবিরোধী শক্তির দেবতা। বাস্তব আর অবাস্তব, সত্যি আর কল্পনার ঠিক মাঝখানে যেন দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী দেবতা জানুস’কে বলা হয় ‘গড অফ ডোরস’। কোনো কিছু শুরু করার দরজা। বিভিন্ন জাদুঘরে এই দেবতার দু’দিকে দুটো মুখবিশিষ্ট মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। এমনটা মনে করা হয় যে, তিনি ভূত এবং ভবিষ্যৎ দুটোই দেখতে পেতেন। তাই মনে করা হয় আগের বছরের শেষ আর নতুন বছরের শুরুর দিকে ঘোরানো তার দুই মুখ।

উৎসবের নাম থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের নাম

প্রাচীনকালে ‘ফেব্রুয়া’ নামে এক উৎসব পালন করা হতো পাশ্চাত্যে, বসন্তকালের শুরুর দিকে। এই উৎসবে বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট সব পরিষ্কার করা হতো। এই শোধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষের আত্মা এবং মনেরও এক ধরনের শুদ্ধিকরণ হতো। আর এই উৎসবের নাম থেকেই ‘ফেব্রুয়ারি’ মাসের নামকরণ করা হয়।

রোমান যুদ্ধদেবতা থেকে মার্চ মাসের নাম

মার্চ মাসের নামকরণের পেছনে দুটো তত্ত্ব আছে। আর দুটোই গড়ে উঠেছে রোমান যুদ্ধদেবতা ‘মার্স’ কে ঘিরে। মার্স ছিলেন রোমান পুরাণের যুদ্ধের দেবতা। জুনো এবং জুপিটারের পুত্র মার্স আগে কৃষি এবং উর্বরতার দেবতা হিসেবে পূজিত হলেও পরে যুদ্ধদেবতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। গ্রিক রণদেবতা অ্যারিস তার সমতুল্য চরিত্র। এই মাস থেকেই প্রবল ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করে বলে এর হিংস্রতা বা প্রচণ্ডতাকে তুলনা করা হতো ‘মার্স’ এর সাথে। আবার আরেক মত অনুসারে, আগে মার্চ মাস দিয়ে শুরু হতো রোমানদের বছর। তাই এই সময়ে সব যুদ্ধের অবসান ঘটতো। সেই সূত্র ধরে যুদ্ধদেবতা মার্সের নামানুসারে নামকরণ করা হয় মার্চ মাসটির।

এপ্রিল মাসের নামকরণ নিয়ে ভিন্ন মত

এই মাসের নামকরণ নিয়ে আছে ভিন্ন ভিন্ন মত। কেউ কেউ মনে করেন ‘দ্বিতীয়’ লাতিন শব্দ থেকে এসেছে নামটি। আবার অনেকে মনে করেন লাতিন শব্দ ‘আপেরিরে’ যার অর্থ খোলা বা ফোটা, তা থেকে এসেছে নামটি। এর কারণ হিসেবে দেখানো হয় এপ্রিল মাসে সবকিছু নতুন করে ফোটে। প্রকৃতি সাজে এক নতুন রূপে আর সেই বিচারেই এর নামকরণ। আরেক মতে রোমান দেবী ‘অ্যাফ্রোদিতি’ রয়েছেন এই নামকরণের পেছনে আছেন।

মে মাস উৎসর্গ করা হয়েছিল দেবীর নামে

‘মেইয়া’ নামে রোমানদের এক দেবী ছিলেন। তিনি দেবতা অ্যাটলাসের মেয়ে এবং মারকিউর তার ছেলে। কথিত আছে এই দেবীই ছিলেন সমস্ত শস্যের রক্ষাকর্ত্রী। তাই এই শস্য ফলনের মাসটিকে তার নামে উৎসর্গ করা হয়।

জুপিটারের স্ত্রীর নামে জুন মাস

রোমানদের সবচেয়ে বড় দেবতা জুপিটারের স্ত্রী ছিলেন ‘জুনো’। রোমানদের মতে তিনি বিয়ের দেবী। আর প্রাচীনকাল থেকেই এই মাসে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়ে আসছে। সেই বিবেচনায় মনে করা হয়, দেবী জুনোর নাম থেকেই এই মাসের নামকরণ করা হয়।

ক্যালেন্ডার প্রবর্তকের নামে জুলাই মাস

রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫ সালে যে ক্যালেন্ডারের প্রচলন করেছিলেন তার নাম ছিল জুলিয়ান ক্যালেন্ডার। আর এই ক্যালেন্ডারের প্রবর্তক জুলিয়াস সিজারের নামানুসারেই জুলাই মাসের নামকরণ করা হয়।

অগাস্টাস সিজার থেকে আসে অগাস্ট মাস

জুলিয়াস সিজারের একমাত্র উত্তরাধিকারী ছিলেন অগাস্টাস সিজার। জুলিয়াস সিজারের পর তিনিই সিংহাসনে বসেছিলেন। রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয় শাসক ছিলেন অগাস্টাস সিজার। তাকে প্রথম রোমান সম্রাট হিসেবে অবহিত করা হলেও তিনি কখনও এরকম দাবি করেননি। অগাস্টাস সিজার রোমান সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগের স্রষ্ঠা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছেন। মনে করা হয় খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম সাল নাগাদ অগাস্টাসের নাম অনুসারে এই মাসের নাম করা হয় অগাস্ট।

লাতিন ভাষা থেকে তিনটি মাসের নাম

লাতিন ভাষায় ‘সেপ্টেম’ মানে ৭। সেখান থেকেই এসেছে সেপ্টেম্বর। গ্রেগরিয়ান এবং জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে এটা নবম মাস হলেও দশ মাসবিশিষ্ট রোমান ক্যালেন্ডারে এটি ছিল সপ্তম মাস। অপরিবর্তিতভাবে সেই নামটিকেই ধরে রাখা হয়েছে পরবর্তী ক্যালেন্ডারগুলোতেও। বর্তমান ক্যালেন্ডারে নবম মাস হিসেবে এটি রয়েছে। নভেম্বর এবং ডিসেম্বর দুটোই এসেছে লাতিন ভাষার নবম ও দশম শব্দ থেকে। লাতিন ভাষায় ‘নোভেম’ মানে ৯ এবং ‘ডিসেম’ এর অর্থ ১০। কিন্তু লাতিন ভাষার এই দুটো মাসই পরবর্তীতে এগারো এবং বারো মাসে রূপান্তরিত হয়।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: জানা অজানা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

5 × 5 =