বিদায় খালিদ: হয়নি যাবারও বেলা

রোজ অ্যাডেনিয়াম

নিজের গাওয়া গানের সঙ্গে অনেকটায় মিলে যায় কণ্ঠশিল্পী খালিদের জীবন। মাত্র ৫৬ বছর বয়সে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি। তার অকাল প্রয়াণের সংবাদ শুনেই মনে পড়ে যায় সেই গান ‘হয়নি যাবার বেলা, শুরুতেই সব কিছু, শেষ করে কেন চলে গেছ, আমারও ছিল কিছু বলার, শুনতে না চেয়ে শুধু, নিজেকে নিয়েই তুমি আছো।’ ২০২৪ সালের মার্চ মাসে ভক্ত শ্রোতাদের হিমালয় সমান দুঃখ দিয়ে পরপারে চলে গেলেন খালিদ। অনেকদিন ধরেই গান থেকে দূরে ছিলেন খালিদ। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে একেবারেই গান থেকে যেন দূরে সরে গিয়েছিলেন। বেছে নিয়েছিলেন প্রবাস জীবন। মনের ভেতরে জমেছিল অনেক অভিমান। তার জীবনের গল্পটা অন্যরকম।

গোপালগঞ্জে জন্ম

১৯৬৫ সালের ১ আগস্ট গোপালগঞ্জে জন্ম নেন খালিদ। তার শৈশব কৈশোর কাটে সেখানেই। ছোটবেলা থেকেই গান ভালোবাসতেন। ছাত্র অবস্থা থেকেই গান করতেন। তার গানের সঙ্গে তবলা বাজাতেন গোপালগঞ্জের চন্দ্রিমা শিল্পীগোষ্ঠীর বর্তমান সভাপতি শেখ ফরিদ আহমেদ। ছেলেবেলার স্মৃতিচারণ করে বন্ধু খালিদকে নিয়ে তিনি বলেন, ‘ও খুব মিশুক আনন্দপ্রিয় লোক ছিল। যেকোনো লোকের সঙ্গে সহজে মিশে যেত। শহরের পোস্ট অফিস মোড়ে অগ্নিবীণা শিল্পগোষ্ঠী নামে একটা সংগঠন ছিল, খালিদ ছিল সেখানের শিশুশিল্পী। ছোটবেলা থেকে খালিদের সংগীতের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ছিল। একসময় সে নামকরা শিল্পী হয়ে ওঠে।’ খালিদ ছিলেন তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে সবার ছোট। তার পুরো নাম খালিদ সাইফুল্লাহ। তিনি ১৯৭৯ সালে গোপালগঞ্জ এস এম মডেল সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজ থেকে ১৯৮১ সালে এইচএসসি পাস করেন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শেষ করেন।

গান যাত্রা

খালিদ ১৯৮১ সাল থেকে গানের জগতে যাত্রা করেন। ১৯৮৩ সালে ‘চাইম’ ব্যান্ডে যোগ দেন। একের পর এক হিট গান উপহার দিয়ে অল্প সময়েই খ্যাতি পান খালিদ, তার গান এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। আশির দশকে মানুষ তাকে চিনতো ‘চাইম’ ব্যান্ডের খালিদ নামেই। পরে শিল্পী হিসেবে এককভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি।

চাইমের খালিদ

তরুণ মুন্সীর লেখা জুয়েল বাবুর সুরে ‘সরলতার প্রতিমা’ গানের দর্শকনন্দিত গায়ক খালিদ। যিনি নিজের মতো করে বাঁচতেন, গান গাইতেন। তার প্রথম পরিচয় ‘চাইম’ ব্যান্ডের কণ্ঠশিল্পী। আশির দশকে চাইম ব্যান্ডে গান করে শ্রোতাপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। পরে তার কণ্ঠে আরও অনেক মনমাতানো গান শুনেছেন শ্রোতারা। ‘সরলতার প্রতিমা’, ‘যতটা মেঘ হলে বৃষ্টি নামে’, ‘কোনো কারণেই ফেরানো গেল না তাকে’, ‘হয়নি যাবারও বেলা’, ‘যদি হিমালয় হয়ে দুঃখ আসে’, ‘তুমি নেই তাই’ এরকম অনেক জনপ্রিয় গানের শিল্পী খালিদ।

যতো গান

খালিদের জীবনের প্রথম অ্যালবাম ছিল চাইম ব্যান্ডের অ্যালবাম। নাম ছিল ‘চাইম’। অ্যালবামে বেকারত্ব, নাতি খাতি বেলা গেল, তুমি জানো নারে প্রিয়, কীর্তনখোলা নদীতে আমার, এক ঘরেতে বসত কইরা, ওই চোখ, প্রেম, সাতখানি মন বেজেছি আমরা এবং আমার জন্য রেখো গানসহ আরও দুটি ইংরেজি গান ছিল। ‘নাতি খাতি বেলা গেল’ গানটি আশির দশকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। খালিদ উঠে আসেন তরুণদের প্রিয় শিল্পীর তালিকায়। চাইম ব্যান্ডের গানের পাশাপাশি খালিদের একক অনেক গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। যার গান একসময় পাড়া-মহল্লার বিভিন্ন শ্রোতাদের মুখে মুখে থাকত, বাজত বিভিন্ন বিপণি বিতানসহ দোকানে দোকানে। সে গানগুলোর বেশিরভাগ লিখেছেন, সুর করেছেন প্রিন্স মাহমুদ। এই জুটির সৃষ্ট অনবদ্য গানগুলো শ্রোতাদের মোহিত করে রাখত। সেই সময় প্রচুর মিশ্র অ্যালবামে গেয়েছেন। সেইসব মিশ্র অ্যালবামে খালিদের কণ্ঠে ‘তুমি আকাশের বুকে সরলতার প্রতিমা’, ‘যতটা মেঘ হলে বৃষ্টি নামে’, ‘কোনো কারণেই ফেরানো গেল না তাকে’, ‘হয়নি যাবার বেলা’, ‘যদি হিমালয় হয়ে দুঃখ আসে’, ‘তুমি নেই তাই’ ও ‘আকাশনীলা’ গানগুলো এখনো জীবন্ত।

প্রবাসে 

অনেকদিন ধরেই গান থেকে দূরে খালিদ। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে একেবারেই গান থেকে যেন দূরে সরে যান। বেছে নেন প্রবাস জীবন। আমেরিকার নাগরিকত্ব নিয়ে নিউ ইয়র্কে বসবাস করতেন। তার এক ছেলে সেখানে পড়াশুনা করেন। মাঝে মাঝে দেশে আসলেও একাই থাকতেন খালিদ। নিজের গণ্ডির বাইরে খুব একটা বের হতেন না। কিছুদিন থাকতেন ফের চলে যেতেন বিদেশ। কয়েক মাস আগে স্ত্রীসহ দেশে আসেন তিনি। আর ফেরা হলো না তার। চলে গেলেন আপন দেশে।

হৃদরোগ কেড়ে নিলো প্রাণ

ঢাকার গ্রিনরোডের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ১৮ মার্চ রাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন খালিদ। বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। জানা গিয়েছে, কয়েক বছর ধরেই হৃদরোগে ভুগছিলেন খালিদ; একাধিকবার হৃদরোগের চিকিৎসা করিয়েছিলেন। তার হৃদযন্ত্রে একটি স্টেন্ট বসানো ছিল।

শেষ জীবনের আফসোস

গান নিয়ে নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন খালিদ। একক গানের পাশাপাশি চাইম ব্যান্ড পুনর্গঠনও করতে চেয়েছিলেন। মাস ছয়েক ধরে সেই চেষ্টাও করছিলেন। খালিদের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা যায়, বিষয়টি তার জন্য সহজ হচ্ছিল না। নতুন গান তৈরির প্রস্তুতি নিয়ে দুঃখ করে তার এক ঘনিষ্ঠকে বলেছিলেন, ‘চাইমের অ্যালবাম তখন হিট। আমার পেছনে গানের জন্য লাইন দিতেন অনেকেই। আমি বিশ্ববিদ্যালয় হলে থাকতাম। মানুষ এসে ভরদুপুরে অনুরোধ করে ঘুম ভাঙিয়ে গান করতে নিয়ে যেতেন আমাকে। আর এখন আমার নতুন গান করার কোনো ডাক আসে না। নিজের পকেটের টাকা খরচ করে এখন গান তৈরি করতে হচ্ছে!’

জানা যায়, এরই মধ্যে খালিদ নিজ খরচেই ‘ব্ল্যাকহোল’ ও ‘আমার চোখে তো অনন্ত মেঘ’ নামের দুটি গান করেছেন। কণ্ঠ দেওয়ার পাশাপাশি গান দুটির লেখা ও সুর খালিদের। মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে গান দুটির মিক্স মাস্টারিং করেছেন তিনি। এরপর গান দুটির মিউজিক ভিডিও করে কীভাবে মুক্তি দেওয়া যায়, তা নিয়ে পরিকল্পনা করছিলেন। মুক্তির জন্য দু’একটি অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথাবার্তাও চলছিল। চাইম ব্যান্ড নতুন করে গঠন, স্টেজ শো শুরু করা, নতুন একক গান করার এসব কাজ দেখাশোনা করার জন্য প্রায় তিন মাস ধরে খালিদের ব্যবস্থাপকের কাজ করছিলেন সংগীতশিল্পী রোম্মান আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘গান নিয়ে খালিদ ভাই ইদানীং দুঃখ করতেন। এ সময় এসে নতুন গান করতে কোনো অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ডাকেনি তাকে। নব্বই, আশির দশকে তাকে নিয়ে অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের আগ্রহের কথা এ সময়ের সঙ্গে তুলনা করে খুব আফসোস করতেন তিনি।’

নতুন শিল্পীদের মূল্যায়ন

নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের নিয়েও বেশ ভাবতেন খালিদ। ভাবতেন মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে। এক সাক্ষাৎকারে খালিদ বলেছিলেন, ‘এখন যারা গান করছে তাদের মধ্যে প্রতিভা আছে। আমার মনে হয় দেশে যারা প্রতিষ্ঠিত শিল্পী এবং গীতিকার রয়েছেন তারা নতুনদের সুযোগ করে দিলে নতুনরা অনেক দূর যেতে পারবে। আর নতুনদের উচিত সাধনা করে গান করা। এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখছি মিউজিক ভিডিও করে অনেকেই শিল্পী হয়ে যাচ্ছে। আগে গান শুধু শোনার ব্যাপার ছিল। এখন মানুষ দেখতেও চান যে আসলে কোন শিল্পী কেমন পারফর্ম করছেন। সেক্ষেত্রে মনে হয় মিউজিক ভিডিও কোনো গানকে বাণিজ্যিকভাবে পুরোপুরি সফল করায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে এটাও ঠিক, যদি গান শুনতেই ভালো না লাগে, মানুষ একবারের বেশি সেটি দেখবে না। সবার কথা চিন্তা করে অডিও গানকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। ভিডিও নির্মাণ করা এক ধরনের মেধা আর গান গাওয়া আরেক ধরনের মেধা। তাই আমার কাছে মনে হয় বিষয় দুইটি সমান গুরুত্ব দিয়ে যদি একসঙ্গে করা হয় তবে ভালো ফিডব্যাক পাওয়া যাবে।’

শেষ কথা

আজীবন গানের সঙ্গেই থাকতে চেয়েছিলেন খালিদ। নিজের লক্ষ্য ঠিক রেখেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রবাস জীবন থেকে দেশে ফিরে এসে মন দিয়েছিলেন গানে। নতুন নতুন গান তৈরি করছিলেন। কিন্তু এসব অপ্রকাশিত রেখেই চলে গেলেন তিনি। গানগুলোও হয় তো কোনো না কোনো সময় প্রকাশ হবে। শুনবে সবাই। কিন্তু তারপর! আর নতুন কোনো গান নিয়ে হাজির হবেন না খালিদ। অনেক কনসার্ট হবে। কিন্তু আর কোনো কনসার্টে খালিদেও সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে গাওয়া হবে না – কোনো কারণে, কোনো কারণে ফেরানো গেলো না তাকে, ফেরালো গেলো না কিছুতেই। কিংবা হয়নি যাবারও বেলা, শুরুতেই সবকিছু শেষ করে চলে গেছো। খালিদ সাইফুল্লাহ ঘুমিয়ে আছেন গোপালগঞ্জের গেটপাড়া পৌর কবরস্থানে বাবা-মায়ের পাশে। ওপারে ভালো থাকুক সবার প্রিয় শিল্পী।

এই লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন:দিবস

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

seventeen − 14 =