প্রথম নারী মেকআপ শিল্পী আতিয়া

আতিয়া রহমান সেতু একজন প্রস্থেটিক মেকআপ আর্টিস্ট। তিনি সকলের কাছে আতিয়া রহমান নামেই পরিচিত। প্রায় এক দশক ধরে কাজ করছেন বিজ্ঞাপন জগতে। গত তিন বছরে ওটিটিতে আলোচিত সিনেমা-সিরিজের সিংহভাগেই যুক্ত রয়েছেন তিনি। ‘কারাগার’ ওয়েব সিরিজে চঞ্চল চৌধুরীর লুক তৈরি করে ডেইলি স্টার ওটিটি অ্যাওয়ার্ডে পেয়েছেন বছর সেরা মেকআপ আর্টিস্ট পুরস্কার। তার সম্পর্কে জানাচ্ছেন শিশির।

মেকআপ আর্টিস্ট হয়ে ওঠা

আতিয়া রহমানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। ছুটির সময় নানার বাড়ি নাটোরে যেতেন। মেকআপ আর্টিস্ট হয়ে ওঠার শুরুটা সেখান থেকেই। তিনি যখনই নাটোরে যেতেন তখন প্রতিবেশীদের মধ্যে কারো বিয়ে হলে তাকে সাজানোর সুযোগ পেলে তা তিনি লুফে নিতেন। তিনি জানান, তখন কনের মেকআপে একটি লাল বিন্দি ছিল, পাশাপাশি স্নো-ক্রিম দিয়ে কপাল এবং মুখ ডিজাইন করতাম। ছোটবেলা থেকেই মানুষকে সাজাতে তিনি পছন্দ করতেন। শখ কখন যে পেশা হয়ে যায় তা তিনি টের পাননি।

সালটা ২০১২, তিনি স্থির করলেন মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করবেন। কাজ করার জন্য চাই পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা। খোঁজখবর নিলেন চারদিকে। খোঁজ নিতে গিয়ে খানিকটা হতাশই হলেন। বাংলাদেশে পূর্ণাঙ্গ মেকআপ শেখার কোনো ইনস্টিটিউট নেই। বেসিক মেকআপ শিখেছিলেন বাংলাদেশে। তারপর কোলকাতায় খোঁজ নিয়ে দেখলেন সেখানেও কোনো মেকআপ স্কুল নেই। মেকআপে নিজের দক্ষতা বাড়াতে মুম্বাইয়ে পাড়ি জমান। সেখান থেকে প্রস্থেটিক মেকআপ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। শেখার পর দেশে ফিরে আসেন। ইউরোপে গিয়ে ছোট কিছু কোর্স করেছেন তিনি। তারপর কাজ শুরু করেন বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন জগতে।

২০১৩ সাল থেকে আতিয়া রহমান বিজ্ঞাপনচিত্রে মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। কাজ করেছেন দেশের স্বনামধন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে। মেধাবী নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করেছেন জুটি বেঁধে। নিজের মেধার প্রমাণ দিয়েছেন বারংবার। সর্বোচ্চটুকু দিয়ে নিজেকে মেলে ধরেছেন। নিজের স্বাক্ষর রেখেছেন প্রতিটি কাজের মধ্যে। মূলত শুরুতেই আতিয়ার কাজের ধরন শোবিজের নির্মাতারা খুব পছন্দ করলেন। একে একে কাজের চাপ বাড়তে থাকে তার।

আতিয়া রহমানের দ্বিতীয় ইনিংস

দেশের দর্শক করোনা মহামারির সময়ে ওটিটি কনটেন্টমুখী হয়। ফলে বাংলাদেশের ওটিটি প্লাটফর্মগুলোর উত্থান শুরু হয়। দেশি নির্মাতারা দেশীয় প্লাটফর্মগুলোর পাশাপাশি দেশের বাইরের প্লাটফর্মে নিজেদের কাজ তুলে ধরেন। আতিয়া রহমান ওটিটিতে কাজ শুরু করেন ২০২০ সাল থেকে ‘একাত্তর’ ওয়েব সিরিজে কাজ করার মাধ্যমে। বেশ আলোচনায় আসেন আতিয়া রহমান। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান’, শঙ্খ দাসগুপ্তের ‘বলি’, তানিম নূরের ‘কাইজার’, অনম বিশ্বাসের ‘দুই দিনার দুনিয়া’ ও ‘ভাইরাস’, বাশার জর্জিসের ‘ওভার ট্রাম্প’, শিহাব শাহীনের ‘মাইসেলফ অ্যালেন স্বপন’; প্রতিটি কাজের সঙ্গে মিশে আছে আতিয়া রহমানের নাম।

আশফাক নিপুণ নির্মিত ‘সাবরিনা’ ওয়েব সিরিজে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করা নাজিয়া হক অর্ষার ‘ভয়ংকর পোড়া’ কৃত্রিম মেকআপ লুক তৈরি করার মধ্য দিয়ে ওটিটি কনটেন্টে নিজেকে জানান দিয়েছিলেন। আতিয়া রহমান সবার চোখ মাথায় তুলে দিয়েছিলেন ‘কারাগার’ ওয়েব সিরিজে চঞ্চল চৌধুরীর লুক তৈরি করে। পরিচালক সৈয়দ আহমেদ শাওকী ২০০ বছরের পুরোনো এক রহস্যময় কয়েদির চরিত্রের লুক তৈরি করেন মেকআপ আর্টিস্ট আতিয়া রহমানকে সঙ্গে নিয়ে। তারা ‘কারাগার’ ওয়েব সিরিজে প্রায় ২০০ বছর আগের রহস্যে ঘেরা এক মানবের চেহারা ফুটিয়ে তুলেছিলেন অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীর মধ্য দিয়ে।

‘কারাগার’ ওয়েব সিরিজ মুক্তির পর শুধু দেশে না দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ভারতের ফিকশন ফিল্মপ্রেমীরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। এই ওয়েব সিরিজের চরিত্রগুলোর অবিশ্বাস্য রকমের বিশ্বাসযোগ্য লুক নিয়ে হয়েছিল তুমুল আলোচনা। আতিয়া রহমানের হাতের জাদুতে বাংলাদেশের ওটিটি কনটেন্ট ‘কারাগার’ ওয়েব সিরিজে চঞ্চল চৌধুরীর ক্যারেক্টার বহুদিন জীবিত থাকবে। তিনি নিজের মেধা, প্রতিভা ও পরিশ্রম দিয়ে সিরিজের প্রতিটি চরিত্র সাদা ক্যানভাসে একটু একটু করে এঁকেছেন।

চরিত্রগুলোকে কিভাবে অবিশ্বাস্য রকমের বিশ্বাসযোগ্য লুক দিয়েছিলেন আতিয়া রহমান তা জানতে চাইলে তিনি জানান, সেটে প্রতিদিন সকালে অন্তত তিন ঘণ্টা লেগেছে চঞ্চল চৌধুরীর সম্পূর্ণ লুকটা তৈরি করতে। লুক টেস্ট করার সুযোগ পাইনি। কিন্তু চঞ্চল চৌধুরীর নখ, চুল কিছুই কাটতে দেইনি শুট চলাকালীন সময়ে। সারা গা ও মুখে প্রস্থেটিক মেকআপে বিশেষ ডাস্ট পাউডারের সঙ্গে কোকো পাউডার যুক্ত করে হাত ও পায়ের ময়লা নখের লুক এনেছিলাম। প্রতিটি চরিত্রে নিজের সমান মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন আতিয়া রহমান। খ্যাতিমান অভিনেতা আফজাল হোসেনকে প্রথম দেখায় অনেকেই চিনতে পারেনি। কপালের দাগ, চোখের ক্রুর দৃষ্টি আর পান খাওয়া ঠোঁটের সঙ্গে ভয় ধরানো লুক; এসবই আতিয়ার হাতের ছোঁয়ায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ‘কারাগার’ ওয়েব সিরিজে তাসনিয়া ফারিণের গ্ল্যামার বিবর্জিত লুকের পেছনেও ছিল আতিয়া রহমানের মুন্সিয়ানা। সম্প্রতি ওটিটি প্লাটফর্ম ‘চরকি’তে মুক্তি পেয়েছে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ ওয়েব ফিল্ম যেখানে মেকআপের দায়িত্ব সামলেছেন আতিয়া রহমান। মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছেন শিহাব শাহীন পরিচালিত ‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’, যেখানে প্রথমবারের মতো জুটি হিসেবে দেখা যাবে প্রীতম হাসান ও তাসনিয়া ফারিণকে।

স্বীকৃতিও পেয়েছেন আতিয়া রহমান

মুম্বাই থেকে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবহারিক মেকআপের আদ্যোপান্ত শিখে আসা আতিয়া নিজের ছাপ রাখছেন ধারাবাহিকতা বজায় রেখে। বিজ্ঞাপন জগৎ কাঁপিয়ে এখন ফিকশন ফিল্মের জগতে নিজেকে মেলে ধরেছেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন ‘ব্লেন্ডার্স চয়েস-দ্য ডেইলি স্টার ওটিটি অ্যান্ড ডিজিটাল কনটেন্ট অ্যাওয়ার্ড ২০২৩’ এ সেরা মেকআপ আর্টিস্টের পুরস্কার।

আতিয়া রহমানের নিজের কথা

আতিয়া রহমান বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মশালা করে থাকেন শিক্ষার্থীদের নিয়ে। সিনেমা ও ওয়েব সিরিজে মেকআপ ডিজাইনের খুঁটিনাটি, প্রাথমিক ধারণা আলোচনা করার পাশাপাশি তিনি হাতেকলমে প্রস্থেটিক মেকআপ করে দেখান শিক্ষার্থীদের। তিনি জানান, আমি সব প্রস্থেটিক মেকআপে সত্যিকারের মানসম্পন্ন মেকআপ সামগ্রীই ব্যবহার করে থাকি, কেননা আমি চাই না আমার মাধ্যমে কোনো শিল্পীর ক্ষতি হোক। অবাক করা বিষয় হচ্ছে রূপসজ্জায় যার এতো আগ্রহ সেই আতিয়া রহমান নিজে সেভাবে সাজেন না। তার আগ্রহ শুধু অন্যকে সাজানো। অন্যকে সাজিয়েই আনন্দ পান তিনি। প্রধানত পুরুষদের দখলে থাকা একটি ক্ষেত্রে লিঙ্গের স্টিরিওটাইপ ভেঙে, আতিয়া রহমান ‘মেকআপ ম্যান’ থেকে ‘মেকআপ আর্টিস্ট’-এ রূপান্তরিত হওয়ার অসুবিধার উপর জোর দেন।

তিনি জানান, আমার এই পথচলায় তিনজনের ভূমিকা অনেক। তারা হলেন আমার মা, আমার বোন আশফিকা রহমান আর কাছের বন্ধু সিমন। তারা সবসময়ই আমার পাশে থাকেন। তারা না থাকলে আমার এতদূর আসাই হতো না। আমার সব অর্জনের ভাগ তাদেরও। মেকআপ বিষয়ক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে জানতে চাইলে বলেন, দেশে মেকআপ শেখার জন্য পূর্ণাঙ্গ কোনো প্রতিষ্ঠান না থাকায় ভালো মেকআপ আর্টিস্ট তৈরি হওয়াটা বেশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। নারীদের জন্য তা আরও কঠিন। প্রথমত মানুষ ভালো দৃষ্টিতে দেখে না। আর নিজেকে প্রমাণ করতেও সময় লাগে। এখন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে তিনিই প্রথম পেশাদার প্রস্থেটিক মেকআপশিল্পী। শুধু তাই নয় বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন জগতেও তিনিই প্রথম নারী মেকআপ শিল্পী। প্রস্থেটিক মেকআপ নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে প্রথম বাধা বাজেট। প্রস্থেটিক মেকআপ বাংলাদেশে এখনো নতুন একটা ব্যাপার। প্রযোজক-পরিচালকদের অনেকেই এই ডিপার্টমেন্টের জন্য বাজেট রাখতে অভ্যস্ত নন। কারণ তারা তো লুকের রেজাল্ট খুব একটা দেখেননি। চরিত্রের একটা ভালো লুক দর্শককে আগ্রহী করে তোলে। এখন অবশ্য এতটা ঝামেলায় পড়তে হয় না। যাদের সঙ্গে কাজ করি তারা বোঝেন কেমন বাজেট আমার দরকার হয়। প্রস্থেটিকের সব মেকআপ পণ্য বিদেশ থেকে আনতে হয়। আমি যে রক্ত তৈরি করি, এটাও বাইরে থেকে নিয়ে আসি। এখানে সস, রুহ আফজা দিয়েই সাধারণত রক্ত তৈরি হয়। ২০২৪ সালে প্রস্থেটিক মেকআপ নিয়ে লন্ডনে গিয়ে একটা কোর্স করার পরিকল্পনা রয়েছে আতিয়া রহমানের।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: অন্তরালে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

1 + one =