ঠোঁটের যত্ন

নীলাঞ্জনা নীলা

শীত আসলে আমাদের ত্বক ও শরীরের যত্ন যেন বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। কেনই বা হবে না, আর্দ্র আবহাওয়ার প্রভাব পরে আমাদের ত্বকের উপর। যত্ন না নিয়ে তো উপায় নেই! কিন্তু শরীরের যে অংশ আমরা অবহেলা করি তা হলো ঠোঁট। বড়জোর একটু লিপবাম দিয়ে ঠোঁটের যত্নের ইতি টেনে দেই। ঠোঁটের প্রয়োজন বাড়তি যত্ন। কেননা অনেকের শুধু শীত না বারো মাস জুড়েই থাকে ঠোঁট ফাঁটার মতো নানাবিধ সমস্যা। এ সব সমস্যা খুব জটিল হয় না বলে আমরা গুরুত্ব দেই না কিন্তু ঠোঁটের যেকোনো সমস্যা খুব যন্ত্রণাদায়ক ও অস্বস্তিকর। এছাড়া আপনার শরীরের অন্যান্য স্থানের ত্বক যতই মসৃণ হোক না কেন ঠোঁটের ত্বক ফেটে থাকলে তা দেখতেও ভালো লাগে না। জেনে নিব শীতকালসহ যেকোনো ঋতুতে আপনার ঠোঁটের যত্ন কিভাবে নিবেন।

ঠোঁট ফাটার সমস্যা

শীতের সময় ঠোঁট ফেটে যাওয়ার প্রবণতা বাড়লেও অনেকের সারা বছর ঠোঁট ফেটে থাকে। শীতকালে অতিরিক্ত ঠোঁট ফাটার কারণ হচ্ছে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কমে যায়। শরীরের অন্যান্য জায়গার তুলনায় ঠোঁটের চামড়া পাতলা তাই খুব সহজে ফেটে যায়। শীত ছাড়াও আরো কিছু কারণে ঠোঁট ফেটে যায় যেমন ভিটামিনের অভাব, পানিশূন্যতা, থাইরয়েডের সমস্যা, বিভিন্ন ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি। এছাড়া কিছু কসমেটিকসের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার জন্য ঠোঁট ফেটে যায়। শীতকালে ঠোঁট ফেটে যাওয়ার কারণ জানা গেলেও অন্যান্য সময় ঠিক কেন আপনার ঠোঁট ফাটছে তা খুঁজে বের করা কঠিন।

ফাটা ঠোঁটের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমাধান হচ্ছে ঠোঁট ময়েশ্চারাইজ রাখা। মুখের ত্বক আমরা প্রতিনিয়ত ময়েশ্চারাইজ রাখলেও ঠোঁটের ত্বক আমরা আলাদা করে ময়েশ্চারাইজ রাখার কথা ভাবি না। ঠোঁট ময়েশ্চারাইজ রাখতে ভালো মানের লিপবাম ব্যবহার করতে হবে এবং তা কিছুক্ষণ পর পর ব্যবহার করতে হবে। প্রাকৃতিকভাবে ময়েশ্চারাইজ করতে চাইলে গোলাপজল ও গ্লিসারিন একসাথে মিশিয়ে ব্যবহার করতে পারেন। লিপস্টিক ব্যবহার করলে দেখুন তাতে অয়েল আছে কি না। কারণ লিপস্টিক ড্রাই হলে ঠোঁট ফেটে যায়। অনেকেই ঘর থেকে বের হবার আগে লিপস্টিক ব্যবহার করে ঘরে ফিরে লিপস্টিক সঠিকভাবে তুলেন না, এতেও ঠোঁটে নানারকম সমস্যা সৃষ্টি হয়। অবশ্যই ক্লিনজার দিয়ে লিপস্টিক তুলতে হবে। এছাড়া ঠোঁটে খাঁটি নারকেল তেল কিংবা অলিভ ওয়েল দিয়ে ম্যাসাজ করতে পারেন। ম্যাসাজের ফলে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পাবে ও ঠোঁট ময়েশ্চারাইজড হবে। ঠোঁট ফেটে যাওয়ার ফলে ঠোঁটে মরা চামড়া জমে সেক্ষেত্রে চিনি ও লেবু ঠোঁটে ম্যাসাজ করতে পারেন, এতে ঠোঁটের মরা চামড়া উঠে আসবে।

লিপবাম ঘরে তৈরি করতে

ঠোঁট মসৃণ রাখার জন্য লিপবাম প্রয়োজন। চাইলে লিপবাম আপনি ঘরে তৈরি করতে পারেন। এর জন্য আপনার প্রয়োজন হবে গোলাপের পাপড়ি। গোলাপের পাপড়ির ফলে আপনার লিপবামে রঙ আসবে। প্রথমে গোলাপের পাপড়ি বেটে নিন, তাতে পেট্রোলিয়াম জেলি ও গোলাপ জল মিশিয়ে নিন। এরপর মিশ্রণটি ৩/৪ দিন ফ্রিজে রেখে জমিয়ে নিন। ব্যস তৈরি হয়ে গেল লিপবাম। তবে আপনি যদি একটু গাঢ় রঙের লিপবাম পছন্দ করেন তাহলে এতে লিপস্টিকও মিশিয়ে নিতে পারেন।

অনেকে অ্যালোভেরার পাতা থেকে রস বের করে সরাসরি তা ঠোঁটে ব্যবহার করে। কিন্তু এটি করা উচিত নয়। তাই তৈরি করে নিতে পারেন অ্যালোভেরার লিপবাম। সেক্ষেত্রে অ্যালোভেরার খোসা ফেলে দিয়ে রসটা রাখতে হবে এবং রসের সাথে কিছুটা নারকেল তেল মিশিয়ে মিশ্রণটি ফ্রিজে রেখে জমতে দিয়ে এরপর ব্যবহার করতে হবে। ঘরে তৈরি লিপবামগুলোতে কোনো কেমিকেল ব্যবহার না করার ফলে এটির ফলাফল আরো অনেক বেশি ভালো পাওয়া যায়।

ভিটামিনের অভাব

অনেক সময় ঠোঁটের বাড়তি যত্ন নিয়েও ঠোঁট ফাটা কমানো যায় না। সে ক্ষেত্রে দেখা যায় শরীরের রয়েছে ভিটামিনের অভাব। ভিটামিনের অভাবের ফলে যে ঠোঁট ফাটে তা সহজে ভালো হতে চায় না। অনেক সময় ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হয়, যা অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। ঠোঁট ফাটা কমাতে বেশি করে ভিটামিন বি ও ভিটামিন সি খেতে হবে। ভিটামিন বি কমপ্লেক্সের অভাবে অনেকের ঠোঁট ফেটে যায়। তাই যেসব খাবারে ভিটামিন বি রয়েছে তা ডায়েটে রাখতে হবে যেমন মটরশুটি, কলিজা, বাদাম, অ্যাভাকাডো, মাছের তেল, সয়াবিন তেল, মিষ্টি আলু, ব্রকলি ইত্যাদি। এছাড়া ভিটামিন সি যেকোনো ক্ষত দ্রুত সারাতে সাহায্য করে তাই প্রতিদিন লেবু, কমলা, টমেটো, আমড়া, আমলকির মতো ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে হবে।

শরীরের জন্য পানিশূন্যতা দেখায় দেয় তখন ঠোঁট ফেটে যায়। আমাদের শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি না পেলে নিজের চাহিদা পূরণ করার জন্য ঠোঁট থেকে পানি শুষে নেয় ও এতে ঠোঁট শুষ্ক হয়ে ফেটে যায়। সে ক্ষেত্রে শরীরকে সবসময় তরল জাতীয় খাবার দিতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করার পাশাপাশি সুপ, দুধ ও তাজা ফলের রসের মতো তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে ঠোঁট ফাটা কিছুতেই ভালো হতে চায় না। সেক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে তার পরামর্শ অনুযায়ী মলম ব্যবহার করতে হবে ও ঔষধ খেতে হবে।

কালচে ঠোঁট

নরম গোলাপি ঠোঁট কে না চায়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ঠোঁট কালচে হয়ে যায় তা দেখতে ভালো লাগে না। প্রাকৃতিক উপায় গোলাপি ঠোঁট পেতে ঘরে বসেই নিজের ঠোঁটের যত্ন নেওয়া যেতে পারে। কালচে ঠোঁটের জন্য ব্যবহার করতে পারেন মধু। মধুর গুণ কারো অজানা নয়। অনেক বছর ধরে রূপচর্চায় মধুর অনেক অবদান, মধু ত্বক উজ্জ্বল করতে সাহায্য করে। তাই ঘুমাতে যাবার আগে ঠোঁটে ভালো করে মধু ব্যবহার করুন। সারারাত রেখে সকালে ধুয়ে ফেলুন। এটি ঠোঁটের কালচে দাগ দূর করার পাশাপাশি ঠোঁট নরম করতে সাহায্য করবে। ঠোঁটে ব্যবহার করতে পারেন বিটরুট। বিটরুট প্রাকৃতিকভাবে ঠোঁটে হালকা গোলাপি আভা দেয়। তাই বিটরুটের সাথে কিছু না মিশিয়ে তাজা বিটরুটের রস সরাসরি ঠোঁটে ব্যবহার করুন। নিয়মিত ব্যবহারের ফলে ঠোঁটের কালচে ভাব দূর হবে। এছাড়া দুধের সরের সাথে মধু মিশিয়ে ঠোঁটে ব্যবহার করতে পারেন। গোলাপের পাপড়ি কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রেখে তা বেটে নিয়ে ঠোঁটে দিলেও ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।

ঠোঁটে ঘা

অনেকের ঠোঁটে কিছুদিন পর পর ঘা হতে থাকে। যা জটিল রোগ না হলেও ব্যথাদায়ক। কথা বলতে নিলে কিংবা খেতে নিলে ঠোঁট ব্যথা করে। ঠোঁট ফেটে যাওয়ার ফলে অনেক সময় ফাটা স্থানে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করে তখন ঠোঁটে ঘা হতে দেখা যায়। এছাড়া ভাইরাস জ্বর সর্দি কাশির পর ঠোঁটে ঘা হয়ে থাকে। এর ফলে রক্তপাত, ফোসকা, ত্বক ফেটে যাওয়া, খসখসে, লালচে রঙ, ফোলাভাব ও চুলকানি হতে পারে। ঠোঁটের ঘায়ের ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। চিকিৎসক অ্যান্টিফাংগাল ক্রিমের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। ঠোঁটের কোণে ঘা হলে তাতে বরফ ঘসতে পারেন, তাতে ব্যথা কমে যায়। ঠোঁটের ঘা দ্রুত সারাতে অবশ্যই ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। প্রায় প্রতিদিনই আমাদের খাবার তালিকায় ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার থাকা প্রয়োজন, কারণ ভিটামিন সি খুব সহজে আমাদের শরীর থেকে বের হয়ে যায়। তাই এই ঘাটতি পূরণ করতে প্রতিদিন খাবারের পাতে লেবু, সালাদ ও টমেটো ইত্যাদি জাতীয় খাবার থাকতে হবে।

বেশিরভাগ মানুষই নিজের ঠোঁট নিয়ে অনেক বেশি অবহেলা করে। কিন্তু ঠোঁট ফেটে যাওয়া, বারবার ঠোঁটে ঘা হওয়ার, ঠোঁট দিয়ে রক্ত পড়া অনেক সময় বড় কোনো রোগের ইঙ্গিত হয়ে থাকে। তাই কিছুদিন পরপর ঠোঁটে সমস্যা দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: আরশী

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

9 + six =