ত্বকের যত্নে টোনার

নীলাঞ্জনা নীলা

ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে ত্বকেরও হতে থাকে নানা রকম পরিবর্তন। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীতে ত্বকের ধরন বদলে যেতে থাকে। জন্মগতভাবে কিছু মানুষের ত্বক পরিষ্কার থাকলেও বেশিরভাগ মানুষের ত্বকই থাকে সংবেদনশীল। তাই ত্বকের সুস্থতার জন্য ঋতুর সাথে সাথে ত্বকের যত্নে নিয়ে আসতে হয় পরিবর্তন। ইদানিং সবাই ত্বক নিয়ে সচেতন হলেও ত্বকের যত্ন কিন্তু করে আসা হচ্ছে সেই অনেক আগে থেকেই। তখন আজকালকার মতো এতো কিছু পাওয়া যেত না, প্রকৃতি থেকেই তারা খুঁজে নিত ত্বকের যত্ন নেওয়ার উপাদান। কাঁচা হলুদ, নিম পাতা, কমলার খোসা, ডাবের পানি, দুধের সর ইত্যাদি দিয়ে তারা সেরে নিত ত্বকের যত্ন। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এখন বাজারে পাওয়া যায় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রোডাক্ট। বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন ঋতু অনুযায়ী স্কিন কেয়ার রুটিন পরিবর্তন হলেও সানস্ক্রিন এবং ময়েশ্চারাইজার সবসময় ব্যবহার করা উচিত। আরেকটি জনপ্রিয় স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট হচ্ছে টোনার। ত্বক সংক্রান্ত যেকোনো সমস্যাতেই এখন বিশেষজ্ঞরা টোনার ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু ত্বকের যত্নে টোনারের ভূমিকা কি এবং এই টোনার আসলেই কি তার সম্পর্কে অনেকের ধারণা কম। জেনে নেওয়া যাক ত্বকের যত্নের টোনারের ভূমিকা সম্পর্কে।

টোনার কি

ত্বকের অ্যাসিডিক বা অ্যালকালাইনের মাপকাঠিকে বলা হয় পটেনশিয়াল অফ হাইড্রোজেন, সংক্ষেপে পিএইচ।  টোনারের কাজ হচ্ছে ত্বকের পিএইচ ভারসাম্য ঠিক রাখা। পিএইচ লেভেলের উপর নির্ভর করে আমাদের ত্বকের সুস্থতা। ত্বকের অধিকাংশ সমস্যা হয়ে থাকে পিএইচ এর ভারসাম্য ঠিক না থাকার কারণে। ত্বকের পিএইচ লেভেল মাঝে মধ্যে অনেক বেড়ে যায়। মানুষের ত্বকে সেবামের পিএইচ সাধারণত ৪.৫ থেকে ৫.৫ পর্যন্ত থাকে, যা স্কেল অনুযায়ী অ্যাসিডিক। অনেক সময় সেই লেভেল ৮/৯ হয়ে যায়। এর ফলে ত্বকে হতে পারে রুক্ষতা, লাল র‌্যাশ, নানা ধরনের সংবেদনশীলতা ও ব্রণ। তাই ত্বকের পিএইচ লেভেলে ঠিক রাখাটা অনেক বেশি জরুরি। সুতরাং টোনার ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয় পিএইচ লেভেল ব্যালেন্স রাখার জন্য। পিএইচ লেভেল ঠিক থাকলে ত্বকের অনেক সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। এছাড়াও টোনারের রয়েছে আরো কিছু উপকারিতা।

টোনারের উপকারিতা

১. ব্রণ কমাতে সাহায্য করে 

টোনার সাধারণত ক্লিনজিংয়ের পরের ধাপ। মুখ ভালো করে পরিষ্কার করে তবেই টোনার ব্যবহার করা উচিত। ত্বক সংক্রান্ত যত ধরনের সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম সমস্যা হচ্ছে ব্রণ। যে কোনো সময় মুখে উঠে যায় ব্রণ যা অত্যন্ত বিব্রতকর। সব ধরনের ত্বকে ব্রণ উঠতে পারে কিন্তু তৈলাক্ত ত্বকে ব্রণের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। টোনার হতে পারে এই অতিরিক্ত ব্রণ সমস্যার সমাধান। নিয়মিত টোনার ব্যবহারের ফলে ব্রণের সমস্যা কমে আসে। তৈলাক্ত ত্বকে বেশি ব্রণ দেখা যায়, টোনার অতিরিক্ত তেল নিঃসরণ বন্ধ করতে সাহায্য করে। আবার পিএইচ লেভেল ঠিক রাখে বলে শুষ্কতাও খুব বেশি দেখা দেয় না, তাই শুষ্ক ত্বকের অধিকারীরাও বেঁচে যান ব্রণের ঝামেলা থেকে।

২. বলিরেখা কমায়

একটি নির্দিষ্ট বয়সে ত্বকে বলিরেখা দেখা দেয়। অনেকের আবার সময় ও বয়সের আগেই ত্বকে বলিরেখা পড়ে যায়। বলিরেখা পড়ার অন্যতম কারণ সূর্যের আলো। সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মি সম্পর্কে কম বেশি ধারণা থাকার পরেও আমরা সানস্ক্রিন ব্যবহারে অনীহা করি। সূর্যের ক্ষতিকারক আলোর ফলে অপরিণত বয়সে বলিরেখা দেখা দেয়। এখন সবাই বেশ স্বাস্থ্য সচেতন হবার কারণে কমবেশি অনেকে ডায়েট করে থাকেন। ডায়েটের ফলে খাদ্য তালিকা থেকে চর্বি পুরোপুরি বাদ দিয়ে দেন। শরীর যদি তার চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণ ফ্যাট না পায় তাহলে ত্বকে অকালে বলিরেখা পড়তে পারে। বর্তমান জীবনযাত্রায় বেশিরভাগ মানুষেরই ঘুমের রুটিন এলোমেলো। রাত জাগা ও পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবেও অকালে বলিরেখা পড়তে দেখা যায়। লাইফস্টাইলের প্রভাব আমাদের শরীর ও ত্বকের উপর পড়ে। এই বলিরেখা কমাতেও কিন্তু টোনার বড় ভূমিকা পালন করে। বলিরেখা কমানোর জন্য টোনার ব্যবহার করলে অবশ্যই তা নিয়মমাফিক ব্যবহার করতে হবে। কারণ বলিরেখা সহজে যেতে চায় না। টোনার ব্যবহারের পাশাপাশি জীবনযাত্রায়ও পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন খাদ্যতালিকায় সঠিক পরিমাণে পুষ্টি রাখা, প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমান। এছাড়া বাইরে বের হওয়ার আগে সানস্ক্রিন ব্যবহার, রোদে যাওয়ার আগে ছাতা এবং সানগ্লাস ব্যবহার করার অভ্যাস করতে হবে।

৩. ত্বককে হাইড্রেট করে

শরীরের মতো ত্বকেও দেখা দিতে পারে ডিহাইড্রেশন। পানিশূন্যতা দেখা দিলে ত্বক ডিহাইড্রেট হয়ে পড়ে। যেকোনো ঋতুতে ত্বক ডিহাইড্রেট হতে পারে। গরমকালে অতিরিক্ত ঘাম হয় কিন্তু দেখা যায় সেই তুলনায় তরল জাতীয় খাবার খাওয়া হয় না। সেক্ষেত্রে শরীর ও ত্বক দুই স্থানেই পানিশূন্যতা দেখা দেয়। আবার শীতকালে আবহাওয়া ঠান্ডা থাকার কারণে তৃষ্ণা কম লাগে ও পানি কম খাওয়া হয়। ক্ষেত্রেও পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। ত্বক ডিহাইড্রেটেড হয়ে গেলে উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলে। চামড়া অনেক বেশি শুষ্ক হয়ে যায় ও চামড়া উঠে আসে। তাই ত্বককে হাইড্রেট রাখার জন্য টোনার ব্যবহার করা জরুরি। এছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি ও তরল জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করতে হবে।

৪. ত্বকের পোরস কমায়

সব মানুষের ত্বক পোরস রয়েছে, পোরস ত্বকে অতিরিক্ত তৈলাক্ত হতে বাধা দেয়। সুতরাং বলা যায় পোরস থাকা ত্বকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু স্কিনের ইলাস্টিন ও কোলাজেন লুজ হতে শুরু করলে পোরস চোখে পড়া শুরু করে। পোরস সাধারণত চোখে পড়ার কথা না, পোরস বড় হয়ে গেলেই দেখা যায়। যা ত্বকের সৌন্দর্য নষ্ট করে এবং নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। পোরস অতিরিক্ত বড় হয়ে গেলে ব্রণের মতো সমস্যা দেখা দেয় ও মেকআপ বসতে চায় না। নিয়মিত টোনার ব্যবহারের ফলে পোরস ছোট হয়ে আসে।

টোনার ব্যবহারে সাবধানতা

টোনার যেমন ত্বকের উপকার করতে পারে তেমনি সঠিক টোনার বেছে না নিলে ত্বকের ক্ষতিও হতে পারে। তাই ভালো ব্রান্ডের এবং মানের একটি টোনার বেছে নিতে হবে। সব ত্বকের জন্য কিন্তু সব ধরনের টোনার মানানসই না। তাই কারো মুখে শুনে টোনার ব্যবহার না করে নিজের ত্বকের জন্য উপযোগী টোনার বেছে নেওয়া উচিত। যেমন তৈলাক্ত ত্বকের জন্য গ্লাইকোলিক, স্যালিসাইলিক অ্যাসিডযুক্ত টোনার ভালো। আবার শুষ্ক ত্বকের জন্য হায়ালুরনিক অ্যাসিড, ভিটামিন ই ও গ্লিসারিনযুক্ত টোনার বেছে নিতে হবে। বাজারে কিছু টোনারে অ্যালকোহল ব্যবহার করা হয়। কিন্তু অ্যালকোহল ত্বকের জন্য ক্ষতিকারক। তাই টোনার কেনার আগে ভালো করে যাচাই করে নিতে হবে টোনারটি অ্যালকোহল মুক্ত কি না।

ঘরেই তৈরি করে নিন টোনার

বাজারে এখন বিভিন্ন ভালো ব্রান্ডের টোনার থাকার কারণে ঘরে টোনার তৈরি করার বাড়তি ঝামেলায় অনেকেই যেতে চান না। কিন্তু রান্নাঘর কিংবা ফ্রিজে থাকা প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে খুব সহজে ঘরে টোনার তৈরি করে নেওয়া যায়।

১. গোলাপজল: ত্বকের জন্য গোলাপজল কতটা উপকারী একথা নতুন করে বলার কিছু নেই। গোলাপজলের সাথে লেবুর রস মিলিয়ে তৈরি করে নিন গোলাপজলের টোনার। ইচ্ছে করলে লেবুর রস ব্যবহার না করে শুধু গোলাপ জল টোনার হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

২. শসার রস: শসার রস হতে পারে খুবই ভালো একটি প্রাকৃতিক টোনার। শসার রস বের করে তা ত্বকে ব্যবহার করলে অনেক রিফ্রেশ ও হাইড্রয়েড হয়ে ওঠে। অনেকের রোদে পুড়ে স্কিনে কালো ছোপ ছোপ দাগ পড়ে, শসার রস সেই দাগ কমাতে সাহায্য করে।

৩. গ্রিন টি: অনেক নামিদামি ব্রান্ডের টোনারে গ্রিন টি ব্যবহার করা হয়। গ্রিন টিতে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান। গ্রিন টির সাথে কয়েক ফোঁটা এসেনশিয়াল অয়েল মিশিয়ে তৈরি করে ফেলুন গ্রিন টি টোনার।

৪. পুদিনা পাতা: ১ লিটার গরম পানিতে পুদিনা পাতা ছেড়ে ১০ মিনিট রেখে দিন। তারপর পানি ছেঁকে নিয়ে তা ঠাণ্ডা হতে দিন। তুলার সাহায্যে পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে নিন। এটি ত্বক পরিষ্কার করে ও টোনার হিসেবেও কাজ করে।

৫. গোলাপের পাপড়ি: গোলাপ জল খুবই উত্তম টোনার হিসেবে কাজ করে। ১/২ লিটার পানিতে ৫টি ডিস্টিল ওয়াটার ও ৮টি গোলাপের পাপড়ি মিশিয়ে অল্প আঁচে জ্বাল করুন। যখন পানিটি প্রায় বেগুনি রঙ ধারণ করবে তখন চুলা থেকে নামিয়ে নিন। ঠান্ডা করে পানিটি ছেঁকে নিন। এভাবে গোলাপ জল তৈরি করে আপনি এক মাস ফ্রিজে রেখে সংরক্ষণ করতে পারেন। প্রতিদিন ২-৩ বার আপনি এটি ব্যবহার করতে পারেন।

৬. বরফ: টোনার হিসেবে বরফের ব্যবহার অতি পরিচিত। প্রতিদিন সকালে ও রাতে মুখ ধুয়ে নিয়ে আপনি ৩-৪ টুকরো বরফ ঘষে নিতে পারেন। বরফ আপনার ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে আর সেই সাথে খোলা লোমকূপ বন্ধ করে দেয়। ত্বকের তৈলাক্ত ভাব দূর করতেও আপনি বরফ ব্যবহার করতে পারেন।

৭. লেবু: লেবুর রস মুখে ঘষে ১০ মিনিটের জন্য অপেক্ষা করুন। তারপর পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।

৮. অলিভ অয়েল: ১/৪ চামচ অলিভ অয়েল, ১/৪ চামচ লেবুর রস ও ১ চামচ মধুর মিশ্রণ তৈরি করে মুখে লাগিয়ে ১০ মিনিট অপেক্ষা করুন। তারপর কুসুম গরন পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।

৯. ডিম: মুখ ভালো করে ধুয়ে নিয়ে ডিমের সাদা অংশ লাগিয়ে ১০-১৫ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন। এটি মুখের দাগ দূর করতেও কাজ করে। প্রতি রাতে শোবার আগে আপনি এটি ব্যবহার করতে পারেন। ১ চামচ দুধ, ১ চামচ মধু ও একটি ডিম নিয়ে মিশ্রণ তৈরি করুন। ১৫ মিনিট মুখে লাগিয়ে রাখার পর ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।

১০. টমেটো ও মধু: ৩ চামচ টমেটোর রস ও ১ চামচ মধু মিশিয়ে একটি ঘন পেস্ট তৈরি করে লাগিয়ে নিন। ১৫ মিনিট রেখে ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।

১১. মধু ও লেবু: মধু ও লেবুর মিশ্রণ খুবই জনপ্রিয় টোনার হিসেবে কাজ করে। এই প্যাকটি ত্বককে মসৃণও করে তুলে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: আরশি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

1 + twenty =