মো. আখতারুজ্জামান : ইলেট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে যে ব্যবসা করা হয় তাকে ই-কমার্স বলে। বাংলাদেশে ই-কমার্সের শুরু ২০১১ সালে। সেই সময়ে মাত্র একটি প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করলেও দীর্ঘ ১০ বছর নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এই খাতে বর্তমান প্রায় দুই হাজার প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করছে। এছাড়া ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগযোগমাধ্যম ভিত্তিক ৫০ হাজার উদ্যোগ রয়েছে। বর্তমানে দেশে ই-কমার্সের আকার প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)-এর তথ্যমতে, করোনাকালীন দেশে ই-কমার্স প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য এবং ঔষধি পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের পরিমাণ হারে বেড়েছে। ২০২০ সালে বাংলাদেশে ই-কমার্স বাজারের আকার ১৬৬ শতাংশ বেড়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ই-কমার্সের আকার প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দেশের ই-কমার্স প্রতিবছর ৫০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই হারে বাড়তে থাকলে আগামী ২০২৩ সালের মধ্যে দেশে ই-কমার্স খাতের পরিমাণ ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে বলে বেসিসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। তবে এই খাতের মোট উদ্যোক্তাদের মধ্যে মাত্র ৭ থেকে ৮ শতাংশ তাদের উদ্যোক্তা সাফল্য পেয়েছেন। ব্যর্থতার বিষয়ে সঠিক পরিকল্পনা ও সঠিক অর্থায়নকে দায়ি করা হচ্ছে।
প্রতিনিয়ত ই-কমার্সখাতে উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে ই-কমার্সের কোনো নীতিমালা ও আইন না থাকায় যে যার মত করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে সরকার নীতিমালা করার জন্য কাজ করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ই-কমার্সে পেমেন্ট নিয়েও নানা সমস্যা রয়েছে। আমাদের দেশের লোকজন এখনও কার্ড পদ্ধিতে তেমন একটা অভ্যস্ত নয়। অন্যদিকে মোবাইল ব্যাংকিংও তেমন ভালো অবস্থান তৈরি হয়নি। ফলে ই-কমার্সের পেমেন্ট মোবাইল ব্যাংকিং বা কার্ড পদ্ধিতের বাহিরেও নগদ টাকায় পণ্য দেয়া হচ্ছে। এতে করে ব্যবসায়ীদের ব্যয়সহ পেমেন্টে ঝুঁকি থাকছে। দিন যত যাচ্ছে ই-কমার্সখাতে প্রতারণার হারও বাড়ছে। কিছু উদ্যোক্তা তাদের গ্রাহকদের সঙ্গে কমিটমেন্ট ঠিক রাখছেন না। ফলে অনেকেই অনলাইনে পণ্য বা সেবা ক্রয়ের মাধ্যমে প্রতারিত হচ্ছেন।
এই অবস্থান থেকে ই-কমার্সখাতকে বের করে নিয়ে আসতে না পারলে ভালো কিছু করা অনেকটা কষ্টকর হয়ে পড়বে। তাই আস্থার জায়গা তৈরি করতে হলে প্রতারণা দূর করতে হবে। বড় বড় অনেক প্রতিষ্ঠানও পেমেন্ট ও রিফান্ড নিয়ে ঝামেলা করে, দীর্ঘ সময় নেয়। যদিও নতুন নীতিমালায় বেশ কিছু বিষয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। নীতিমালাটি বাস্তবায়ন হলে এসব প্রতারণাসহ গ্রাহকদের আস্থার জায়গা তৈরি হবে। পাশাপাশি এই খাতের প্রবৃদ্ধি বর্তমানে চেয়ে বেশি হবে। স্বচ্ছ নীতিমালা প্রণয়ন করা গেলে আগামী বছর ই-কমার্স খাতে ৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমানে সব খাতেই ই-কমার্স পদ্ধতিতে ব্যবসা শুরু হয়েছে। পাড়ামহল্লার ছোট ছোট মুদির দোকান থেকে শুরু করে দেশের বড় বড় চেইন সুপার মার্কেটগুলোর অনলাইনেও পণ্য বিক্রি কছে। অনেক ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মেও ছোট ছোট উদ্যোক্তা, মার্চেন্টদের যুক্ত হওয়ার হার বেড়েছে। নিজেদের সাইট থাকার পাশাপাশি বড় মার্কেটপ্লেসে নিজেদের সাইটকে সাজিয়েছেন অনেকে। সেখানে নিজের প্রতিষ্ঠানকে একটা বড় পরিমণ্ডলে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
নিত্য প্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছুই অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। কোরবানি ঈদে অনেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান, মার্কেটপ্লেস, সাধারণ প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ওয়েবসাইট, অ্যাপ তৈরি করে কোরবানির পশু বিক্রি করে। ই-ক্যাবের দেওয়া এক হিসাবে দেখা গেছে, অনলাইনে অন্তত ২৭ হাজার গরু বিক্রি হয়েছে। এছাড়া এই হিসাবের বাইরে আরও লাখখানেক কোরবানির পশু বিক্রি হয়েছে বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফরম, অনলাইন শপ ইত্যাদি থেকে পরোক্ষভাবে। সংগঠনটির দাবি, অন্তত ৫ লাখ গরু ফেসবুকসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফরমে প্রদর্শিত হয়েছে, যা অন্যান্য বছরের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি।
২০১১ সালে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশের ই-কমার্স সাইট সেলবাজার ডট কম যার বতর্মান নাম এখনি ডট কম এবং আজকের ডিল ডট কম। এর এক বছর পরে ২০১২ সালে যাত্রা শুরু করে রকমারি ডট কম। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে ই-কমার্স জগতে তৈরি হয় নতুন দিগন্ত। আরেকটি জনপ্রিয় ইকমার্স সাইট প্রিয়শপ ডট কম।
২০১৪ সালে ই-কমার্স বেশ জনপ্রিয়, কুরিয়ার সার্ভিস, পেমেন্ট গেটওয়েসহ ই-কমার্সের জন্য দরকারি অনেক ইনফ্রাস্টাকচার ছাড়াই ই-কমার্স এগিয়ে যেতে। এ বছরেই আসে যুক্ত হয় মোট চারটি পেমেন্ট গেটওয়ে কোম্পানি। ২০১৩ সালে এখানে ক্যাশ অন ডেলিভারি সার্ভিস চালু করে সোনার কুরিয়ার কোম্পানি। ২০১৪ সালে ই-কুরিয়ার নামে আরেকটি কোম্পানি এবং অরামেকস আসায় উদ্যোক্তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। তবে ফেসবুকে বিজনেস শুরু হওয়ার পর পরই এদেশে ই-কমার্স বিকশিত হতে থাকে আর এর পিছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে মোবাইল ব্যাংকিং ব্রান্ড বিকাশসহ অন্যান্য মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলো। এরপর থেকে শুরু হয় দেশের ই-কমার্সখাতের সফলতা।
আজকের যে ই-কমার্স তা কিন্তু একদিনে হয়নি। এর পেছনে অনেক ত্যাগ এবং বিনিয়োগ রয়েছে। ১৯৯২ সালে বুক স্ট্যাকস আনলিমিটেড বুকস ডট কম নামে প্রথম ই-কমার্স শুরু করে অনলাইন পেমেন্ট প্রসেসিং ব্যবহার করে। ১৯৯৫ সালে শুরু হয় আমাজন ডট কম। ডেল এবং সিসকো ও তাদের অনলাইন ট্রাঞ্জেকশন শুরু করেন। ১৯৯৬ সালে ভারতে বিটুবি ট্রানজেকশানের জন্য প্রথম ইন্ডিয়ান ই-কমার্স সাইট ইন্ডিয়ামার্ট যাত্রা শুরু করে। ১৯৯৯ সালে যাত্রা শুরু করে চীনের ই-কমার্স জায়ান্ট আলিবাবা ডট কম। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশে মুন্সিজি ডট কম নামে একটি ই-কমার্স সাইটে আসে। এরপর শুরু হয় রূপকথার মত পরিবর্তন। ২০০১ সালে আলিবাবা ডট কম লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ২০০৩ সালে আমাজন ডটকম প্রথম লাভের মুখ দেখে এবং তারা তাদের প্রথম বাৎসরিক প্রফিট ঘোষণা করে। আর আজকে এরাই বিশ্বব্যাপী সেরা ই-কমার্সের তালিকায় নিজেদের নাম লিখিয়েছে।