নাচ-অভিনয় মডেলিং সবটাতেই দক্ষ বিজরী

নাহিন আশরাফ

অসাধারণ বাচনভঙ্গি ও ন্যাচারাল অভিনয় দিয়ে মন কেড়েছেন দর্শকের। এছাড়া নাচেও তিনি রাজত্ব করেছেন। প্রথম ভালোবাসা বলতে তার কাছে নাচই। অনেকে তাকে শুধু নৃত্যশিল্পী হিসেবেও চিনে থাকে। বাবা মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ নাট্য ও মিডিয়াব্যক্তিত্ব ও মা জিনাত বরকতুল্লাহ দেশের একজন বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে মিডিয়াতে তার বিচরণ অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। বুঝতে শেখার আগেই তিনি টিভির পর্দায় হাজির হন। বিটিভিতে নাশিদ কামালের উপস্থাপনায় ‘মাকে নিয়ে’ নামে ছোটদের একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি প্রথম ক্যামেরার সামনে আসেন। তখন তার বয়স ছিল আড়াই বছর।

বিজরী ‘সুখের ছাড়পত্র’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন ১৯৮৮ সালে। নাটকটির পরিচালক ছিলেন তার বাবা মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ। তারপর অনেকদিন বিরতির পর বিজরী ‘কোথাও কেউ নেই’ ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করেন। কালজয়ী এই ধারাবাহিক নাটকে অভিনয়ের পর তার আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দর্শকদের উপহার দিয়েছেন একের পর এক অসাধারণ নাটক। এরপর তিনি মাহফুজ আহমেদের সাথে ‘মেঘ কালো’ নাটকে অভিনয় করেন। তার উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেওয়া’ চলচ্চিত্রভিত্তিক নাটকে। পাশাপাশি অনেক জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনের মডেল হয়েছেন তিনি।

ছোটবেলা বেশ শান্ত প্রকৃতির মেয়ে ছিলেন বিজরী। মা বলতেন বিজরীকে বড় করতে কোনো কষ্টই হয়নি। যখন মা যা বলতেন বিজরী তাই করতেন। খুব নিয়মমাফিক দিন কাটাতেন ছোটবেলায়। গান, নাচ ও পড়ালেখা নিয়েই কেটেছে তার ছোটবেলা। পড়ালেখা করতেন ভিকারুননিসা স্কুল এবং কলেজে। বড় হয়েছেন বেইলি রোডের একটি সরকারি কলোনিতে। ছোটবেলায় নাচের শুরু মায়ের হাত ধরেই। সংস্কৃতিমনা পরিবারে বড় হয়ে ওঠার কারণে নাচ ও গান ছিল তার কাছে খুবই সাধারণ ব্যাপার। সকালে তাদের ঘুম ভাঙতো হারমোনিয়ামের শব্দ। স্কুলে গিয়ে পড়ালেখা শুরু করার আগেই তিনি শুরু করেন নাচ। আর মা যেহেতু একজন নৃত্যশিল্পী তাই নাচের প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ। অভিনয় জগতে আসবেন তা কখনোই চিন্তা করেনি।

বিটিভিতে নিতান্তই শখের বসে অভিনয়ের অডিশন দেন ও সুযোগ পেয়ে যান। এরপর হুমায়ুন আহমেদের ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে অভিনয় করে বেশ জনপ্রিয় মুখ হয়ে উঠেন তিনি। মেধা, পরিশ্রম ও একাগ্রতা দিয়ে যেকোনো কিছু অর্জন করা যায়। এ যোগ্যতাকে পুঁজি করে সুঅভিনয় দিয়ে ছোট পর্দায় হাতেগোনা কয়েকজন পৌঁছে গেছেন অন্যরকম উচ্চতায় বিজরী বরকতুল্লাহ তাদেরই একজন। ঠিক ৩০ বছর আগে ‘সুখের ছাড়পত্র’ দিয়ে শুরু হয় তার অভিনয় ক্যারিয়ার।

বিজরী বলেন, ‘দেখতে দেখতে ৩০টি বছর কেটে গেছে। মনে হয়, এই তো সেদিন শুরু করলাম। মাঝে এতগুলো বছর গেল, টেরই পাইনি! ক্যারিয়ারে দশর্কদের অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। তাদের ভালোবাসার ডানায় ভর করেই এতটা সুখের পথ পাড়ি দিতে পেরেছি।’ সাহিত্যনির্ভর কাজে তিনি সবসময় বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলদাসের উপন্যাস থেকে নাটক ‘এখন তুমি কেমন আছো’, রবীন্দ্রনাথের গল্প অবলম্বনে  ‘শেষ পুরস্কার’সহ অনেক নাটক দিয়েই দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি। সম্প্রতি দুরন্ত টিভিতে বিজরী অভিনীত ধারাবাহিক নাটক ‘বাবা থাকে বাসায়’  বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ নাটক নিয়ে বিজরী বলেন, ‘শিশুতোষ গল্প অবলম্বনে নাটকের কাহিনী সাজানো হয়েছে। গল্পের দুই চরিত্র ভাষা ও উদয়। প্রতিদিনই নিত্যনতুন সমস্যার মুখোমুখি হয় তারা। কারণ তাদের মা সারাদিন থাকেন অফিসে, আর বাবা বাসায়। নানা কারণে বাবা বাসার সব কাজ সামলে উঠতে হিমশিম খান। এরই মধ্যে বাচ্চাদের নানা ঝামেলা নিয়ে গল্পটি এগিয়ে যায়।

কাজের পরিমাণ নয় কাজের কোয়ালিটিকে বিজরী  সবসময় গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তার ব্যক্তিত্বের সাথে যাবে এমন কাজ তিনি সবসময় বেছে নেওয়ার চেষ্টা করেন। বড় পর্দায় অনেকবার কাজের সুযোগ পেলেও সে সুযোগ তিনি গ্রহণ করেননি। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন সবার সবকিছু পারতে হবে ও করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তবে যে কাজই তিনি করেন নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে করার চেষ্টা করেন। উপস্থাপনা করেও তিনি দর্শকের বেশ সাড়া পেয়েছিলেন। উপস্থাপক হিসেবে তিনি বেশ প্রাণবন্ত। টেলিভিশনের পর্দায় তাকে খুব কম দেখা গেলেও তিনি সবসময় তার সাথে মানানসই ভূমিকায় অভিনয় করেন। বেড়ে উঠেছেন একটি সংস্কৃতিমনা পরিবারে যেখানে সবসময় উৎসাহ দেওয়া হয়েছে নাচ-গান এবং অভিনয়কে। ছোটবেলায় বেইলি রোডের যে কলোনিতে তিনি থাকতেন সে বাসাটা ছিল ছোট কিন্তু বাসার এক কোণা ভর্তি ছিল শুধু বই আর বই। তাই ছোটবেলা থেকেই উপন্যাস পড়ে বড় হয়েছেন।

বই পড়ার এই অভ্যাস তাকে অভিনয় এবং তার কাজের ক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করেছে। ছোটবেলায় অডিশন বা পরীক্ষা সবকিছুতেই তিনি ভালো করতে পেরেছেন শুধুমাত্র বই পড়ার অভ্যাসের কারণে। বাবা-মা মিডিয়াব্যক্তিত্ব হবার কারণে চর্চা করার সুযোগ ও পরিবেশ পেয়েছেন ঠিকই কিন্তু অভিনয়ের যাত্রায় লড়াই করতে হয়েছে তার একাই। তবে বিজরী সবসময় বলেন, আজকে তিনি যা তার সম্পূর্ণ অবদান তার বাবা-মায়ের। কারণ তারা উৎসাহ না দিলে কখনোই তিনি এভাবে নিজেকে তৈরি করতে পারতেন না। ছোটবেলায় নাচ-গান দুটির প্রশিক্ষণ নিতেন তিনি। নাচের ক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করলেও গানের চর্চা বেশিদিন করেননি। এর কারণ তিনি জানান, নাচ ও গান দুটো শিখতে গিয়ে তার মনে হয়েছে সবকিছু সবার জন্য না। গান ও নাচ দুটোর সাধনা একসাথে করা সম্ভব নয় বলে তিনি নাচকেই বেছে নিয়েছেন। তার সবচেয়ে পছন্দের বিষয় হলো নাচ। নিজেকে নৃত্যশিল্পী পরিচয় দিতে তিনি বেশি পছন্দ করেন।

সম্প্রতি শিল্পীদের আত্মহত্যা প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে বিজরী গণমাধ্যমকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, শিল্পীরা অনেক বেশি আবেগী হন বিশেষ করে তাদের কাজ নিয়ে। শিল্পীদের খুব বেশি চাওয়ার নেই শুধু তারা চায় সম্মান। সেই প্রাপ্য সম্মানটুকু যখন তারা পায় না তখন তাদের মধ্যে বিষণ্নতা জন্ম নেওয়া খুবই স্বাভাবিক। শুধু শিল্পী কেন যে কেউ তার কাজের সম্মান না পেলে বিষণ্নতায় ভুগতে পারে! দিনের পর দিন অবহেলিত হতে হতে, অনেক সময় বিষণ্নতার শিকার হয়ঠ। সেই বিষণ্নতা এমন জায়গায় গিয়ে আটকে যায় যে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। তবে অবশ্যই আত্মহত্যা কোনো কিছুর সমাধান নয়। দেশের নৃত্যশিল্পীদের নিয়ে বিজরী বলেন, বাংলাদেশের নৃত্যশিল্পীরা অনেক বেশি অবহেলিত। অন্য শিল্পীদের অনেক বেশি কদর করা হলেও নৃত্যশিল্পীদের খুব একটা কদর দেখা যায় না। আমরা মঞ্চে তিন থেকে চার মিনিটের একটি নাচ দেখি ঠিকই কিন্তু এই নাচের পেছনে থাকে অনেক বড় বাজেট এবং অনেক দিনের চর্চা। সত্যিকারের সাধনা ও চর্চা যেসব ছেলেমেয়েরা করতে চায় তাদের নিয়েই আমরা কাজ করতে চাই।

বিজরী ২০১৩ সালের ১৪ এপ্রিল অভিনেতা ইন্তেখাব দিনারকে বিয়ে করেন। পরিবারকে সময় দেওয়ার জন্য বিজরী বরকতুল্লাহ দীর্ঘদিন অভিনয় থেকে দূরে ছিলেন। কিন্তু এখন তাকে বিজ্ঞাপন ও কিছু নাটকে দেখা যাচ্ছে। অভিনয়ে বিরতির পাশাপাশি তিনি নাচ থেকেও কিছুটা বিরতি নিয়েছিলেন। কারণ তিনি মনে করতেন, নাচ একটি চর্চার বিষয় যেহেতু ব্যস্ততার কারণে সেই চর্চাটুকু তিনি করতে পারেনি তাই নাচ করা হয়ে ওঠেনি।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সেলিব্রিটি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

fifteen − eleven =