গ্ল্যামার নয় শিমুর লক্ষ্য অভিনয়

অলকানন্দা মালা

১২ বছরের কিশোরিকে জোর করে বিয়ে দিতে চায় পরিবার। এতে তার ঘোর আপত্তি। বাড়ি থেকে পালায় সে। অনিশ্চয়তার জীবনে পেট চালাতে বেছে নেয় গৃহকর্মীর জীবন। তবে থিতু হয় না কাজটিতে। সময়ের হাত ঘুরে বনে যায় পোশাকশ্রমিক। বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করে একসময় দাঁড়ায় মেয়েটি। পোশাক শ্রমিকদের নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি একটি সত্যি ঘটনা। যা তুলে ধরা হয়েছে সিনেমায়। ছবিটির নাম ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’। যার বাংলা সংস্করণ ‘শিমু’। জীবনঘনিষ্ঠ এ ছবির নাম ভূমিকায় কাজ করেছেন অভিনেত্রী রিকিতা নন্দিনী শিমু। এতে অনবদ্য অভিনয় তাকে এনে দিয়েছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০২২।

একজন অভিনয়শিল্পীকে প্রাপ্তির চূড়া স্পর্শ করিয়ে দেয় এই সম্মাননা। সেই চূড়া ছুঁতে পেরে যারপরনাই আনন্দিত শিমু। তার ওই মুহূর্তের অনুভূতিটা ছিল লাখ টাকার লটারি জেতার মতো। প্রথমে খবরটি মোটেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি তার কাছে। কেননা তার ভাবনায় ছিল না বিষয়টি। কথোপকথনের শুরুতেই বিষয়টি জানান শিমু। পুরস্কারপ্রাপ্তির কথা শুনে হাত-পা কাঁপছিল তার। কোনোভাবেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। মেসেজ দিয়ে তাকে খবরটি জানিয়েছিলেন অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন। তারপরও অবিশ্বাস্য লাগছিল তার কাছে। ভাবছিলেন বাঁধন হয়তো ভুল শুনেছেন। পরে বিষয়টি জানান নির্মাতা সৈয়দ আহমেদ শাওকি। শিমু যে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তা জানান। এবার বিশ্বাস হয়। বুঝতে পারেন স্বপ্নের পুরস্কার পাচ্ছেন।

জয়া আহসানের মতো দুই বাংলা কাঁপানো অভিনেত্রীর সঙ্গে পুরস্কারটি যৌথভাবে পেয়েছেন শিমু। এতে অর্জনের আনন্দ যেন বাড়তিভাবে ধরা দিয়েছে তার কাছে। এমনটা উল্লেখ করে তিনি বলেন, জয়া আপু আমার প্রিয় অভিনেত্রী। তার কাজ দেখে অনুপ্রাণিত হই। সাহস পাই। ভালো লাগে যে তার সঙ্গেও স্ক্রিন শেয়ার করেছি। যখন দেখলাম জাতীয় পুরস্কারে তার সঙ্গে আমার নাম উঠেছে; অন্যরকম এক ভালোলাগা কাজ করছিল। শুধুমাত্র ওনার কারণে পুরস্কারটি আমার কাছে বিশেষ হয়ে উঠেছে। বিষয়টি কতটা উপভোগ করছি তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।

এরইমধ্যে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন শিমু। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে প্রশংসিত হয়েছেন। ঝুড়ি ভরিয়েছে পুরস্কার। তবে দেশে এবারই প্রথম স্বীকৃতি মিলেছে তার। শুরু জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার দিয়ে। অনুভূতিটা একেবারেই আলাদা। শিমু বলেন, অভিনয়ে হাতেখড়ি ছয় বছর বয়সে। তখন থেকেই অল্প অল্প কাজ করি। এবারই প্রথম নিজ দেশ থেকে পুরস্কার পেলাম। অনুভূতিটা একেবারেই ভিন্ন। স্বীকৃতির ভার অনেকে বইতে পারেন না। স্রোতে ভেসে ভুল ঠিকানা হয়ে যায় গন্তব্য। তবে শিমু এখানেই সাবধান। হারাতে চান না উন্মাদনার জোয়ারে। কচ্ছপ গতিতেই চলবেন বলে জানান। তার কথায়, তেমন কোনো কাজ এখন করা হচ্ছে না। তবে আলোচনা চলছে কিছু কাজ নিয়ে। কিন্তু তাড়া নেই। কেননা আমি আস্তে ধীরে চলতে পছন্দ করি। স্বপ্ন দেখি ভালো কিছু করার। ওই অপেক্ষায়ই আছি।

যে সিনেমা রাষ্ট্রীয় সম্মাননা এনে দিল সেটি শিমুর ক্যারিয়ারের ষষ্ঠ সিনেমা। ছবিটির কাজ যখন চলছিল তখন কী ভেবেছিলেন এটি তার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বয়ে আনবে? শিমু বলেন, সিনেমাটি করার সময় বুঝতে পারছিলাম কাজটি ভালো হচ্ছে। কিন্তু সেটি যে একেবারে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এনে দেবে, প্রত্যাশায় ছিল না। ভেবেছিলাম ছবিটির ভবিষ্যত ভালো। কিন্তু তা আমার ছোট ক্যারিয়ারে এত বড় সম্মান বয়ে আনবে তা ধারনার বাইরে ছিল। সোজাসুজি বললে আমি কল্পনাও করিনি। আমি এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব আমার টিমকে দিতে চাই। আমি নির্মাতার কাছে কৃতজ্ঞ, সেইসঙ্গে ছবিটির সঙ্গে জড়িত সবার কাছে কৃতজ্ঞ। কেননা তারা আমাকে চরিত্রটির জন্য নির্বাচন করেছেন। নইলে তো এ পুরস্কার আমার পাওয়া হতো না। একই সাথে যারা আমাকে পুরস্কারের যোগ্য মনে করেছেন, সেরা অভিনেত্রী হিসেবে আমাকে বাছাই করেছেন তাদের কাছেও কৃতজ্ঞ।

পুরস্কার প্রাপ্তির পর শিল্পীর দায়বদ্ধতা বেড়ে যায়। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন? শিমুও বিশ্বাস করেন কথাটি। তিনি বলেন, অবশ্যই দায়বদ্ধতা থাকে। এমনিতেই আমি বেছে কাজ করি। এবার আরও বেছে কাজ করতে হবে। এই পুরস্কার আমার আগামীতে ভালো কাজের অনুপ্রেরণা হিসেবে থাকবে।

অধিকাংশ অভিনয়শিল্পী পর্দায় নিজের সৌন্দর্যের দ্যুতি ছড়াতে চান। এখানেই ব্যতিক্রম শিমু। তিনি গ্ল্যামারের পেছনে ছোটেন না। বরং কাজ করেন চরিত্র ধরে। নিজেকে উপস্থাপন করেন ভিন্নভাবে। তার ভাষায়, আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অভিনয়। কেননা আমি মূলত একজন অভিনয়শিল্পী হতে চাই। এজন্য কিন্তু গ্ল্যামার থাকাটা বড় কথা না। তাছাড়া গ্ল্যামার নির্ভর হওয়াটা লক্ষ্যও না আমার। ভালো অভিনয় করাটাই লক্ষ্য। সেক্ষেত্রে এই কাজটি জানাটাই বড় কথা। যখন গল্প ও চরিত্র পছন্দ হয় তখন ওই কাজটি করে থাকি।

শুরুটা কিভাবে হয়েছিল শিমুর? অভিনেত্রী জানান, ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ ছিল তার। স্বপ্নের শুরু হয়েছিল টিভিতে অভিনয়শিল্পীদের দেখে। এই স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসে শিমুর এক মামা। তিনি থিয়েটারে কাজ করতেন। তার হাত ধরেই মাত্র ছয় বছর বয়সে ‘টোকাই’ নাট্যদলে নাম লেখান শিমু। এভাবেই অভিনেত্রী হিসেবে প্রথম পথ চলা শুরু করেন তিনি। আমাদের সমাজে নারীদের শোবিজ যাত্রায় প্রথম প্রতিবন্ধকতা শুরু হয় পরিবার থেকে। তবে শিমুকে এই প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়নি। শুরু থেকেই তার পরিবার সহযোগিতা ও সাহস জুগিয়ে তার পাশে থেকেছে। থিয়েটারে নিজেকে প্রমাণ করে পর্দায় খাতা খুলেছেন শিম্।ু তবে পা ফেলেছেন হিসেব করে। স্রোতের জোয়ারে গা না ভাসিয়ে শুরু থেকেই যুক্ত রয়েছেন ভালো কাজের সঙ্গে। শিমু বলেন, পর্দায় আমার পথ চলা আরম্ভ হয়েছিল মাসুম আজিজের ‘তালা’ নাটকের মাধ্যমে।

চলচ্চিত্রে সুযোগ পেতেও খুব একটা অপেক্ষা করতে হয়নি তাকে। শুভ সূচনা হয়েছিল নন্দিত নির্মাতা তারেক মাসুদের ‘রানওয়ে’ সিনেমার মাধ্যমে। ভিন্ন ধারার এ সিনেমাটি নির্মাণ করা হয়েছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়ে। গল্পের উপজীব্য বিষয় ছিল জঙ্গিবাদ। ছবির একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তারেক মাসুদ বেছে নিয়েছিলেন শিমুকে। প্রধান চরিত্র রুহুলের গার্লফ্রেন্ড শিউলি চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। মূলত ‘রানওয়ে’ ছবিই ভালো কাজের দিকে ঝুঁকে পড়তে সাহায্য করেছিল শিমুকে। রানওয়ের পর তিনি যুক্ত হন ‘মাটির প্রজার দেশে’ নামের একটি সিনেমায়। সমাজের বীভৎস রূপ নিয়ে নির্মিত এ ছবিটি দক্ষিণ এশীয় চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়। শিমুর অভিনয়ও প্রশংসিত হয় বোদ্ধাদের কাছে।

এরপরই তার সঙ্গে পরিচয় হয় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নির্মাতা রুবাইয়াৎ হোসেনের। তার নির্মিত ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’ নামের ছবিতে যুক্ত করেন তাকে। এ সিনেমায় শিমু অভিনয় করেন ময়না চরিত্রে। এরপর তিনি অভিনয় করেন রুবাইয়াতের পরের ছবি মেইড ইন বাংলাদেশ তথা শিমুতে। ভালো কাজের ক্ষুধা রয়েছে শিমুর। তাই মাঝে মাঝে ছোটপর্দায় নাটক ও বিজ্ঞাপনে কাজ করেন। পাশাপাশি ওটিটি মাধ্যমে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। অভিনয় করেছেন ওয়েব সিরিজ তাকদীরে। এখানেও কুড়িয়েছেন প্রশংসা।

সদ্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত শিমুর বর্তমান ব্যস্ততা কী নিয়ে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি মূলত সব সময় ভালো কিছুর অপেক্ষায় থাকি। এখনও তাই করছি। কিছু কাজের ব্যাপারে কথা হচ্ছে। তবে এখনও চূড়ান্ত হয়নি কোনোটাই। আশা করছি আসছে বছরের শুরুর দিকে কাজ শুরু হবে। তখন নতুন কাজ নিয়ে মাঠে নামব।

এ অভিনেত্রীর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও অভিনয় নিয়ে। আাগামীর দিনগুলোতেও বিভিন্ন চরিত্রে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে চান তিনি। তবে স্বপ্ন দেখেন আন্তর্জাতিক মানের কাজ করার। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত আমি যে কয়েকটি সিনেমা করেছি তার সবগুলো আন্তর্জাতিক মানের। আগামীতেও এই ধারাটি ধরে রাখতে চাই। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাজের জায়গা বাড়াতে চাই।

সবশেষে দর্শকের দোয়া চান শিমু। তাদের আরও ভালো মানের কাজ দেওয়ার প্রত্যাশা রাখেন। ভালো মানের অভিনেত্রী হতে চান। অভিনয়টাই মন দিয়ে করতে চান। তাই আপাতত ব্যক্তিজীবন নিয়েও কিছু ভাবছেন না বলে জানান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত এই অভিনয়শিল্পী।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

9 − one =