মাসুম আওয়াল
থাকো কোথায়? বন্ধু তুমি বাকরখানি চেনো?
দেখতে দারুণ কুড়মুড়ে বিস্কুটের মতো যেনো।
বিস্কুটও নয় তাহলে কী মুচমুচে এক রুটি,
সেই রুটিরই গল্প হবে কাজ থেকে নাও ছুটি।
গল্প শুনে হাসবে তুমি আসবে চোখে পানি,
চলো জানি কোথায় থেকে এলো বাকরখানি।
রাজধানীতে পুরান ঢাকায় বাকরখানি মেলে,
খাবে নাকি বন্ধু তুমি ঢাকা শহর এলে!
চায়ের সাথে খেলেই জানার ইচ্ছে হবে জানি-
কেমন করে তৈরি হলো মজার বাকরখানি!
জানো সেসব শুনে আসে গভীর ঘণ শ্বাস,
শোনো শোনো বলি বাকরখানির ইতিহাস।
কুটুম এলে নাস্তাতে দেয় ঢাকার মানুষেরা,
পুরান ঢাকার আপ্যায়নে এই খাবারই সেরা।
চলছে তখন মুঘল আমল অনেক বছর আগে,
রাজ রাজাদের গল্প ভীষণ শুনতে ভালো লাগে?
সেই সময়ই বাকরখানির জন্ম হলো ঢাকায়,
মজা করে খেতো ছেলে বুড়ো মামা কাকায়।
মুঘল আমল শেষে যখন ইংরেজ আমল এলো,
ইংরেজেরাও মজা করে বাকরখানি খেলো।
দিন ফুরালো ইংরেজেরও। হলো পাকিস্তান,
বাকরখানি জয় করে নেয় সব মানুষের প্রাণ।
মুক্তিযুদ্ধ হলো ন’মাস স্বাধীন হলো দেশ,
বাঙালিদের কাছে আজও বাকরখানি বেশ।
তুর্কিস্তানের অধিবাসী আগা বাকের এসে,
থাকতে শুরু করেছিলো সোনার বঙ্গদেশে।
ভীষণ প্রিয় ছিলো বাকের মুর্শিদকুলী খাঁ’র,
সেনাবাহিনীতে দারুণ চাকুরি হয় তার।
আরামবাগের খনি বেগম কাড়ে আগার মন,
খনির নাচে মুগ্ধ আগার মনটা উচাটন।
নিজের চেয়েও খনিকে সে ভীষণ ভালোবাসে,
সময় পেলেই খনির কাছে ছুটে ছুটে আসে।
মন্দ কপাল হলে কতো ঘটনা যে রটে
এর মাঝে এক খল নায়কের আবির্ভাবও ঘটে,
উজির আলা জাহান্দ খাঁ’র কুপুত্র জয়নুল,
ছিঁড়ে নিতে চাইলো আগার মিষ্টি প্রেমের ফুল।
জয়নুল খাঁয়ের নজর পড়ে খনির রূপে গুণে,
চমকে যাবে তার পরে কী হলো সেসব শুনে।
আরামবাগে খনি বেগম থাকে একা ঘরে,
সুযোগ বুঝে জয়নুল তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
খবর পেয়ে ঘোড়ায় চড়ে ছুটে আসে বাকের
যুদ্ধ শুরু আওয়াজ ওঠে ঢোলক এবং ঢাকের।
যুদ্ধে হেরে জয়নুল খাঁ-ও পালিয়ে যায় শেষে,
খনি বেগম জীবন বাঁচায় আগার বুকে এসে।
বাকের-খনির ভালোসায় কাটছিলো দিন ভালো,
এর মাঝে এই শহরে এক গুঞ্জনও ছড়ালো।
খুন হয়েছে জয়নুল খাঁ আর বাকের খুনি নাকি,
এসব শুনে চুপ থাকে আর মুর্শিদকুলী খাঁ কী!
বিচার হলো বাকেরের ঠাঁই হলো বাঘের খাঁচায়
কে যে তাকে রক্ষা করে কে যে এসে বাঁচায়!
কিন্ত প্রেমের শক্তি অনেক বাঁচলো আগা বাকের,
আগার হাতেই গেলো যে প্রাণ শেষে হিংস্র বাঘের।
বাঘের সঙ্গে জিতে আগার মন খুশিতে মাতে,
খনি বেগম বন্দি তখন জয়নুল খাঁর হাতে।
বাকেরগঞ্জের চন্দ্রদ্বীপে কাঁদছে আটক খনি,
আগা গেলেই বাঁচবে যে তার দুই নয়নের মনি।
আগার সাথে সেনাপতি কালা গাজী আছে,
আগা বাকের যায় ছুটে তার ভালোবাসার কাছে।
জয়নুলের এই কাণ্ডে রাগেন জয়নুল খাঁয়ের পিতা,
ছেলের অপকর্মে জীবন হয়েছে তার তিতা।
শাস্তি দিতে নিজ ছেলেকে চন্দ্রদ্বীপে আসেন,
এমন হতচ্ছাড়াকে কোন বাবা ভালোবাসেন!
ছেলের উপর আঘাত হানে বাবার তরবারি,
মৃতপ্রায় ওই জয়নুল তবু মানতে নারাজ হারই।
এ অবস্থায় তরবারি বসায় খনির বুকে,
আগা-খনির এই জীবনে হয় না থাকা সুখে।
খনিকে তার বুকে নিয়ে কাঁদতে থাকেন আগা,
হায় রে জীবন ভালোবাসা, কত্ত ভালো লাগা।
আগার কোলেই খনি বেগম চির বিদায় নিলো,
বাকি জীবন আগা বাকের চন্দ্রদ্বীপেই ছিলো।
যোদ্ধা বাকের চন্দ্রদ্বীপের জমিদারি পান,
খনির স্মৃতি বুকে ধরে সেথায় থেকে যান।
সতেরশ সাতানব্বই ইংরেজেরা আসে,
বাকের-খনির প্রেমকাহিনী তারাও ভালোবাসে।
তারই নামে বাকেরগঞ্জ জেলা পেলো নাম,
বাকর-খানির ইতিহাসে গল্পটা পেলাম।
মুর্শিদকুলীর অনুরোধে বাকের করেন বিয়ে,
সে সংসারে সাদেক-মির্জা দুই ছেলেকে নিয়ে-
ভালোই ছিলো বাকের, খনি থাকতো মনের কোণে,
বাকের-খনির প্রেমকাহিনী আজও লোকে শোনে।
প্রিয় রুটির নাম রেখেছেন নিজেই ‘বাকর-খনি’
রুটি থেকেই যায় শোনা সেই প্রেম কাহিনীর ধ্বনি।
‘বাকর-খনি’ই পাল্টে এখন প্রিয় ‘বাকরখানি’
পুরান ঢাকার এই খাবারের কথা সবাই জানি।
‘গাওজোবান’ ও ‘গোলা’ বাকরখানি দু’প্রকার,
দেখতে একটা লম্বাটে অন্যটা গোলাকার।
মজার খাবার বাকরখানি কেমন করে বানায়
চলো বন্ধু এবার সেটা ছড়ায় ছড়ায় জানাই।
ময়দা, তেল ও ডালডা দিয়ে তৈরি হতো এটা,
কোরমা, কোফতা, কাবাব দিয়ে খাওয়া হতো সেটা।
দুগ্ধ, তেককা, মিষ্টি দিয়েও খেতো অনেক জন,
বাকরখানি যে খেয়েছে মজেছে তার মন।
বাকরখানি আজও দারুণ দুধ ও চায়ের সাথে,
ভীষণ প্রিয় সকালে ও বিকেলে নাস্তাতে।
বাকরখানি বানানো নয় কঠিন কর্ম কোনো,
ছন্দে ছন্দে বলি বন্ধু রেসিপিটা শোনো।
এক কাপ ময়দা, ডালডা কাপের চার ভাগের এক ভাগ,
তেল এক টেবিল চামচ লাগবে, করো না কেউ রাগ।
এক চা চামচ লবণ, পানি অল্প পরিমাণে,
প্রথম উপকরণ এসব সব লোকে কী জানে!
গলিয়ে নেওয়া ডালডা, ময়দা, তেল ও লবণ মেখে,
খাস্তা করে নিতে হবে হিসেব মনে রেখে।
খাস্তা করা ময়দাতে দাও পানি বাটি ভরে,
ঘণ্টা দুয়েক রাখতে হবে ময়দা ময়ান করে।
দ্বিতীয় ধাপ শুরু করো এক কাপই তেল নিও,
ডালডা কাপের চার ভাগের এক ভাগ তা রেখে দিও।
ডালডা গরম করে গলাও, ঠান্ডা করে নাও,
ডালডা ও তেল মিশিয়ে বিট করে রেখে দাও।
তৃতীয় ধাপ শুরু এখন করবে তুমি কী যে,
বাকরখানি তৈরি করা ভীষণ সহজ নিজে।
এক কাপ ময়দা সঙ্গে কর্নফ্লাওয়ার আধা কাপে,
এক কাপের এক চতুর্থ ভাগ তেল নিও এ ধাপে।
ময়দা, কর্নফ্লাওয়ার ও তেল মেখে রেখে দাও,
কাজ করে যাও হাতে পাবে তুমি যেটা চাও।
প্রথম ধাপের তৈরি খামির দিয়ে বানাও রুটি,
পাতলা হতে হবে সেটা করবে না কেউ ত্রুটি।
সেই দ্বিতীয় ধাপের ডালডা-তেলের মিশ্রণ নাও
চার দিকে এক ইঞ্চি বাদে রুটির উপর দাও।
তৃতীয় ধাপ মেশালে তেল, ময়দা কর্নফ্লাওয়ার,
পাতলা রুটির তেল-ডালডাতে ছেটাও সেটা এবার।
রুটি এবার দু’ভাঁজ করো নিয়মটা ঝকঝকে,
তেল ও ডালডার প্রলেপ দিয়ে ময়দা ছেটাও ওকে।
এভাবে ভাঁজ করো আবার আগের মতো করে,
ভাঁজ করা এই খামির ঢেকে রাখো ঘণ্টা ধরে।
ঢেকে রাখা খামির থেকে বানাও ছোটো লেচি,
লেচিই হবে বাকরখানি, ভাবছো শিখে গেছি।
লেচি বেলে ছুরি দিয়ে আঁচড় কাটো তিনটি,
তন্দুরিতে সেঁকে নিলে কাটবে ভালো দিনটি।
তন্দুরি না থাকলে সেঁকো থাকলে ওভেন কারো,
ঠিক এভাবে বাকরখানি বানিয়ে নিতে পারো।
খাবে নাকি বাকরখানি মনটা খুলে বলো,
এক বিকেলে সময় করে পুরান ঢাকা চলো।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ