জমজমাট ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব

রোজ অ্যাডেনিয়াম

জমকালো আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো চলচ্চিত্র নিয়ে দেশের বৃহত্তম আয়োজন ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’ এর ২২তম আসর। বাংলাদেশসহ ৭৪টি দেশের ২৫২টি সিনেমা অংশগ্রহণ করেছিল এ আয়োজনে। দেশি-বিদেশি চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রী ও কলাকুশলীদের পদচারণায় মুখর ছিল উৎসব।

উদ্বোধন করেন শর্মিলা ঠাকুর

২০ জানুয়ারি রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মিলনায়তনে এ উৎসবের উদ্বোধন করা হয়। এতে প্রধান আকর্ষণ হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বলিউডের বর্ষীয়ান অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর। প্রিয় এই নায়িকাকে দেখতে ভিড় করেন অনেক দর্শক। শর্মিলা ঠাকুর ঢাকা শহরে এসে বেশ আনন্দ প্রকাশ করেন। সবার সঙ্গে মত বিনিময় করেন।

নজর কাড়া উদ্বোধনী অনুষ্ঠান

ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’ এর ২২তম আসরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয় নৃত্য পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। বাংলা সিনেমার পুরানো দিনের কিছু কালজয়ী গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন শিল্পকলা একাডেমির নৃত্যশিল্পীরা। এরপর আসে বক্তব্য পর্ব। বক্তব্য রাখেন চলচ্চিত্রের গুণীজনেরা।

বাংলাদেশ-ইরানের চলচ্চিত্রে উৎসব শুরু

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও উদ্বোধনী আলোচনা শেষে বাংলাদেশ ও ইরানের যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র ‘ফেরেশতে’ প্রদর্শনীর মাধ্যমে উৎসব শুরু হয়। মুর্তজা অতাশ জমজম পরিচালিত এ সিনেমায় অভিনয় করেছেন নন্দিত অভিনেত্রী জয়া আহসান। এরপর দেখানো হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বায়োপিক ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’। ‘নান্দনিক চলচ্চিত্র, মননশীল দর্শক, আলোকিত সমাজ’-এই স্লোগানে উৎসবটির আয়োজন করেছিল রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদ। ২০ থেকে ২৮ জানুয়ারি চলেছে উৎসব। এবারের উৎসবে মাস্টার ক্লাস নেন ইরানের নন্দিত নির্মাতা মাজিদ মাজিদি, চীনের সাংহাই ফিল্ম অ্যাসোসিয়েশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান শি চুয়ান ও কলকাতার গুণী চলচ্চিত্রকার ও সংগীতশিল্পী অঞ্জন দত্ত। এছাড়াও ছিলেন দেশ-বিদেশের অনেক তারকা।

যা ছিল চলচ্চিত্র উৎসবে

এবারের উৎসবে এশিয়ান প্রতিযোগিতা বিভাগ, রেট্রোস্পেকটিভ বিভাগ, ট্রিবিউট, বাংলাদেশ প্যানারোমা, ওয়াইড অ্যাঙ্গেল, সিনেমা অফ দ্য ওয়ার্ল্ড, চিল্ড্রেন্স ফিল্ম, স্পিরিচুয়াল ফিল্মস, শর্ট অ্যান্ড ইন্ডিপেনডেন্ট ফিল্ম এবং উইমেন্স ফিল্ম সেশনে বাংলাদেশসহ ৭৪টি দেশের ২৫২টি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। এরমধ্যে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের সংখ্যা ১২৯টি, স্বল্পদৈর্ঘ্য ও স্বাধীন চলচ্চিত্রের সংখ্যা ১২৩টি। আর বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ছিল ৭১টি।

বিভিন্ন দেশ ও ভাষার চলচ্চিত্রের পাশাপাশি বাংলাদেশ প্যানারোমায় এ বছর ছিল মোট ১২টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এরমধ্যে ‘মুজিব’ ছাড়াও ছিল বাড়ির নাম শাহানা, নোনা পানি, মনলোক, মুন্তাসির, আজব ছেলে, ইতি চিত্রা, জাস্ট অ্যা জোক ডার্লিং, লীলাবতি নাগ, মেঘের কপাট, সাবিত্রী এবং ইছামতি। উৎসবে প্রথম প্রদর্শিত হয় ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’। এটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বায়োপিক। নির্মাণ করেছেন শ্যাম বেনেগাল। এতে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকায় আছেন আরিফিন শুভ। সিনেমাটি ২০ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৭টায় জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে প্রদর্শিত হয়। একই ভেন্যুতে ২১ জানুয়ারি বিকাল ৫টায় দেখা যায় ‘মুনতাসির’। এটি পরিচালনা করেছেন ইফফাত জাহান মম। এই সিনেমাটির বিভিন্ন চরিত্রে আছেন এলিনা শাম্মী, মনোজ প্রামাণিক, শতাব্দী ওয়াদুদ প্রমুখ। ২৩ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৭টায় একই মিলনায়তনে প্রদর্শিত হয় ‘বাড়ির নাম শাহানা’। লিসা গাজী নির্মিত এই ছবি ইতিপূর্বে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পুরস্কার পেয়েছে। সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন আনান সিদ্দীকা, লুৎফর রহমান জর্জ, ইরেশ যাকের প্রমুখ। সৈয়দা নিগার বানু পরিচালিত ‘নোনা পানি’ প্রদর্শিত হয় ২৬ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৭টায়, জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে। খুলনা অঞ্চলের মানুষের জীবনের গল্পে নির্মিত হয়েছে সিনেমাটি। এতে অভিনয় করেছেন বিলকিস বানু, রাকিবুল হক রিপন, জয়িতা মহলানবিশ, রুবল লোদী, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, বীণা মজুমদার, সুকান্ত সরকার।

২২ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৭টায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে দেখানো হয় মানিক মানবিক নির্মিত সিনেমা ‘আজব ছেলে’। এই সিনেমাতে অভিনয় করেছেন রিজওয়ান সিদ্দিকী, তৌকীর আহমেদ, সাজু খাদেম, তাহমিনা অথৈ প্রমুখ। একই ভেন্যুতে ২৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় প্রদর্শিত হয় ইমতিয়াজ হোসেন পরিচালিত সিনেমা ‘জাস্ট আ জোক ডার্লিং’। এই মিলনায়তনে ২৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় দেখা যায় ওয়ালিদ আহমেদ নির্মিত ‘মেঘের কপাট’। সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন রাকিব হোসেন ইভন, সিন্ডি রোলিং, সাবরিনা তন্বী, আফরোজা মোমেন প্রমুখ। ২৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় চিত্রশালা মিলনায়তনের পর্দায় দেখানো হয় প্রশংসিত সিনেমা ‘১৯৭১ সেই সব দিন’। হৃদি হক নির্মিত এই তারকাবহুল ছবিতে আছেন ফেরদৌস আহমেদ, সজল, লিটু আনাম, সানজিদা প্রীতি, তারিন জাহান, মামুনুর রশীদ, আবুল হায়াতসহ অনেকে। এই মিলনায়তনে উৎসবের শেষ সন্ধ্যায় প্রদর্শিত হয় রাইসুল ইসলাম অনিক পরিচালিত ‘ইতি চিত্রা’। এতে অভিনয় করেছেন রাকিব হোসেন ইভন ও জান্নাতুল ফেরদৌস ঋতু।

শিল্পকলা একাডেমির সংগীত ও নৃত্যকলা কেন্দ্র মিলনায়তনে ২৭ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৭টায় দেখানো হয় পান্থ প্রসাদ নির্মিত সিনেমা ‘সাবিত্রী’। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গল্পের এ সিনেমাতে অভিনয় করেছেন নার্গিস, অনন্ত হীরা, বৈশাখী ঘোষ প্রমুখ। এছাড়া এবারের উৎসবে ঢাকাই দর্শকের বিশেষ নজর ছিল ‘ফেরেশতে’ সিনেমার দিকে। যেটি নির্মাণ করেছেন ইরানি নির্মাতা মুর্তজা অতাশ জমজম। আর সিনেমাতে আছেন দুইবাংলা জয়ী অভিনেত্রী জয়া আহসান। এছাড়াও অভিনয় করেছেন ফারুক সুমন, রিকিতা নন্দিনী শিমু প্রমুখ। ‘এশিয়ান ফিল্ম কম্পিটিশন’ বিভাগে লড়ে সিনেমাটি। ২০ জানুয়ারি বিকাল ৪টায় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে এই ছবির মাধ্যমেই উৎসবের পর্দা ওঠে।

উৎসবের ইতিহাস

১৯৭৭ সাল থেকে শুরু হওয়া এ চলচ্চিত্র উৎসব চলছে পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে। ২০২৪ সালে  অনুষ্ঠিত হলো এ উৎসবের ২২তম আসর। ২০ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এ উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন এবং উপমহাদেশের প্রখ্যাত অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর।

অঞ্জন দত্তের সঙ্গে কিছুক্ষণ

২৬ জানুয়ারি ‘চালচিত্র এখন’ এর শো’তে দর্শকদের সাথে বসে সিনেমাটি উপভোগ করেন জনপ্রিয় শিল্পী, পরিচালক ও অভিনেতা অঞ্জন দত্ত। যার পরিচালক তিনি নিজেই। অন্যান্য সিনেমার পরিচালকদের মতো তিনিও সেখানে উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠানের পূর্বে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। উত্তর দেন দর্শকদের করা নানা প্রশ্নেরও। এরপর জাতীয় যাদুঘরের ভেন্যুতে ২৭ জানুয়ারি আয়োজন করা হয় অঞ্জন দত্তের সাথে সংগীত সন্ধ্যার।

চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা

দ্বাবিংশ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দর্শক জরিপে সেরা চলচ্চিত্র নির্বাচিত হয়েছে ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ সিনেমা। শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী নাট্যরূপে প্রদর্শিত হয়েছে এই সিনেমায়। যেটি পরিচালনা করেছেন ভারতীয় খ্যাতিমান নির্মাতা শ্যাম বেনেগাল। সেরা শিশুতোষ চলচ্চিত্র হয়েছে ‘প্রভাস’। ভারতীয় এই চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন বিপুল শর্মা। এছাড়াও দর্শক জরিপে বিশেষ সেরা চলচ্চিত্র নির্বাচিত হয়েছে ‘বিজয়ার পরে’। ভারতীয় এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন অভিজিৎ শ্রীদাস। স্পিরিচুয়াল চলচ্চিত্র বিভাগে রাশিয়ান চলচ্চিত্র ‘তুদা আই অবরান্তো’ সেরা নির্বাচিত হয়েছে। এটি পরিচালনা করেছেন আসাদুলিন। সেরা ডকুমেন্টারি নির্বাচিত হয়েছে ‘কুনানফিন্ডা: দ্য ল্যান্ড অফ ডেথ’।

সমাপ্তি

২৮ জানুয়ারি ‘সেরা চলচ্চিত্র পুরস্কার’ প্রদানের মাধ্যমে পর্দা নামে এবারের উৎসবের। বাংলাদেশ প্যানারোমা শাখার বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দিয়ে মাজিদ মাজিদি জানান, এই উৎসবে থাকতে পেরে তার চমৎকার অনুভূতি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘চলচ্চিত্র সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চলচ্চিত্র বঞ্চিতদের কথা বলে। এই উৎসবে অনেক তরুণ নির্মাতা অংশগ্রহণ করেছেন দেখে খুবই আনন্দিত। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুনাম কুড়াবে আশাকরি।’

তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, ‘আমি মনে করি, এই উৎসবে নানারকম সংস্কৃতির প্রগতিশীল উপস্থাপন হয়েছে। আমরা যে ধরনের সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন দেখি, এই ধরনের উৎসব সে ধরনের সমাজ গঠনে সহায়ক।’

উৎসব পরিচালক আহমেদ মুজতবা জামাল জানান, ২০২৫ সালের ১১ থেকে ১৯ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ২৩তম আসর। সমাপনী অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন লাবিক কামাল গৌরবের ব্যান্ডদল ‘এলকেজি কোয়ার্ট্রেট’।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

twenty − eight =