গৃহসজ্জায় দেশীয় ঐতিহ্যের ছোঁয়া

ময়ূরাক্ষী সেন

রিফাত ও তানিয়া নতুন সংসার শুরু করেছে। সদ্য চাকরিতে যোগ দেওয়া দুজনেই বেশ চিন্তিত কিভাবে নিজের ঘরকে সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা যায়। বাজারে আজকাল সবকিছুর যা চড়া দাম, ঘর সাজানোর কথা চিন্তা করতেই যেন ভয় করে। কিন্তু ঘর তো সাজাতেই হবে। নতুন সংসার, কত লোক আসবে ঘরে! কিভাবে ঘর সাজানো যায় তা নিয়ে তানিয়া ভাবতে যেয়ে দেখলেন দেশীয় পণ্য দিয়ে ঘর সাজালে অন্যান্য শোপিস বা আসবাবের চেয়ে তুলনামূলক কম খরচ পড়বে। অন্যদিকে পান্না গৃহিনী। বেশ কিছুদিন ধরেই চাচ্ছেন নিজের সংসারকে একটু নতুন করে সাজাতে। তখন তিনি ঠিক করলেন দেশীয় ঐতিহ্যবাহী জিনিস দিয়ে তার ঘর সাজাবেন। এতে তার মেয়ে রাইসাও দেশীয় জিনিসের সাথে পরিচিত হবে।

এই দুটি গল্প কাল্পনিক হলেও তাদের মতো অবস্থায় আমাদের প্রায় পড়তে হয়। নিজের ঘরকে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতে কে না চায়? তখন হাজারো অপশনের মধ্যে আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না ঠিক কেমন করে ঘর সাজানো যায়। কারণ ঘর সাজাতে চাইলে অবশ্যই একটি বাজেটের প্রয়োজন হয়। তাই কম বাজেটে ঘর সাজাতে চাইলে আপনি গৃহসজ্জায় ব্যবহার করতে পারেন দেশি পণ্য। অনেকেই মনে করেন দেশি পণ্য দিয়ে ঘর সাজানো সম্ভব না। কিন্তু ধারণাটি ভুল। মাত্র কয়েকটি দেশীয় পণ্য আপনার ঘরকে করে তুলবে আরও বেশি নান্দনিক। তাছাড়া আমাদের দেশীয় শিল্প এখন অনেকটা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। দেশীয় শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার ভূমিকা পালন করতে পারেন আপনার ঘর থেকেই। কিভাবে দেশীয় জিনিস দিয়ে আপনার ঘরকে সাজিয়ে তুলতেন পারেন তা নিয়ে আমাদের আয়োজন।

বসার ঘর

ঘর সাজানোর সময় সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু থাকে বসার ঘর। কারণ বাড়িতে আসা অতিথি প্রথমেই প্রবেশ করে বসার ঘরে। তাই বসার ঘর যাতে নজরকাড়া হয় সবাই চায়। বসার ঘরের সোফা বেতের হেেত পারে। সোফার সামনে থাকবে বেতের ছোট টেবিল। বড় বসার ঘর হলে গদি রাখতে পারেন। তাতে উজ্জ্বল রংয়ের সুতির চাদর বিছিয়ে দিতে পারেন। গদির উপর দেশীয় নকশার কয়েকটি কুশন রেখে দিন। বেশি মেহমানের আয়োজন হলে গদি বেশ কাজে লাগে। গদির পাশে বেতের কোনো সেলফ রেখে তাতে কয়েকটি বই রাখতে পারেন। বসার ঘরের কোনায় একটি বাঁশের ল্যাম্প রাখতে পারেন। পাটের ঝুড়িতে কিছু ইনডোর গাছ রাখুন। আজকাল বাজারে পাটের কার্পেট পাওয়া যায়, চাইলে তা-ও বিছিয়ে দিতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা কাজী নজরুল ইসলামের ছবি টানিয়ে দিতে পারেন। এতে আপনার ঘরে সাহিত্যের ছোঁয়া ফুটে উঠবে। কিংবা চাইলে দেয়ালে নিজের পছন্দের ছবিও টানিয়ে দিতে পারেন। বসার ঘরে প্রবেশ করার পথে পাটের শিকা ঝুলিয়ে দিতে পারেন। শিকার মধ্যে হাঁড়ি রাখা যেতে পারে। চাইলে হারিকেন কিংবা কুলা ঘরের এক কোণে রেখে দিতে পারেন। এতে ঘরে গ্রামীণ ঐতিহ্য ফুটে উঠবে। আপনার ঘরে প্রবেশ পথের দেয়ালে মাটি কিংবা বেতের আয়না ঝুলিয়ে দিতে পারেন।

শোবার ঘর

সারাদিনের ক্লান্তি শেষে আমরা শোবার ঘরে ফিরি। তাই আপনার শোবার ঘরটি যাতে হয় প্রশান্তিময় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। শোবার ঘরে দেশীয় ছোঁয়া দিতে বেতের খাট রাখতে পারেন কিংবা কালো রঙের পুরোনো নকশার কাঠের খাট। শোবার ঘরের আলমারিটি খাটের সাথে মিলিয়ে কালো রঙের করতে পারেন। চেষ্টা করবেন ঘর কোনো একটি নির্দিষ্ট থিমে সাজাতে। প্রতিটি জিনিসের সাথে যেন একে অপরের মিল থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন। খাটের উপরের দেয়ালে গ্রামীণ কোনো দৃশ্যের ছবি বড় ফ্রেমে টানিয়ে দিতে পারেন। রুমে প্লাস্টিকের ডাস্টবিন না রেখে বাঁশের ঝুড়ি রাখুন। এতে ঘরে ভিন্নতা আসবে। লন্ড্রির ঝুড়ি হিসেবে ব্যবহার করুন পাটের ঝুড়ি। ঘরের বিছানায় থাকুক নকশি কাঁথার চাদর, এটি আমাদের ঐতিহ্যক বহন করে। খাটের উপর অনেক সময় বক্সের মতো থাকে; তার উপর মাটির তৈরি বিভিন্ন শোপিস রাখতে পারেন। শোবার ঘরে আয়না হিসেবে ড্রেসিং টেবিলের পরিবর্তে বড় বেতের আয়না রাখতে পারেন, এতে জায়গার অপচয় কম হবে। শোবার ঘরে জামদানি মোটিফের পর্দা ঝুলিয়ে দিতে পারেন। রুমে আলো বাতাস আসলে পাটের ঝুড়িতে কয়েকটি গাছ রেখে দেওয়া যেতে পারে, তা অবশ্য নির্ভর করছে রুমে কেমন জায়গা রয়েছে তার উপর। রুম বড় হলে বেতের ইজি চেয়ার রাখতে পারেন। মেঝেতে দেশীয় নকশার শতরঞ্জি বিছিয়ে দিন। শোবার ঘরে পান করার পানি রাখতে মাটির জগ ব্যবহার করতে পারেন। এটি দেশীয় ঐতিহ্য বহন করার পাশাপাশি পানি ঠান্ডা রাখে। রুমের কর্নারে বেতের আলোকসজ্জা রাখার ব্যবস্থা করতে পারেন। রুমে চাইলে প্রিয় কোনো শিল্পীর ছবি টানিয়ে দিতে পারেন, তাতে আপনার শিল্পমন প্রকাশ পাবে। পড়ার টেবিলে মাটির কলমদানি রাখতে পারেন। সাধারণত বাসায় দুই থেকে তিনটি শোবার ঘর থাকে; রুমের সাইজ বুঝে প্রতিটি আলাদা আলাদা থিমে সাজিয়ে নিতে পারেন।

খাবার ঘর

ডাইনিং টেবিলটি হতে পারে বেতের। উপরে থাকবে কাচ। তার সাথে মিলিয়ে বেতের উঁচু চেয়ার। ডাইনিং টেবিলের উপর বাঁশের ঝুড়িতে ফল রাখতে পারেন। কাচের জারে পানি দিয়ে দোলনচাঁপা ফুল টেবিলের উপর রেখে দেওয়া যেতে পারে। এতে খাবার ঘরের শোভা বেড়ে যাবে। টেবিল রানার হিসেবে জামদানি কিংবা কাতান মোটিফের রানার রাখতে পারেন। পাটের তৈরি রানারও আজকাল পাওয়া যায়। বসার ঘর থেকে খাবার ঘরে যাবার পথে অনেক সময় কিছু জায়গা থাকে সেখানে ফ্রিজ কিংবা ওভেন রাখা থাকে। ওভেন রাখার সেলফে কিছু ফাঁকা জায়গা থাকলে তাতে টেরাকোটার শোপিস রাখতে পারেন। খাবার ঘরের দেয়ালে নানারকম শিল্পকর্ম টানানো যেতে পারে। খাবার টেবিলের উপরে সিলিংয়ে বেতের ঝুলন্ত লাইটিং করা যেতে পারে, যার উষ্ণ আলো ঘরের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে তুলবে। অতিথিদের খাবার পরিবেশন করার সময় দেশীয় ঐতিহ্যের ছোঁয়া রাখতে মাটির থালা-বাসনে খাবার পরিবেশন করুন কিংবা কাঁসার থালাও ব্যবহার করতেন পারেন। তবে খাঁটি কাঁসা কিছুটা ব্যয়বহুল।

বারান্দা

এখন বারান্দা মানেই কাপড়চোপড় রোদে দেওয়ার জায়গা না। অনেকেই বারান্দাকে নিজের মনের মতো সাজিয়ে নিচ্ছেন। বারান্দায় বাঁশের পর্দা লাগাতে পারেন। বারান্দা বড় হলে বিকেলে চা খাওয়ার জন্য বেতের দুটি চেয়ার রাখতে পারেন। কিংবা নিচে বিছিয়ে দিতে পারেন শীতল পাটি। এছাড়া পাটের ঝুলন্ত দোলনাও লাগাতে পারেন, পাটের দোলনা খুব বেশি জায়গা অপচয় করে না। প্রয়োজন হলে দোলনাটি খুলেও রাখা যায়। আবার চাইলে কাঠের বড় দোলনাও রাখা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে রোদ বৃষ্টি থেকে দূরে রাখার যথেষ্ট ব্যবস্থা থাকতে হবে। চাইলে বারান্দায় ছোট বাগান করতে পারেন। বারান্দায় পর্যাপ্ত আলো বাতাস প্রবেশ করলে ফুল গাছ লাগানো যেতে পারে। বারান্দায় লাউ কিংবা কুমড়া শাকের গাছ লাগাতে পারেন, যা বারান্দার গ্রিল বেয়ে বড় হবে।

রিকশা প্রিন্ট ও গামছা প্রিন্ট

রিকশা ও গামছা দুটির শুনলেই মনে হবে আমাদের দেশীয় ঐতিহ্যের কথা। আজকাল রিকশা প্রিন্ট ও গামছা প্রিন্টকে কেন্দ্র করে তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের ঘর সাজানোর অনুসঙ্গ। রিকশা প্রিন্ট করা প্লেট, গ্লাস, চামচ, জগ ইত্যাদি পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া ফ্রেমেও বন্দি হচ্ছে রিকশা পেইন্টিংয়ের নানা চিত্রকর্ম। গামছা প্রিন্টের কুশন, পর্দা, চাদর, টেবিল রানার ইত্যাদি অনেক কিছু পাওয়া যাচ্ছে। তাই ঘরকে নান্দনিক ও দেশীয়ভাবে সাজাতে আমরা রিকশা পেইন্ট ও গামছার ব্যবহার করতে পারি। এতে আমাদের হারিয়ে যাওয়া শিল্প বেঁচে থাকবে। তাছাড়া দেশীয় পণ্যগুলো তুলনামূলক কম দাম হওয়াতে কয়েক দিন পর পরই গৃহসজ্জায় পরিবর্তন নিয়ে আসা সম্ভব।

কোথায় পাবেন

দেশীয় ঘর সাজানো সামগ্রী নিয়ে কাজ করছে দেশের বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ড। তার মধ্যে অন্যতম আড়ং, অঞ্জনস, কে ক্রাফট, যাত্রা ইত্যাদি। এছাড়া ঢাকার দোয়েল চত্বরে বেশ কয়েকটি দোকানে দেশীয় গৃহসজ্জার সামগ্রী পাওয়া যাবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ইন্টেরিয়র 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

20 − nine =