পাস্তার গপ্পো

স্বাধীন রহমান

অধিবেশন শব্দটা শুনলে সবার আগে কি আসে মাথায়; কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কিংবা আন্তর্জাতিক বিষয়ে কোনো আয়োজনের কথা মাথায় আসে তাই তো? কিন্তু আপনি কি জানেন, পাস্তা নিয়েও হয়েছিল অধিবেশন।  তাও এক দফা নয়, দুই দফা অধিবেশনের আয়োজন করা হয় পাস্তা নিয়ে। আর দ্বিতীয় দফা অধিবেশনের শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কবে করা হবে পাস্তা দিবস। পাস্তা দিবসে পাস্তা লাভার্স কিংবা হেটার্স সবাই জেনে নিন পাস্তা নিয়ে মজার তথ্য আর রহস্য।

পাস্তাকাহন

টাটকা পাস্তার আঁতুড়ঘর হিসেবে চিহ্নিত করা হয় প্রাচীন রোমকে, সেখানে সুজিতে পানি যোগ করে পাস্তা বানানো হতো। বর্তমানে বাজারে সহজলভ্য শুষ্ক পাস্তার সঙ্গে সে পাস্তার তফাৎ ছিল। টাটকা পাস্তা বানিয়ে ফেলার পরপরই তা রান্না করে খেয়ে ফেলা হতো। অনেকের মতে, বিখ্যাত পর্যটক ও বণিক মার্কো পোলো চীন থেকে ইতালিতে পাস্তা নিয়ে আসেন। তবে ঐতিহাসিক তথ্যানুসারে, খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ সাল থেকে মানুষ পাস্তা খাওয়া শুরু করে। ময়দা, পানি ও ডিম দিয়ে তৈরি পাস্তা একসময় দক্ষিণ ইতালির প্রধান খাবার হয়ে ওঠে। কারণ, সিসিলি ও দক্ষিণ ইতালিতে গমের উৎপাদন বেশি এবং দামেও সস্তা ছিল। উত্তর ইতালিতে পাস্তার খামির বানাতে ময়দা ও ডিম ব্যবহার করা হয়। আবার দক্ষিণ ইতালিতে ব্যবহার হয় উৎকৃষ্ট মানের সুজি ও পানির মিশ্রণ।

আর শুরুতেই যে পাস্তা অধিবেশনের কথা বলছিলাম, তার ইতিহাস হলো ‘বিশ্ব পাস্তা দিবস’ ১৯৯৫ সালের ২৫শে অক্টোবর বিশ্ব পাস্তা কংগ্রেসের অংশ হিসেবে সবার সামনে নিয়ে আসা হয়েছিল। সারা বিশ্ব থেকে বিশেষজ্ঞরা নুডলসের বিশেষত্ব নিয়ে আলোচনা করতে একত্রিত হয়েছিলেন সেখানে। পাস্তার প্যানোরামা নামক সংগঠন বিশ্ব পাস্তা দিবসে পাস্তা খাওয়ার পাশাপাশি এর সাংস্কৃতিক ও রন্ধনসম্পর্কিত গুরুত্ব প্রচার করে। ওয়ার্ল্ড পাস্তা কংগ্রেস নতুন করে পাস্তা খাওয়ার জন্য উৎসাহিত করা থেকে শুরু করে এই জনপ্রিয় খাবার তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান এবং প্রচার করে থাকে। প্রত্যেক দেশকে যার যার মতো করে দিবসটি উদযাপন করতে উৎসাহিত করে তারা। ১৯৯৫ সালের ২৫ অক্টোবর ইতালির রোমে বিশ্ব পাস্তা কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৯৮ সালে নেপলস শহরে বসে তাদের দ্বিতীয় অধিবেশন। আর সেই অধিবেশনেই ২৫ অক্টোবরকে বিশ্ব পাস্তা দিবস হিসেবে পালন করার ঘোষণা দেওয়া হয়। বিশ্বে প্রায় ৬০০-এর বেশি আকৃতির পাস্তা রয়েছে।

পাস্তা ও তার প্রকারভেদ

পাস্তা মূলত দুই রকম। শুকনা ও তাজা। শুকনা পাস্তা বাজার থেকেই কেনা হয়, তাজা পাস্তা ঘরে তৈরি হয়। ইতালি ভাষা আলদান্তের অর্থ হলো রান্নার পর বেশি শক্ত হবে না, আবার নরমও হবে না। চিবানোর সময় একটু শক্ত লাগবে বা কচকচ করে চিবানো যাবে। ফলে পাস্তা হজম হতে সময় নেয়, সেইসঙ্গে পেটও ভরা থাকে অনেকক্ষণ। ম্যাকারনি, স্প্যাগেটি, মিলিনি, রাফিওলি, রিগাটনি বিভিন্ন রকম শুকনা পাস্তা আলদান্তে করে খাওয়া যায়। ঘরে তৈরি পাস্তার প্রণালি হলো ময়দার সঙ্গে ডিম মিশিয়ে খামির তৈরি করে বিভিন্ন আকারে তৈরি করে সেদ্ধ করা। এই তাজা পাস্তা শুকনা পাস্তার চেয়ে অর্ধেক সময়ে তৈরি হয়। অঞ্চল ভেদে পাস্তার নানা প্রকরণ পাওয়া যায়। উত্তর ইতালিতে পাস্তার খামির বানাতে ময়দা ও ডিম ব্যবহার হয় আবার দক্ষিণ ইতালিতে ব্যবহার হয় উৎকৃষ্ট মানের সুজি ও পানির মিশ্রণ।

পাস্তা নিয়ে রাজনীতি

কিছু রাজনৈতিক ঘটনা পাস্তাকে একরকম জাতীয় আইকনে পরিণত করে। ১৮৬০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইতালী একীত্রকরণের সময় এটি মুখ্য খাবারের একটিতে পরিণত হয়। পরবর্তীতে ইতালীয় সামরিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জিউসেপ গ্যারিবল্ডি ১৮৯১ সালে পেল্লেগ্রিনো আরটুসির লেখা ‘খধ ঝপরবহুধ রহ পঁপরহধ ব ষ’অৎঃব ও গধহমরধৎ নবহব’ নামক বইটি সবার মনযোগে নিয়ে আসেন, বইটি লেখা হয়েছিল পাস্তাকে কেন্দ্র করেই। উনবিংশ শতাব্দীতে আসা টমেটো সসকে ইতালীয়রা শুরুতে স্বাগত জানায়নি।

সস ও পাস্তার যুগলবন্দী

পাস্তার স্বাদু জগতে ডুব দেবার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পাস্তার সঙ্গে কোন সসটি খাওয়া হবে। পাস্তা ও সসের যথার্থ যুগলবন্দীই পারে পাস্তাকে অনন্যসাধারণ করে তুলতে। পাস্তার ধরন অনেকটা বলে দিতে পারে যে কোন সসের সঙ্গে এর যুগলবন্দী জমে যাবে। এক্ষেত্রে খুবই সাধারণ একটি নিয়ম মেনে চলা হয়, মোটা ভারী পাস্তার জন্য বেশি ঘন সস এবং হালকা পাস্তার জন্য পাতলা বা কম ঘনত্বের সস।

ঘরে তৈরি পাস্তার রেসিপি

অনেকেই মনে করেন ঘরে পাস্তা তৈরি করাটা একটু কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ। তবে তাজা, ঘরে তৈরি পাস্তা তৈরির সুবিধা অনেক। এটি তৈরি করার সবচেয়ে সহজ উপায় বাড়িতে পাস্তা প্রস্তুতকারক ব্যবহার করা। যা রান্নাঘরে সংরক্ষণ করার জন্য একটু ভারী হলেও পাস্তা তৈরিকে হাওয়াকে সহজ করে তোলে। পাস্তার রেসিপিটি মোটামুটি সহজ, মাত্র কয়েকটি উপাদান ব্যবহার করে। সাধারণ পাস্তাতে সুজি গমের আটা, ডিম, জলপাই তেল এবং কিছুটা লবণ থাকে। কিছু পাস্তার রেসিপিতে ডিম থাকে না, আবার যুক্ত হতে পারে পালং শাক, রোদে শুকানো টমেটো, জাফরান, ভাজা লাল মরিচ এবং আরও অনেক কিছু। যাদের কাছে পাস্তা মেকার নেই তারা অবশ্যই এটি হাতে তৈরি করতে পারেন। শত শত বছর ধরে ইতালির প্রতিটি বাড়িতেই হাতে তৈরি পাস্তার প্রচলন ছিল। ডো বানিয়ে সেগুলো বেলে বিভিন্ন শেইপ দিয়ে পাস্তা মেকার ছাড়াই পাস্তা বানানো সম্ভব। টাটকা পাস্তা বানানোর পরে পছন্দসই আকারে কেটে তারপর খোলা বাতাসে আংশিক শুকিয়ে নিতে হবে কিছুক্ষণ। এরপর তা সেদ্ধ করে রান্না করা যাবে।

পাস্তার আকারকাহন

আমাদের দেশে মূলত টিউব পাস্তাগুলোই বেশি পাওয়া যায়। যেমন বুকাটিনি, যা দেখতে স্প্যাগেটির মতোই, কিন্তু ফাঁপা। এছাড়া মোস্টাচ্চিওলি যেগুলোকে মাঝে মাঝে একে পেনের সাথে মিলিয়ে ফেলা হয়, যদিও আদতে এটি পেনে নয়। পেনে পাস্তার সঙ্গে এর তফাতটা এখানে যে, এর পেনের মতো উঁচুনিচু খাঁজকাটা নেই। মোস্টাচ্চিওলিকে ‘চবহহব খরংপব’ বা মসৃণ পেনেও বলা হয়। গঁংঃধপযবং (গোঁফ) অনুসারে এই নামকরণ করা হয়েছে। বা মেজ্জে বোমবার্ডোনি, যা বোমবার্ড পাস্তার ক্ষুদ্রতর রূপ। এগুলো আকারে ছোট ও প্রশস্ত হয়ে থাকে। এছাড়াও চ্যাপ্টা কিন্তু লম্বা আকৃতি পাস্তাগুলোকে বলা হয় ফেটুচ্চিনে পাস্তা। বো-টাই অথবা প্রজাপতির মতো দেখতে পাস্তাকে বলা হয় ফারফ্যাল্লে। বড় আকৃতির শামুকের মতো পাস্তা যার ভেতরে পুর দেওয়া যায় এমন পাস্তাকে বলা হয় কনচিগ্লিওনি। আর সামুদ্রিক শামুকের খোলের মতো দেখতে ছোট সাইজের পাস্তাকে বলা হয় কনচিগ্লি।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: দিবস

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

14 − two =