উপল বড়ুয়া
বিশ্বকাপের মাসখানেক আগে সাকিব আল হাসানকে এক শো’তে উপস্থাপিকা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘বাংলাদেশ কবে বিশ্বকাপ জিতবে?’ সাকিব তখন স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বলেছিলেন, ‘এ বছর (২০২৩), কারণ বাংলাদেশ আমার নেতৃত্বে খেলবে।’ তার এমন আত্মবিশ্বাসী কথা শুনে যে কেউ আশায় বুক বাঁধবে, সেটিই স্বাভাবিক। কারণ নামটা সাকিব বলেই। বিশ্বকাপের জন্য কত কী আয়োজন হলো। একের পর এক সিরিজ খেলল নিজেদের ঝালিয়ে নিতে। কিন্তু ভারতে যাওয়ার পর চিত্র পুরো উল্টো। এসব দেখে বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকদের মাথায় হাত। অনেকে হয়তো প্রথাবিরোধী বিখ্যাত লেখক হুমায়ুন আজাদের বই থেকে ধার করে হতাশা ঝাড়লেন এই বলে, ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’।
আমরা আসলে কেমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম? স্বাধীনতার পর সুস্থ, সুন্দর, শিক্ষিত, স্বাধীন, স্বাবলম্বী এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম নিশ্চয়। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সেটি তো হয়ইনি; ক্রীড়াক্ষেত্রেও কিছুই হয়নি। আশি-নব্বই দশকে ফুটবল জনপ্রিয় ছিল এ দেশে। আবাহনী-মোহামেডানের ঐতিহ্যের লড়াই এখন অতীত। নব্বই দশকের শেষ থেকে ফুটবলকে হঠিয়ে এই দেশে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠতে লাগল ক্রিকেট। ২২ গজে ব্যাট-বলের দীর্ঘ ব্যাটল। সেই জনপ্রিয়তা উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এত বছরে, এত বিনিয়োগের পর ক্রিকেট আমাদের কী এনে দিল? আজ সেই প্রশ্ন থাকল।
১৯৯৭ সালে আকরাম খানদের হাত ধরে কেনিয়াকে হারিয়ে আইসিসি ট্রফি জয়, যার কল্যাণে ১৯৯৯ বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়া। বাংলাদেশ ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপে খেলবে, এরচেয়ে আনন্দের আর কী ছিল! প্রথম বিশ্বকাপেই বাজিমাত। ‘বি’ গ্রুপে বাংলাদেশ ছয় দলে মধ্যে হয়েছিল পঞ্চম। হারিয়ে দিয়েছিল স্কটল্যান্ড ও গ্রুপ সেরা পাকিস্তানকে। ওয়াসিম আকরাম-ওয়াকার ইউনিসদের সেই দুর্দান্ত পাকিস্তান তো সেই হারের ক্ষত নিয়েই ফাইনাল খেলেছিল। পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের এই জয় যেন আরেকটি যুদ্ধ জয়ের গল্প উপহার দিয়েছিল এ দেশের মানুষদের। সেই আখ্যানের পর বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা পেতে বেশিদিন লাগেনি। পরের বছর বাংলাদেশে সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বে ভারত খেলে গেল প্রথম টেস্ট। হারলেও বাংলাদেশ যে সাদা পোশাকের ক্রিকেটও খেলতে জানে, সেটি বুঝিয়ে দিয়েছিল। এসব অতীত চারণ, বর্তমানকে বুঝানোর জন্য। কথায় আছে, ‘অতীত ভুলে যেতে নেই’।
কিন্তু বাংলাদেশের সবক্ষেত্রের মানুষ ‘গোল্ডফিশ’ মেমোরি নিয়ে ঘুরে। তারা ভুলে যায়। যেন বিখ্যাত লাতিন কথাসাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ উপন্যাসের কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া আমরা একেকজন। বাংলাদেশের ক্রিকেটও অতীত ভুলে গেছে। কত কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে আজকের ক্রিকেট এতদূর এসেছে, সেসব ইতিহাস যেন কারও মনে নেই। এখন আমরা তারকা পাচ্ছি ঠিক, কিন্তু খেলোয়াড় পাচ্ছি কই! লিওনেল মেসি ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসে আর্জেন্টিনাকে একটা ট্রফি এনে দিতে কী কষ্টটাই না করলেন! সেই মানসিকতা এখন আর সাকিবদের নেই। তারা খেলছেন বটে, খেলে টাকা পাচ্ছেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও (বিসিবি) ধনী ক্রিকেট বোর্ডের তালিকায় পাঁচে উঠে এসেছে। কিন্তু এদেশের ক্রিকেট কতদূর এগোলো?
কেন টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার ২৩ বছরেও লেখা হয়নি তেমন কোনো সাফল্য গাথা? বাংলাদেশ এ নিয়ে টানা সপ্তম ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলছে। কোনো বিশ্বকাপে জিততে পারেনি চারটা ম্যাচ। অথচ যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান তৃতীয় অভিযাত্রায় সেটি দেখিয়ে দিল। এ বিশ্বকাপে হাশমতউল্লাহ শহীদিরা হারিয়ে দিয়েছে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাকে। এই তিন দলই একবার করে বিশ্বকাপ জিতেছে। তাদের হারানোর তালিকায় নেদারল্যান্ডসও আছে। যেই ডাচরা ১২ বছর পর বিশ্বকাপ খেলতে এসেছে, যাদের টেস্ট স্ট্যাটাসও নেই তাদের কাছেই কি না আমরা হেরে যাই! এ লজ্জা রাখি কোথায়? এমন ব্যর্থতার ময়নাতদন্ত হওয়া উচিত। কিন্তু কে বা কারা করবে? সবাই তো নীতিনির্ধারকের ভূমিকা নিয়ে বসে আছে। গলদ তাদের চোখে পড়লেই তো! আবার ‘কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসা’র ভয়েও সেটি হবে না নিশ্চিত।
গত ৩ নভেম্বর দিল্লিতে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ সুজনের কাছ থেকে এসব বিষয়ে সাংবাদিকেরা জানতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশ দলে নিজের ভূমিকা নিয়ে ক্ষুব্ধ-হতাশ সুজন যেন কথা বলেও বললেন না। তবে ক্ষোভটা ঠিকই স্পষ্ট তার কণ্ঠে, ‘অবশ্যই আমি দলকে নিয়ে চিন্তা করছি। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়া তো আমার ভূমিকা না। একটা জায়গায় আমাকে বলে দেওয়া হয়েছে, আমি কতটুকু পারব, কতটুকু পারব না। আগে যে ভূমিকাগুলো ছিল, তাতে আমি নিজেকে জড়িত রাখার চেষ্টা করেছি। যেহেতু আমার রক্তেই ক্রিকেট, কোচিং আমার পেশা। যদিও বাংলাদেশের কোনো কোচিংয়ের সঙ্গে আমি জড়িত নই, টেকনিক্যাল মানুষ হিসেবে আমার আগের যে সফরগুলো ছিল, সেখানে খেলোয়াড়দের সঙ্গে ইনডিভিজ্যুয়ালি কথা বলেছি। কিন্তু এখন সেসব থেকে দূরে আছি। যেহেতু এসব আমার ভূমিকা না, বোর্ড থেকে আমাকে সেটা দেওয়া হয়নি।’
এরপর সাংবাদিকেরা সুজন থেকে জানতে চান, ‘দলে এমন দাদা হয়ে থাকতে হলে আসতেন (ভারত) কি না?’ টিম ডিরেক্টরের উত্তর, ‘আসতাম না। বিশ্বকাপে আসার সময় বলেছিলাম আমরা সেমিফাইনাল খেলব। আসলে কোন চিন্তা করে বলেছিলাম জানি না।’
শুরুতেই যে বলেছিলাম, সাকিব বিশ্বকাপ জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। শিরোপা না হলেও অন্তত বাংলাদেশ এবার সেমিতে খেলবে সেই আশা করার লোক কম ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশ বিশ্বকাপ খেলতে ভারতে গেল এক বোঝা বিতর্ক মাথায় নিয়ে। আফগানিস্তানের সিরিজের মাঝপথে চট্টগ্রামে সংবাদ সম্মেলন করে তামিম ইকবাল ওয়ানডে নেতৃত্ব ছাড়ার পর দায়িত্ব পান সাকিব। তিনিই এখন বাংলাদেশের তিন ফরম্যাটের অধিনায়ক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে তামিম ফের অবসর ভেঙে ফিরে নিউ জিল্যান্ড সিরিজেও খেলেন। বিশ্বকাপের দল ঘোষণার দিনক্ষণ তখন শেষদিকে। কিন্তু আবার বিতর্ক। বিশ্বকাপ স্কোয়াডে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ফিরলেও নেই তামিম। তারপর তো কাদা ছোড়াছুড়ি। বাংলাদেশ দলের দুই সিনিয়র ক্রিকেটার সাকিব-তামিম লেগে গেলেন বাকযুদ্ধে। সঙ্গে তাদের সমর্থকগোষ্ঠী সাকিবিয়ান-তামিমিয়ানরা তো আছেনই। কিন্তু একবারও কেউ ভাবল না এসব বিতর্ক একটা বড় টুর্নামেন্টের আগে কেমন ক্ষতি বয়ে আনতে পারে দলের জন্য। আর ঠিক সেটিই হচ্ছে। ২০০৩ বিশ্বকাপের পর সবচেয়ে বাজে পারফরম্যান্স বাংলাদেশের।
২০০৭, ২০১১, ২০১৫ ও ২১০৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ তিনটি করে ম্যাচ জিতেছে। তার মধ্যে শুধু একবারই নকআউট পর্বে যেতে পেরেছে, ২০১৫ বিশ্বকাপে মাশরাফি বিন মর্তুজার নেতৃত্বে। গত বিশ্বকাপে একক পারফরম্যান্স দিয়ে মুগ্ধ করেছিলেন সাকিব, কিন্তু এবার যেন তিনি ভিজে যাওয়া বারুদ। তবে কি তামিম বিতর্ক এখনো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেননি দলনেতা! তার যদি এমন অবস্থা হয় তবে দলের বাকিদের অবস্থা বুঝুন। না ব্যাটিংয়ে না বোলিংয়ে কোথাও কোনো পারফরম্যান্স নেই বাংলাদেশের।
এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সাকিবরা রাউন্ড রবিনে যে সাত ম্যাচ খেলেছে জিতেছে মাত্র প্রথম ম্যাচটি, আফগানিস্তানের বিপক্ষে। যে আফগানরা এখন চার ম্যাচ জিতে প্রথমবারে মতো শেষ চারে খেলতে নিজেদের ঢেলে দিতে চায়। বাংলাদেশের পারফরম্যান্স বলতে যা একটু মাহমুদউল্লাহর। এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের একমাত্র সেঞ্চুরিটি তার, সেটিও খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে। যা কয়েকটা রান এসেছে তার ব্যাট থেকে। অথচ ফর্ম নেই, বয়স হয়েছে দেখিয়ে তাকে গত এশিয়া কাপ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল।
সত্যি বলতে, সবচেয়ে ভালো করাটা এবারই সম্ভব ছিল। বেশ অভিজ্ঞ দল নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ খেলছে। সাকিব ও মুশফিকের এটি পঞ্চম বিশ্বকাপ। বাকি ৯ দলের কারও এই অভিজ্ঞতা নেই। মাহমুদউল্লাহর চতুর্থ। লিটন দাসসহ স্কোয়াড়ে থাকা আরও বেশ কয়েকজনের বিশ্বমঞ্চে খেলার অভিজ্ঞতা আছে। তারপরও কেন দলের এমন বেহাল দশা? সুজনের সঙ্গে সেই কথাবার্তায় তার কিছুটা ইঙ্গিত মিলে। তবে কি ব্যর্থ কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। বিশ্বকাপের পর তিনি সাকিবদের দায়িত্বে থাকবেন তো? সেই প্রশ্ন করা হয়েছিল সুজনকে। বাংলাদেশ টিম ডিরেক্টরও অবশ্য একটু কৌশলী এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন, ‘এসব বলাটা খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যায়, কারণ বিশ্বকাপ এখনো শেষ হয়নি। আমি যদি কিছু বলি, তবে সেটা খারাপ বার্তাই যাবে সবার প্রতি। হাথুরু এখনো আমাদের হেড কোচ, তার প্রতি আমাদের সেই বিশ্বাস থাকতে হবে বিশ্বকাপ শেষ না হওয়া পর্যন্ত। বিশ্বকাপের পর নিঃসন্দেহে সবকিছু বিসিবি সিদ্ধান্ত নেবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কী বললাম, এটা গুরুত্বপূর্ণ না।’
তবে হাথুরু নিয়ে মুখ বন্ধ রাখলেও বাংলাদেশের এই ভরাডুবির কারণটা নিয়ে ময়নাতদন্ত হোক সেটি চান সুজন। সবার শেষে বিশ্বকাপে গিয়ে সবার আগে বিদায়, এতদিন ধরে শীর্ষ পর্যায়ের ক্রিকেট খেলা একটি দেশের কর্মকর্তা হোক বা সমর্থকের সেটি মেনে নেওয়া বেশ কঠিন। বাংলাদেশের বিশ্বকাপ ব্যর্থতা নিয়ে টিম ডিরেক্টরের কণ্ঠেও ঝরল সেই কষ্ট-হতাশা ও ক্ষোভ, ‘বিশ্বকাপের পর একটা পোস্টমর্টেম হওয়া উচিত, কেন আমরা ব্যর্থ হলাম সেটা নিয়ে। আমাদের নিয়ে এত আশা ছিল, আমরা সেমিফাইনাল খেলব, সেখানে বাংলাদেশ দল বলতে গেলে ইংল্যান্ডের আগে, ৯-১০ অবস্থা করছে। ইংল্যান্ড এক ম্যাচ কম খেলেছে, তারা জিতলে হয়তো আমরাই ১০ নম্বরে নেমে যাব।’
২০০৭ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে হার দিয়ে গ্রুপ পর্ব থেকে ছিটকে পড়েছিল ভারত। সেই দলে ছিলেন শচীন টেন্ডুলকার-রাহুল দ্রাবিড়ের মতো তারকারা। সেই ব্যর্থতার দায় নিয়ে নতুনত্বের খোঁজে নেমে পড়ে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) কর্মকর্তারা। ফলটা তো চোখের সামনেই। ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন ভারত, ২০১১ বিশ্বকাপ গেছে তাদের ঘরে। বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ড থেকে শুরু করে ক্রিকেটের সর্বত্র পরিবর্তনের সময় এসেছে। তবে প্রশ্ন হলো, তরুণরা সেই দায়িত্ব নেওয়ার মতো সাহসিকতা দেখাচ্ছে কি?
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: খেলার মাঠ