শাপলা রহমান : ফেরদৌস আহমেদ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে একটি নাম, যার সঙ্গে হঠাৎ এবং বৃষ্টি দুটোই সম্পৃক্ত। কারণ ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ সিনেমার শিরোনামের মতোই রোমান্টিক সিনেমার জগতে ফেরদৌস হয়ে ওঠেন হঠাৎ এক আলোর বিচ্ছুরণ। এখনও রোমান্টিক ঘরানার ছবিতে ফেরদৌসের নাম আসবেই। যদিও তার নাম আজকাল চলে আসছে ভারতীয় রাজনীতিবিদদের মুখে। এমন কী শীর্ষ দুই নেতা তাকে নিয়ে আলাপ করছেন, অথচ তিনি নিজে নেই সেই আলোচনার মাঝে। বছর দুএক আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেওয়া থেকেই যত বিপত্তির শুরু। এরপর ভিসা বাতিল হওয়ার পাশাপাশি আরও নানা খেসারত দিতে হয়েছে ফেরদৌসকে।
ফেরদৌস বলেন, ছোট্ট একটা ভুল। না বুঝেই করা। কিন্তু তার অনেক বড় মাশুল গুনতে হচ্ছে এখন আমাকে। কারণ ভারতে আর যাওয়ার অনুমতি মিলছে না তার সহসাই।
আবার এবছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরকালে তার কিছু বিষয় নিয়ে কটাক্ষ করার সময় ফেরদৌসের ভিসা বাতিল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। এসবে বরং বেশ অপ্রস্তুত ফেরদৌস নিজেই। তিনি মনে করেন ওই দেশের প্রচারণায় তার অংশ নেওয়াটা এবং সেটার জের এখন অবধি চলে আসা মোটেও সুখকর নয়।
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক, যার শুটিং হচ্ছে ভারতে, সেখানে অভিনয় করতে না পারার দুঃখটাই অনেক বেশি। তবুও স্বাধীনতার ৫০ বছর এবং বঙ্গবন্ধুর জন্ম শত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে নির্মিত অন্য সিনেমায় অংশ নিয়ে সেই দুঃখটা লাঘব হয়েছে অল্প স্বল্প।
বড় পর্দার পাশাপাশি মঞ্চেও সরব তিনি সফল উপস্থাপক হিসেবে। তাকে দেখা যাবে একটি কৃষি-বিষয়ক সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে সঞ্চালনার দায়িত্বে। পূর্নিমাসহ। তবে এই কাজ তার অন্তরের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে মনে করেন তিনি।
ফেরদৌস বলেন, আমার দাদা ছিলেন কৃষক। আমার রক্তে আছে কৃষিকাজ। একারণেই এই উপস্থাপনার দ্বায়িত্ব পেয়ে আমি দারুণ খুশি। হেসে হেসেই ফেরদৌস বলেন, অনেকেই জানেন না, আমি কিন্তু এখনও কৃষক। আমাদের বাড়ির ছাদে এমন একটা বাগান আছে, যেখানে রোজ কিছু না কিছু উৎপাদিত হয়। আমার মায়ের ঔষধির ভাণ্ডার তো আছেই, এছাড়াও আছে অন্য সবজি।
ফেরদৌস জানালেন, সম্প্রতি তার মায়ের ছাদের বাগানে উৎপাদিত আখ দেখে মুগ্ধ তিনি।
শুধু ছাদ নয়, ঢাকার অদূরে নিজের এক টুকরো জমিতে নিয়মিত চাষ করেন ফেরদৌস। বাসায় আসে টাটকা সবজি। তাতে তার আনন্দের সীমা নেই।
নায়ক জানান, বড় পর্দার পর যে কাজে নিয়মিত হব, তা হলো চাষাবাদ। কারণ এটাই আমাদের মূল ভিত্তি। যে মাটিতে বীজ ফেললেই সোনা হয়, সেই মাটির কাছে ফিরতে হবেই।
বর্তমানে অনেক তরুণ কৃষিকাজ, খামার ব্যবসাতে ফিরছেন দেখে আরও উৎসাহী হয়ে উঠেছেন বড়পর্দার এই নায়ক। ‘চাষা’ বলে গালি দেওয়ার যে ভুল একটা ব্যাপার ছিল সেটাও অচীরে কেটে যাবে বলে তিনি মনে করেন।
ফেরদৌস মনে করেন, প্রতিটা মানুষই নিজের অঙ্গনে নিজের অবস্থানে নায়ক। শুধু তাকে ওই নায়কোচিত বিষয়টা প্রকাশ করতে হবে। আর যে নায়ক সে তো দেশের জন্যও নায়ক।
কৃষিব্যবসা নিয়ে ভীষণ আশাবাদী ফেরদৌস মনে করেন, এখন সুবর্ণ সময় চলছে নিজের দেশের মানুষের দেশের জন্য কাজ করার। আর যেহেতু নিজেকে কখনও নায়ক ছাড়া অন্য কোনও চরিত্রে ভাবতেই পারেননি ফেরদৌস, তাই পড় পর্দা কখনও ছাড়লে ফসলের ক্ষেতের নায়ক হবেন তিনি- এটা নিশ্চিত করে জানালেন।
তবে সহসাই ছাড়ছেন না বড় পর্দা। নায়ক ফেরদৌসকে আরও দেখা যাবে বহুদিন।
কারণ দূর্বার গতিতে চলছে তার তিনটি সিনেমার কাজ। আফজাল হোসেনের ‘মানিকের লাল কাঁকড়া’, হৃদি হকের নতুন সিনেমাসহ তিনটি ছবির কাজ চলছে। করছেন বিজ্ঞপন।
সব মিলিয়ে পর্দার এবং বাস্তব জীবনের নায়ক সরগরম করে রেখেছেন নিজের ক্যরিয়ার-পথটিকে। তবে এরপর আর কোনও অযাচিত ভুল নয়- এই আশ্বাসও দিতে ভুললেন না এই নায়ক।
উল্লেখ্য, ফেরদৌস আহমেদের জন্ম ৭ জুন ১৯৭২। বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে আবির্ভূত একজন জনপ্রিয় বাংলাদেশী চলচ্চিত্র অভিনেতা। তার অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র বুকের ভিতর আগুন, এটি পরিচালনা করেছেন ছটকু আহমেদ। পাশাপাশি তিনি কলকাতার চলচ্চিত্রে অভিনয় করছেন নিয়মিত। মিট্টি নামে একটি বলিউড এর চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। ১৯৯৮ সালে তিনি খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার বাসু চ্যাটার্জি পরিচালিত হঠাৎ বৃষ্টি ছবিতে অভিনয় করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশপাশি তিনি মডেলিং, টিভি উপস্থাপনা ও টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেছেন।
ফেরদৌস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়াশুনা করেছেন। চলচ্চিত্রে আসার আগে ফেরদৌস র্যাম্প মডেল হিসেবে কাজ করেছেন ফ্যাশন সেক্টরে। আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেলের হাত ধরে র্যাম্পে তার হাতেখড়ি। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বড় বড় বেশ কিছু ফ্যাশন শোর র্যাম্পিংয়ে তিনি অংশ নেন। সুন্দর মুখাবয়বের সঙ্গে পুরুষালী দৈহিক কাঠামো তাকে দর্শপ্রিয় করে তুলেছে। ২০১৫ সালে আরএফএল-এর ব্র্যান্ড এম্বাসেডর হন এবং তিনটি বিজ্ঞাপনে কাজ করেন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে তার অনবদ্য অভিনয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাকে চারবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র অভিনেতার পুরস্কারে ভূষিত করেছে। এগুলো হচ্ছে হঠাৎ বৃষ্টি (১৯৯৮), গঙ্গাযাত্রা (২০০৯), কুসুম কুসুম প্রেম (২০১১), ও এক কাপ চা (২০১৪)। ফেরদৌস অভিনীত সফল চলচ্চিত্রের মধ্যে হঠাৎ বৃষ্টি (১৯৯৮), চুপি চুপি (২০০১), প্রেমের জ্বালা (২০০২), বউ-শাশুড়ির যুদ্ধ (২০০৩), চন্দ্রকথা (২০০৩), ফুলের মত বউ (২০০৪), দুই নয়নের আলো (২০০৫), খায়রুন সুন্দরী (২০০৭), গোলাপী এখন বিলাতে (২০১০), গেরিলা (২০১১) অন্যতম।