জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে পশ্চিমের নীতিতে দ্বিধা

মুশফিকুর রহমান : বৈশ্বিক উষ্ণায়ন অধিকাংশ দেশকে উদ্বিগ্ন করেছে। বাংলাদেশ সহ বেশ কিছু দেশ বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে নানামুখি পরিবেশ ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মোকাবেলা করতে বাধ্য হচ্ছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত বিভিন্ন তথ্য, বিশ্লেষণ, দীর্ঘ আলোচনা, আন্দোলনের ফলে ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুমোদিত হয়েছে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ প্যারিস জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষরের পর তা নিজ দেশের আইনসভায় অনুসমর্থন করেছে। ফলে জলবায়ু বিষয়ক বৈশ্বিক প্যারিস চুক্তি এখন বিশ্বব্যাপী মেনে চলার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অবশ্য, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলে আবার সে চুক্তিতে ফিরে আসার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
পরিবেশের বিপন্নতা সীমিত করতে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সীমিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, পৃথিবীর আবহাওয়ামন্ডলী তপ্ত হয়ে উঠলে মেরু অঞ্চলের বরফ দ্রুত গলতে শুরু করবে এবং সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে। সমুদ্রের তীরবর্তী অনেক নিম্নভূমির দেশের (বাংলাদেশ সহ) বিশাল অংশ স্ফীত হয়ে উঠা সমুদ্র জলের নিচে ডুবে যাবে; বসবাসের জায়গা হারিয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ এবং বিভিন্ন প্রাণী, জলবায়ু উদ্বাস্তুু হবে। কৃষি জমি জলমগ্ন হলে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাবে, আবহাওয়ার স্বাভাবিক আচরণ পাল্টে যাবে, অতিবর্ষণ, বন্যা, খরার প্রকোপ বাড়বে। সেই সাথে বজ্রপাত, ঘূর্ণিঝড়, বনাঞ্চলে দাবানল সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়বে।
আবহাওয়ামন্ডলীর উষ্ণায়ন কী বিপদ ডেকে আনে তা জানার পরও পৃথিবীর কেউ-কি বিশে^র উষ্ণায়নকে স্বাগত জানাতে চায়।
বৈশি^ক উষ্ণায়ন অধিকাংশ দেশের মানুষের জন্য বিপন্নতার বার্তাবহ হলেও কোনো কোনো দেশ বৈশি^ক উষ্ণায়নকে বড় ধরনের সম্ভাবনার বিষয় হিসেবে বিবেচনা করছে। বিশেষত, উত্তর মেরুর নিকটবর্তী রাশিয়া, কানাডা, আইসল্যান্ড, স্ক্যান্ডিনেভিয়ার মেরু অঞ্চলের বরফাচ্ছাদিত বিশাল ভূভাগের বরফ গলে গেলে দেশগুলির জন্য তা খুলে দিতে পারে অপার সম্ভাবনার দুয়ার। বরফে ঢাকা বিশাল জমি উদ্ধার, সেখানে কৃষির সম্ভাবনা কাজে লাগানো, জাহাজ চলাচলের নতুন রুট খুলে দেয়া, অনাহরিত প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ আহরণের সুযোগ কাজে লাগানো সহ অনেক কাজের সুযোগ হবে জলবায়ু বদলে গেলে। কানাডা এবং রাশিয়ার মেরু অঞ্চলের বরফ গলে চাষের জমি বেরিয়ে এলে তা দেশগুলোর কৃষি উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। ভূ-রাজনীাতর ভারসাম্যে তার প্রভাব বর্তমানের শক্তি ও প্রভাব বলয়ে আনতে পারে আমূল পরিবর্তন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্রদের জারি করা প্রলম্বিত অর্থনৈতিক অবরোধ ইতিমধ্যে রাশিয়ার কৃষিখাতের জন্য শাপে বর হয়েছে। ২০১৪ সালে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলোর জারি করা অর্থনৈতিক অবরোধ রাশিয়াকে নিজ দেশে উৎপাদন বাড়ানোর পথে মনযোগ দিতে বাধ্য করে। রাশিয়া পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে খাদ্যপণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করে। ২০১৫ সাল থেকে রাশিয়ার গম এর রপ্তানি বেড়েছে ৪৪ মিলিয়ন টন। এসময়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের সম্মিলিত গম রপ্তানির পরিমানের চেয়ে তা বেশি । ২০২০ সালে রাশিয়া রেকর্ড পরিমাণ কৃষিপণ্য রপ্তানি করেছে এবং এখাতে নেট রপ্তানিকারক দেশ এ রূপান্তরিত হয়েছে। সংবাদ সংস্থা আরবিসির তথ্য বলছে গত বছর রাশিয়ার কৃষিপণ্য রপ্তানির আর্থিক মূল্য ছিল প্রায় ৩০.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। চীন, তুরস্ক, কাজাখস্তান সহ ১৫০ দেশে রপ্তানি করা রাশিয়ার কৃষিপণ্যের তালিকায় গত বছর ছিল ৭৯ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য, মাছ-মাংস, সবজি, দুধ জাতীয় পণ্য।
রাশিয়া এখন বিশ্বে একক বৃহত্তম গম রপ্তানিকারক দেশ এবং বৈশ্বিক মোট সরবরাহের প্রায় এক চতুর্থাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। রাশিয়ার জন্য খাদ্যপণ্য রপ্তানি সমর্থ দেশ হয়ে ওঠা ভূ-রাজনীতি, জাতীয় নিরাপত্তা এবং বিশ্ব পরিসরে অর্থনৈতিক প্রভাব বলয় সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ। রুশ প্রেসিডেন্ট ভাদিমির পুতিন কৃষ্ণসাগর তীরবর্তী সচি নগরীতে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ রাশিয়া-আফ্রিকা অর্থনৈতিক ফোরামে সে পটভূমিতে বলেছেন, ‘আমরা এখন অস্ত্র রপ্তানির চেয়ে বেশি কৃষি পণ্য রপ্তানি করি।’ স্মরণ করা যেতে পারে যে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর প্রায় এক দশক রাশিয়ার বাজারে কৃষি ও খাদ্যপণ্যের উল্লেখযোগ্য অংশ আমদানিপণ্য দিয়ে পূরণ করতে হয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্যপণ্য (প্রধানত খাদ্য গম, ভুট্টা, সয়াবিন) প্রায় ১৭৪ দেশে রপ্তানি হয় এবং সেই সাথে মার্কিন প্রভাব বলয় বিস্তারের সম্পর্ক নিবিড়। আবহাওয়ামন্ডলীর ব্যাপক উষ্ণায়ন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য উৎপাদনের ও রপ্তানি সামর্থে ব্যাপক সংকোচন ঘটাতে পারে। সেই সাথে অবধারিত হতে পারে তার ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সামর্থ।
বৈশ্বিক পরিমন্ডলে আবহাওয়ামন্ডলীর উষ্ণায়ন বৃদ্ধি পেলে পরিবেশ বিপর্যয় বহুমুখী হবে এবং প্রচলিত বৈশ্বিক কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন অবধারিত হবে। অনুকূল আবহাওয়া এবং শ্রমশক্তিকে কাজে লাগিয়ে যে দেশগুলো এখন বিশে^র খাদ্যপণ্য উৎপাদনে নিয়ন্ত্রকের আসনে, তাদের সে অবস্থান অটুট না-ও থাকতে পারে। খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও সরবরাহের সামর্থ হ্রাস পেলে শক্তিধর ও প্রভাবশালী অনেক দেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব কমতে পেতে পারে। অপরদিকে যে দেশের পর্যাপ্ত খাদ্যপণ্য উৎপাদন এবং তা সরবরাহ সামর্থ গড়ে উঠবে, তাদের কাছে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র সরে যেতে পারে। পরিবেশ বিপর্যয়ে উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া মানুষের ঢল স্বভাবতই ক্ষমতার পরিবর্তিত কেন্দ্রাভিমুখী হবে ।
ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, জাপান এবং আর্কটিক অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য এখনই ‘বুড়িয়ে যাওয়া’ জনসংখ্যা উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। ভবিষ্যতে তরুণ ও কর্মক্ষম শ্রমশক্তি আকর্ষণ তাদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য অপরিহার্য। সে বিবেচনায়, খাদ্যপণ্যের সুলভ সরবরাহ যে দেশ অভ্যন্তরীণ বাজারে নিশ্চিত করতে পারবে, বড় আকারে কর্মক্ষম শ্রমশক্তি সে দিকে ধাবিত হবে।
রাশিয়ার দিগন্ত বিস্তৃত জনমানবহীন ভূখন্ডে জনবসতি গড়তে জলবায়ুর অনুকূল পরিবর্তন তাকে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার চেয়ে বেশি সুবিধা দিবে। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, রাশিয়ার সাইবেরিয়া ও আর্কটিক সংলগ্ন বিশাল বরফাচ্ছাদিত (পারমাফ্রস্ট আচ্ছাদিত) ভূ-ভাগ ২০৮০ সাল নাগাদ প্রায় অর্ধেক বরফমুক্ত বা তুলনামূলক কম পুরু বরফ আচ্ছাদনে আবৃত হবে। এক তৃতীয়াংশ ভূ-ভাগ বসবাসের জন্য ‘চরম বৈরী’ থেকে বসবাসের জন্য ‘মোটামুটি অনুকূল’ হয়ে উঠবে। বর্তমানে বিশে^র আবহাওয়ামন্ডলে যে হারে কার্বন নিঃসরণ অব্যাহত রয়েছে তা বহাল থাকলে বিশেষজ্ঞদের অনুমান, ২০৮০ সাল নাগাদ সাইবেরিয়ার অর্ধেক এলাকা বা প্রায় দুই মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার এরও বেশি পরিমাণ এলাকা চাষাবাদের জন্য উপযুক্ত এলাকা হয়ে উঠবে ।
কেবল কৃষিতে সুবিধাজনক অবস্থান গড়া নয়, অব্যাহত বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রাশিয়ার জন্য আর্কটিক সাগরের বরফ গলা জলের বিস্তার বাড়াবে, ফলে নতুন শিপিং রুট উন্মুক্ত হবে। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের সাথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমুদ্র যোগাযোগের দুরত্ব উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যাবে। এবং চীন সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের সমুদ্র যোগাযোগের ট্রানজিট রুট নিয়ন্ত্রণ করার লাভজনক ও কৌশলগত সুবিধা রাশিয়া নিতে পারবে। তাছাড়া শীতে জীবন স্বাভাবিক রাখতে রাশিয়াকে যে বিপুল পরিমাণ জালানি ব্যাবহার করতে হয়, উষ্ণ আবহাওয়া সে প্রয়োজন হ্রাস করবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে যুক্তরাষ্ট্র সহ অনেক শক্তিধর ‘দক্ষিণে’র দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহর, কৌশলগত স্থাপনা স্থানান্তর করবার জন্য যে বিপুল ব্যয় করতে হবে, রাশিয়ার জন্য সে ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম ।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে পরিবেশ প্রসঙ্গ। অতীতে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে পরমাণু ও কৌশলগত অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, সন্ত্রাসবাদ দমন, জালানি সহ আরও অনেক প্রসঙ্গ গুরুত্ব পেলেও জলবায়ু পরিবর্তন প্রসঙ্গ ততটা অগ্রাধিকার পায়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউপোপীয় ইউনিয়ন ২০২১ সালে অনুষ্ঠিতব্য জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৬) কে সামনে রেখে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াবে বলে অনুমান করা যায়। তাদের সম্মিলিত লক্ষ্য জলবায়ু পরিবর্তন সীমিত করতে বৈশি^ক তৎপরতা আরও জোরদার করা এবং রাশিয়াকে সে কর্মকান্ডে আরও বেশি সক্রিয় অংশ নিতে উদ্যোগী হওয়া। বাইডেন প্রশাসন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কাঠামোর সাথে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বিষয়াবলী সম্পর্কিত করতে আগ্রহী। সেই সাথে কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ দূষণ রোধে নানামুখী তৎপরতার সাথে বাণিজ্য সুবিধার বিষয়াবলী কড়াকড়িভাবে সম্পর্কিত করতেও আগ্রহী। যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশনীতিতে বৈশি^ক বাণিজ্য ও জলবায়ু নীতিকে পরস্পর সম্পর্কিত নীতিমালা হিসেবে সামনে আনার উদ্যোগ নিতে আগ্রহ আরও বাড়বে। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ এর সর্বোচ্চ পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেয়াকে আন্তর্জাতিক ব্যাবসা বাণিজ্য পরিচালনার শর্ত হিসেবে সামনে আনার উদ্যোগ নিয়েও মার্কিন প্রশাসন আগ্রহী হতে পারে। এমনকি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, মানবপাচারের মত বিষয়কে যুক্তরাষ্ট্র যেমন তার বিদেশ নীতিতে বিশেষ গুরুত্ব দেয়, কোন দেশ জলবায়ু পরিবর্তন সীমিত রাখতে তার তৎপরতা কিভাবে পরিচালনা করছে সে বিষয়কে গুরুত্বের সাথে মনিটরিং করা এবং জলবায়ু পরিবর্তন লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতাকে ‘বাণিজ্য অবরোধের’ উপাদান হিসেবেও সামনে আনতে আগ্রহী ।
প্যারিস জলবায়ু চুক্তির বাধ্যবাধকতা হিসেবে রাশিয়া এখনও কার্বন নিঃসরণের নির্ধারিত সীমার মধ্যেই রয়েছে। রাশিয়া বিশে^র চতুর্থ বৃহৎ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণকারী দেশ। সুতরাং মার্কিন ও তার মিত্রদের জলবায়ু নীতি ও তার বাস্তবায়ন রাশিয়াকে পাশ কাটিয়ে মোটেই সম্ভব নয়। ফলে, রাশিয়ার সাথে বৈরী সম্পর্ককে সহযোগিতার সম্পর্কে রূপান্তরে মার্কিন জাতীয় স্বার্থ নিবিড়ভাবে জড়িত। দেখার বিষয়, বাইডেন প্রশাসন রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে কতটা নমনীয়তা দেখাতে পারে।
লেখক পরিচিতি : খনি প্রকৌশলী ও পরিবেশ বিষয়ক লেখক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

4 × 1 =