সংগীতের মানুষ জাহিদ নিরব

জাহিদ নিরব বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ও সংগীত পরিচালক। তিনি গানের দল চিরকুট ব্যান্ডের সদস্য হিসেবে বেশি পরিচিত। চিরকুটের কি-বোর্ডিস্ট হিসেবে কাজ করছেন তিনি। সংগীত পরিচালক হিসেবে জাদুকরী মিউজিকের সমন্বয় ঘটিয়ে দর্শকদের মন মাতিয়ে রেখেছেন। জাহিদ নিরবের মিউজিক যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালে রিয়ালিটি শো ‘নেসক্যাফে গেট সেট রক’ এ অংশগ্রহণ করার মাধ্যম। বর্তমানে ছোট পর্দা, রূপালি পর্দা, ওটিটি প্লাটফর্ম থেকে বিজ্ঞাপন সবখানে সমানতালে কাজ করছেন এই মেধাবী তরুণ। সম্প্রতি টাইম স্কয়ারে দেখা গিয়েছে জাহিদ নিরবের ছবি। তার সম্পর্কে জানাচ্ছেন গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত।

শৈশব-কৈশোর

জাহিদ নিরব ১৯৯৪ সালের ২১ অক্টোবর মুন্সীগঞ্জ জেলার ইদ্রাকপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আনোয়ার হোসেন একজন প্রখ্যাত লোকশিল্পী ও সংগীত শিক্ষক। জাহিদ নিরবের গানের হাতেখড়ি হয় বাবার কাছে। শৈশব থেকেই নিজ বাড়িতে সংগীতে তালিম গ্রহণ করেন তিনি। জাহিদ নিরবের মামা ছিলেন বিখ্যাত লোক গায়ক এবং তার দাদা বাঁশি বাজাতেন। নিরব স্কুল-কলেজে পড়েছেন মুন্সিগঞ্জ জেলায়। তার বাবা-মা সিদ্ধান্ত নেন ছেলেকে সংগীতে প্রশিক্ষিত করার। জাহিদ নিরব তার বাবার কাছ থেকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নিয়েছেন। শরীফ মাহমুদের কাছে তবলার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। ১৩ বছর বয়সে তিনি মিনহাজ বাবুর কাছ থেকে গিটার ও পিয়ানো শিখেছেন। ছোটবেলা থেকেই সংগীত পরিবারে বড় হয়ে ওঠা তার। পরবর্তীতে বাংলা লোকসংগীত এবং শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। বাংলাদেশি রক ব্যান্ডগুলোর গানের প্রতিও আগ্রহ বাড়তে থাকে।

চিরকুট যাত্রা

জাহিদ নিরব গানের দল চিরকুট-এ যুক্ত হোন ২০১৫ সালে। এরপর অমিতাভ রেজা চৌধুরীর ‘আয়নাবাজি’ সিনেমায় কাজ করার সুযোগ পান তিনি। ‘দুনিয়া’ শিরোনামের গানে হারমোনিয়াম বাজানো ছিল তার কাজ। গানটি সেসময় তুমুল শ্রোতাপ্রিয়তা লাভ করে। কাজটি নিয়ে হয় আলোচনা। এছাড়া ২০১৭ সালে মুক্তি পাওয়া অনিমেষ আইচের ‘ভয়ংকর সুন্দর’ চলচ্চিত্রে চিরকুটের ‘এই শহরে কাকটাও জেনে গেছে’ গানটিও জনপ্রিয়তা পায়। প্রায় এক দশক ধরে চিরকুট এর সকল গানের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন জাহিদ নিরব। একক গানের পাশাপাশি উধাও (২০১৮), বুকা বুকা (২০২২), খালাস (২০২২), দেখা হোক দেখা হবে (২০২২) ও যাযাবর (দ্য সুইজারল্যান্ড সং) অ্যালবামগুলোতে কাজ করেছেন তিনি। চিরকুট ব্যান্ডের ড্রামার ও প্রযোজক পাভেল আরিনের মাধ্যমে চিরকুট ব্যান্ড কাজ করা শুরু। পাভেল আরিনের মালিকানাধীন ‘বাটার কমিউনিকেশন’ এ সংগীত প্রযোজক হিসেবে কাজ করেন জাহিদ নিরব। চিরকুট এ যুক্ত হওয়ার পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। বর্তমানে জাহিদ নিরব চিরকুট-এর সাথে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের কাজের ছাপ রাখছেন।

চার শতাধিক বিজ্ঞাপনে

জাহিদ নিরব ব্যান্ড দলের সঙ্গে কাজ করার পাশাপাশি তার একক ক্যারিয়ারে সাফল্য অর্জন করছেন। তিনি বিজ্ঞাপনের পিছনের মানুষ হিসেবে নিজের কাজের জানান দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এখন পর্যন্ত চার শতাধিক টিভিসি ও ওভিসির ব্যাকগ্রাউন্ড করেছেন জাহিদ নিরব। রবি, গ্রামীণফোন, এপেক্স, প্রাণ, ক্লোজআপ, বাটা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রথম সারির প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। বিজ্ঞাপনে কাজ করার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রতিনিয়ত একটা কাজ থেকে আরেকটা কাজ আলাদা ভাবে উপস্থাপন করা। জাহিদ নিরব প্রতিটি কাজের মধ্যে আলাদা করে নিজেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন।

ওটিটি প্লাটফর্মে

ওটিটিতেও নিজের কাজের জানান দিয়েছেন এই মেধাবী সংগীত পরিচালক। আশফাক নিপুণের ‘মহানগর’ ওয়েব সিরিজের টাইটেল ট্র্যাকটি ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে দর্শকদের কাছ থেকে। সংগীত পরিচালক জাহিদ নিরব ছিলেন এটার মূল কারিগর। সংগীতের মূর্চ্ছনায় দর্শকদের আটকে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। আশফাক নিপুণের ‘সাবরিনা’, কাজল আরেফিন অমির ‘হোটেল রিলেক্স’ ওয়েব সিরিজেও কাজ করেছেন তিনি। কুড়ির অধিক ওয়েব ফিল্মে কাজ করেছেন জাহিদ নিরব। তার মধ্যে রেদোয়ান রনির ‘বিয়ের দাওয়াত রইলো’, রায়হান রাফির ‘অক্সিজেন’, ‘দ্য ডার্ক সাইড অফ ঢাকা’, ‘টান’, ‘নিঃশ্বাস’, ‘ফ্রাইডে’, অমিতাভ রেজা চৌধুরীর ‘মুন্সিগিরি’, সঞ্জয় সমাদ্দারের ‘দাগ’, ভিকি জাহেদের ‘শুক্লোপোকখো’, ইমরাউল রাফাতের ‘তিথির অসুখ’, নাজমুল নবীনের ‘আড়াল’, আতিক জামানের ‘জাহান’, কাজল আরেফিন অমির ‘বিদেশ’, মিজানুর রহমান আরিয়ানেী ‘পুনর্মিলনে’ বেশ উল্লেখযোগ্য। ক্লোজআপ কাছে আসার গল্পে ‘অথবা প্রেমের গল্প’ ও ‘তোমার কাছেই যাবো’ শিরোনামে দুটি নাটকে মিউজিকের দায়িত্ব পালন করে নিজের মুন্সিয়ানা দেখিয়েছিলেন নিরব।

বড় পর্দায়

২০২১ সালে জাহিদ নিরব প্রথমবারের মতো বড় ক্যানভাসে সংগীত পরিচালক হিসেবে করেন চলচ্চিত্রে। নির্মাতা রাশিদ পলাশ পরিচালিত ‘পদ্মাপুরান’ সিনেমায় সংগীত পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্রে পদযাত্রা করেছিলেন। সিনেমার একটি থিম সং কম্পোজিশন করেছিলেন তিনি। ‘শোনাতে এসেছি আজ পদ্মাপুরান’ শিরোনামের গানটি ছিল তার বড় পর্দায় প্রথম একক কাজ। কম্পোজিশনের পাশাপাশি ‘পদ্মাপুরান’ সিনেমাটির পুরো ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক করেছিলেন তিনি। ইতিপূর্বে সহকারী সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলেন জাহিদ নিরব। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর  ‘ডুব’ ও ‘শনিবার বিকেল’, তন্ময় তানসেনের ‘পদ্ম পাতার জল’ সিনেমায় সহকারী সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।

২০২২ সালে রায়হান রাফির নির্মিত ‘পরাণ’ সিনেমায় কাজ করে তুমুল প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন জাহিদ নিরব। ‘পরাণ’ সিনেমায় ভিন্নমাত্রা যোগ করেছিল তার আবহসংগীত। পরাণ জুড়ানো মিউজিক উপহার দিয়েছিলেন দর্শকদের। ‘পরাণ’ সিনেমার আবহসংগীত ও দুটি গানের সংগীত পরিচালনা করেছিলেন জাহিদ নিরব। গান দুটির একটি হলো ‘বিয়ের গান’। জাহিদ নিরবের সুর ও সংগীত আয়োজনে গানটির কথা লিখেছেন রাসেল মাহমুদ। গেয়েছেন আয়েশা মৌসুমী। অন্যটি হলো প্রচলিত জনপ্রিয় গান ‘সাজিয়ে গুজিয়ে দে’র নতুন ভার্সন। নিরবের সংগীতায়োজনে কণ্ঠ দিয়েছেন আরাফাতুল হাসান শান্ত। সিনেমার একাধিক দৃশ্যে ব্যবহৃত ‘সাজিয়ে গুজিয়ে দে’ গানে জাহিদ নিরবের মিউজিক দর্শক শ্রোতাদের ব্যাপক মনে ধরেছিল। আশুতোষ সুজন প্রথম চলচ্চিত্র ‘দেশান্তর’ নির্মাণ করেছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণের উপন্যাস অবলম্বনে। গানটির সংগীত আয়োজন করেছিলেন জাহিদ নিরব। রাশিদ পলাশের ‘প্রীতিলতা’ ও রায়হান রাফির ‘নূর’ সিনেমায় কাজ করেছেন তিনি, যা মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে।

গায়ক

গানের পিছনে কাজ করার পাশাপাশি কণ্ঠও দিয়েছেন জাহিদ নিরব। রায়হান রাফির ‘টান’ ওয়েব ফিল্মের ‘জীবন দিলাম’ শিরোনামের গানটিতে মাশা ইসলামের সঙ্গে কণ্ঠ দিয়েছিলেন। ‘ললিত’ শিরোনামের গানটিতে এককভাবে কণ্ঠ দিয়েছিলেন জাহিদ নিরব। মাহমুদুল হাসান ও রাসেল মাহমুদকে নিয়ে ‘কে যে দেয় কারে সাজা’ গানটিও গেয়েছিলেন। শ্রোতাদের কাছ থেকে বেশ ভালো সাড়া পেয়েছিলেন তিনি। ক্লোজ আপ কাছে আসার গল্পে ‘তুমি লাগবে’ শিরোনামের গানটি দর্শক বেশ পছন্দ করেছিলেন। এছাড়াও ক্লোজআপ কাছে আসার গল্প তে দুটি গান করেছিলেন তিনি। বড় পর্দায়ও কণ্ঠ দিয়েছেন জাহিদ নিরব ‘মৃধা বনাম মৃধা’ সিনেমায়  ‘আদিম অভিমান’ শিরোনামের গানে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: অন্তরালে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

one × five =