রফিক হাসান
কবিতা একটি সুকুমার শিল্প। এর মধ্যে থাকে নানা ছন্দ এবং সূক্ষ সব কারুকাজ। এজন্য ভালো কবিতা লিখতে হলে ছন্দ সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা থাকা দরকার। অথবা ছন্দ জানা না থাকলে ভালো কবিতা লেখা যায় না। কারণ বাংলা ভাষাসহ পৃথিবীর সব ভাষার বড় বড় কবিরাই তাদের নিজ নিজ ভাষার ছন্দ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কবিতা লিখতে হলে একজন কবিকে কখন এবং কতটা ছন্দ সম্পর্কে দক্ষতা অর্জন করতে হয়? একজন চিকিৎসক যেমন শৈল্যবিদ্যার উপর পড়াশোনা করে কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিবিএস বা সমমানের কোন ডিগ্রি নিয়ে মানুষের চিকিৎসা করা শুরু করেন। কিংবা একজন প্রকৌশলী যেমন প্রকৌশল শাস্ত্র পাঠ শেষ করে ভবন বা সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করেন সেভাবে?
অর্থাৎ কবিকেও কি কোনো গুরু বা শিক্ষকের কাছ থেকে ছন্দ জেনে অথবা কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছন্দশাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করে তারপর কবিতা লিখতে বসতে হবে? তেমনভাবে ছন্দশাস্ত্র আয়ত্ব না করে তিনি ভালো কবি হতে পারবেন না। বিষয়টি কি এমন? না, মোটেই তেমন নয়। পৃথিবীর কোনো বড় কবির বেলায়ই এমনটি ঘটেনি। এখানেই অন্যান্য জ্ঞান, বিজ্ঞান আর শাস্ত্রের সাথে কাব্য বা ছন্দশাস্ত্রের মৌলিক পার্থক্য।
ছন্দ শিখে কেউ কবিতা লিখতে আসে না। কবিকে প্রথমেই ছন্দ জানা বা ছান্দসিক না হলেও ক্ষতি নেই। বরং না জানাটাই স্বাভাবিক। কবিকে হতে হয় ছন্দের জন্মদাতা। বড় বড় কবিরা নতুন নতুন ছন্দের জন্ম দেন। এখানেই কবির কৃতিত্ব। এজন্য বলা হয়ে থাকে যে আধুনিক কবিদের জীবনে তিনটি পর্ব থাকে। প্রথম পর্বে কবি ছন্দ সম্পর্কে কোনো কিছু চিন্তা-ভাবনা না করেই কবিতা লিখতে শুরু করেন। তার মনের ভাব যেভাবে ভালো লাগে সেভাবেই প্রকাশ করতে থাকেন। এতে কবির ভাবনা বা অনুভূতির একান্ত নিজস্ব এবং স্বতঃস্ফুর্ত প্রকাশ ঘটে। এ পর্যায়েও কবি অনেক ভালো কবিতা লিখে ফেলতে পারেন।
এভাবে কিছুদিন কবিতা লেখার পর তার মধ্যে ছন্দ সম্পর্কে আগ্রহ দেখা দেয়। তিনি ধীরে ধীরে তার ভাষায় প্রচলিত ছন্দ সম্পর্কে সচেতন হওয়া শুরু করেন। তিনি ছন্দ সম্পর্কে পড়াশোনা করেন এবং প্রচলিত ছন্দ তার কবিতায় প্রয়োগ করা শুরু করেন। এটি তার কাব্যজীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় বা মধ্যম পর্যায়।
এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর তার মধ্যে নতুন পরিবর্তন দেখা দেয়। তিনি আর প্রচলিত ছন্দে লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। তার মধ্যে ছন্দমুক্তির আকাক্সক্ষা দেখা দেয়। তিনি প্রচলিত ছন্দকে ভাঙতে শুরু করেন। ভেঙে ভেঙে তার নিজস্ব একটি ছন্দ বা ভঙ্গি আবিষ্কারে ব্রতী হন। তার নিজস্ব স্বভাব বা ভঙ্গি খুঁজে পাওয়া এবং সেভাবে কবিতা লেখাই হচ্ছে কবির তৃতীয় বা চূড়ান্ত পর্যায়। এই পর্যায়ে কবি যতটা দক্ষতার পরিচয় দেবেন ততই তিনি কবি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করবেন এবং পরবর্তী কবিদের কাছে অনুসরণীয় হয়ে উঠবেন। তবে ছন্দ ভাঙা গড়ার খেলা একজন কবির সারা জীবন ধরেই চলতে থাকে।
কবিতায় ধরাবাধা ছন্দের প্রয়োজনীয়তা আছে কি নেই; থাকলেও কতটা বা কীভাবে আছে সে ব্যাপারে কাব্য মহলে আদি যুগ থেকেই বিতর্ক চলে আসছে।
এখনকার বেশিরভাগ কবিই মূলত প্রচলিত ধরাবাধা ছন্দের তেমন একটা ধার ধারেন না। অথবা এমন একটি নতুন চাল চালেন যার ফলে সাধারণ পাঠকরা এমন কি বড় বড় ছান্দসিকরা পর্যন্ত কবিতার ভেতরে ব্যবহৃত ছন্দের আসল রূপটি ধরতে হিমশিম খেয়ে যান।
যে ব্যাপারটি এর আগে ঘটেছে গত শতাব্দির তিরিশের দশকের সবচেয়ে আলোচিত এবং শুদ্ধতম কবি হিসেবে খ্যাত কবি জীবনানন্দ দাশের বেলায়। তিনি যখন কবিতায় অক্ষরবৃত্ত ছন্দের ব্যাপক ব্যবহার শুরু করেন তখন অনেক ছান্দসিকই তার কবিতা পড়ে বিভ্রান্ত হয়েছেন। তারা তাদের স্বাভাবিক বিশ্লেষণের দৃষ্টিতে তার মধ্যে ছন্দের ব্যাপক পতন দেখতে পেয়ে হতাশ হয়েছেন এবং ভেবেছেন জীবনানন্দ দাশ ছন্দে পারদর্শী কোনো কবি নন।
এজন্য প্রথম দিকে তাকে অনেক গঞ্জনা সইতে হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা গেছে যে তার সে ছন্দের পতন তার ইচ্ছাকৃত। জীবনানন্দ ছন্দ জানতেন না এটা আজকাল আর কোনো ছান্দসিক বলবেন না। কারণ তিনি হচ্ছেন আধুনিক কালে বাংলা কবিতার সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি তার নিজস্ব ছন্দ খুঁজতে গিয়ে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মধ্যে মাত্রাবৃত্তের চাল ঢুকিয়ে দিয়েছেন। ফলে ছান্দসিকদের অভ্যস্ত চোখে সেটা ত্রুটি হিসেবে দেখা দিয়েছে। কিন্তু তাদের সমালোচনার মুখে তিনি তার অবস্থান থেকে এক চুলও সরে আসেননি। সরে আসা সম্ভব ছিল না। সরে আসলে তিনি তো আর আজকের সর্বজন শ্রদ্ধেয় কবি জীবনানন্দ হতে পারতেন না।
তিরিশ দশকের যে কবিরা দীর্ঘ মানসিক যুদ্ধ চালিয়ে তখনকার প্রচলিত রবীন্দ্রবলয় থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি হচ্ছেন তাদের শিরোমণি। বহু বছর পর তিনি বাংলা ভাষায় নতুন একটি কাব্যভাষার জন্ম দিয়েছেন যা অনুসরণ করে গত পঞ্চাশ বছর ধরে নবীন কবিরা কবিতা লিখে আসছেন। এখানেই একজন কবির আসল সার্থকতা। কাজেই ভবিষ্যতেও আশা করা যায় এ ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা চলতেই থাকবে। একেক কবি একেক কথা বলবেন, একেকভাবে কবিতা লিখবেন আর নতুন নতুন কাব্যভাষার বা ছন্দের জন্ম দিবেন। কাজেই এই ধারা অব্যাহত থাকাটা একটি ভাষার জীবন্ত থাকার অন্যতম নিদর্শন।
তবে ছন্দের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কী বলেছিলেন সে দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। কেননা বাংলা ছন্দের পূর্ণরূপ প্রথম তার মধ্যেই উদ্ভাসিত হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘কথাকে তার জড়ধর্ম থেকে মুক্তি দেবার জন্য ছন্দ। সেতারে তার বাঁধা থাকে বটে, কিন্তু তার থেকে সুর পায় ছাড়া। ছন্দ হচ্ছে সেই তার-বাঁধা সেতার, কথাকে সে তীরের মত লক্ষ্যের মর্মে প্রক্ষেপ করে।’
অর্থাৎ সাধারণভাবে নিত্যদিনের কাজ কর্মে ব্যবহৃত শব্দকে আরো তীক্ষ্ণ বা তীব্রভাবে পাঠকের অন্তরে প্রবেশ করানোর জন্য ছন্দের প্রয়োজন। নইলে সে সব কথা কেবল কথাই থেকে যায়। মানুষের অন্তরে ঠাঁই পায় না।
ভাষা ও ছন্দ কবিতায় তিনি ছন্দের গুরুত্ব আরো সুন্দর করে ব্যক্ত করেছেন।
মানুষের ভাষাটুকু অর্থ দিয়ে বদ্ধ চারি ধারে,
ঘুরে মানুষের চতুর্দিকে। অবিরত রাত্রিদিন
মানবের প্রয়োজনে প্রাণ তার হয়ে আসে ক্ষীণ।
মানবের জীর্ণবাক্যে মোর ছন্দ দিবে নব সুর
অর্থের বন্ধন হতে নিয়ে তরে যাবে কিছু দূর
ভাবের স্বাধীন লোকে, পক্ষবান অশ্বরাজ-সম
উদ্দাম সুন্দর গতি – সে আশ্বাসে ভাসে চিত্ত মম।
তবে একথাও মনে রাখতে হবে যে কবিতার রস আস্বাদনের ধরন আর আগের মতো নেই। ধরন পাল্টে গেছে। আগে কবিতা সুর করে পাঠ করা হতো। আমাদের দেশে যেমন গ্রামেগঞ্জে, সম্মিলিত পুঁথিপাঠ হতো। গোল হয়ে বসে রামায়ন, মহাভারত পাঠ চলতো। সেখানে কাহিনীর বর্ণনা ও সুরের একটা বড় ভূমিকা ছিল। কিন্তু ছাপাখানা আবিষ্কারের পরে আধুনিক যুগে এখন আর কবিতা সে রকম করে পড়া হয় না। কবিতা এখন একান্ত ব্যক্তিগত পাঠ এবং গভীরভাবে রস আস্বাদনের বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে। ফলে কবিতার আঙ্গিকে, বিষয়বস্তুতে ও ছন্দে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে।
ছন্দের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে আর একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে আশা করি। যেমন ঘোড়া আমাদের অতি দরকারি একটি জন্তু বা প্রাণী। ঘোড়াতে আমরা চড়ি। ঘোড়ার পেছনে গাড়ি জুড়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া যায়। কিন্তু এই ঘোড়াকে ব্যবহার করার জন্য বা কাজে লাগানোর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হচ্ছে লাগাম। লাগাম ছাড়া ঘোড়া যেমন ঠিক ছন্দ ছাড়া কবিতাও তেমন।