বিদায় ব্যান্ড সুপারস্টার শাফিন আহমেদ

রোজ অ্যাডেনিয়াম

আরও একটা তারা ঝরে পড়লো সংগীত ভুবনের আকাশ থেকে। সুরের মাধুরী দিয়ে মানুষের মন জয় করে নিয়েছিলেন তিনি। যার গান ছাড়া কোনো জন্মদিনের অনুষ্ঠান পরিপূর্ণতা পায় না। কোথাও কোনো জন্মদিনের অনুষ্ঠান হলেই বেজে ওঠে শাফিন আহমেদের কণ্ঠে ‘আজকের আকাশে অনেক তারা, দিন ছিল সূর্যে ভরা, আজকের জোছনাটা আরও সুন্দর, সন্ধ্যাটা আগুন লাগা, আজকের পৃথিবী তোমার জন্য, ভরে থাকা ভালো লাগা, মুখরিত হবে দিন গানে-গানে আগামীর সম্ভাবনায়, তুমি এই দিনে পৃথিবীতে এসেছো শুভেচ্ছা তোমায়, তাই অনাগত ক্ষণ হোক আরও সুন্দর উচ্ছল দিন কামনায়, আজ জন্মদিন তোমার।’ শাফিন আহমেদের গাওয়া তুমুল জনপ্রিয়  ‘চাঁদ তারা সূর্য’, ‘জ্বালা জ্বালা অন্তরে’, ‘ফিরিয়ে দাও হারানো প্রেম’, ‘ফিরে এলে না’, ‘হ্যালো ঢাকা’, ‘জাতীয় সংগীতের দ্বিতীয় লাইন’ গানগুলো টিকে থাকবে বহুকাল। শুধু সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন  ব্যান্ড গানের এই সুপারস্টার। রঙবেরঙের পক্ষ থেকে তার জন্য শোক ও শ্রদ্ধা।

খ্যাতিমান বাবা-মা’র খ্যাতিমান ছেলে

শাফিন আহমেদের জন্ম ১৯৬১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রথিতযশা সংগীতশিল্পী, প্রসিদ্ধ সুরকার ও সংগীত পরিচালক কমল দাশগুপ্ত শাফিন আহমেদের বাবা। আর তার শাফিন আহমেদের মা হলেন সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত নজরুল সংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগম। এই দুই খ্যাতিমান শিল্পীর ঘরেই জন্মেছিলেন আমাদের প্রিয় গায়ক। কমল দাশগুপ্ত না ফেরার দেশে চলে গেছেন ২০ জুলাই, ১৯৭৪ সাল। ফিরোজা বেগম কিডনি জটিলতায় ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে মারা যান। বাবার বিদায়ের মাসেই বিদায় নিলেন বাংলাদেশের খ্যাতিমান শিল্পী শাফিন আহমেদ।

ছেলেবেলা

পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে ছোটবেলা থেকেই গানের আবহে বেড়ে উঠেছেন এই সংগীত তারকা। বাবার কাছে উচ্চাঙ্গসংগীত আর মায়ের কাছে শিখেছেন নজরুলসংগীত। বড় ভাই হামিন আহমেদসহ ইংল্যান্ডে পড়তে গিয়ে পশ্চিমা সংগীতের সঙ্গে সখ্য হয় শাফিনের। শুরু হয় তার ব্যান্ড সংগীতের যাত্রা।

সংগীতজীবন

আশি আর নব্বইয়ের দশকে কিশোর-তরুণ শ্রোতাদের কাছে ভালোবাসা আর বিরহের গান মানেই ছিল মাইলসের গান। আর মাইলস মানেই শাফিন আহমেদ। ১৯৭৯ সালে মাইলস ব্যান্ডে যোগ দেওয়ার পর প্রথম কয়েক বছর তারা বিভিন্ন পাঁচ তারকা হোটেলে ইংরেজি গান গাইতেন। পরে মাইলসের বাংলা গানের প্রথম অ্যালবাম ‘প্রতিশ্রুতি’ বের হয় ১৯৯১ সালে। অবশ্য তার আগে প্রকাশিত হয় দুটি ইংরেজি গানের অ্যালবাম ‘মাইলস’ ও ‘আ স্টেপ ফারদার’। ‘প্রতিশ্রুতি’ অ্যালবামের জনপ্রিয়তার পর বিটিভিতে বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠানে দেখা যেতে থাকে মাইলসকে। ধীরে ধীরে মাইলস দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যান্ড দলে পরিণত হয়।  দেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড মাইলসের দীর্ঘ সময়ের ভোকাল, সুরকার ও গীতিকার ছিলেন শাফিন আহমেদ।

মাইলস এর বাইরে

২০১০ সালের শুরুর দিকে একবার ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে ব্যান্ড থেকে সরে দাঁড়ান শাফিন এবং রিদম অব লাইফ নামে নতুন একটি ব্যান্ডদল প্রতিষ্ঠা করেন। এই দলে তার সাথে যোগ দেন ওয়াসিউন (গিটার), শাহিন (গিটার), সুমন (কি-বোর্ড), উজ্জ্বল (পার্কিশন), শামস (বেজ গিটার) এবং রুমি (ড্রামস)। যদিও কয়েক মাস পর আবারও মাইলস ব্যান্ডে ফেরেন। এরপর ২০১৭ সালে অক্টোবরেও তিনি আবার মাইলস ছেড়ে দেন। এর কয়েক মাস পর দ্বন্দ্ব ভুলে আবারও ব্যান্ডে ফিরেছিলেন। ২০২১ সালের নভেম্বরে সবশেষ তথা তৃতীয়বার মাইলস ছাড়েন। শাফিন তার ক্যারিয়ারের শেষের দিকে মাইলস থেকে বেরিয়ে এসে ‘ভয়েস অব মাইলস’ নামে ব্যান্ড গঠন করে কনসার্ট করে আসছিলেন।

রাজনীতি

সক্রিয়ভাবে রাজনীতিও করতেন শাফিন আহমেদ। ২০১৭ সালে ববি হাজ্জাজের নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) এর সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরামের সদস্য হিসেবে মনোনীত হোন। ২০১৯ সালে জাতীয় পার্টি থেকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) উপনির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী হওয়ার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু ঋণখেলাপির অভিযোগে নির্বাচন কমিশন তার মনোনয়নপত্র বাতিল করে। ২০২১ সালে তিনি জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান।

যুক্তরাষ্ট্রে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ

গত ২০ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়াতে কনসার্টে অংশ নিতে গিয়েছিলেন শাফিন আহমেদ। আর প্রাণ গিয়ে দেশে ফেরা হলো না তার। যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে মাইলস ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য শাফিন আহমেদের বড় ভাই মানাম আহমেদ বলেন, শাফিন আহমেদের বড় ধরনের হার্ট অ্যাটাক হয়। সেইসাথে তিনি কিডনি জটিলতায়ও ভুগছিলেন। এর আগেও দুটো হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। তার পেসমেকার বসানো ছিল। এবারে তৃতীয় অ্যাটাকটি হলে যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালে তার হৃদপিণ্ডে স্টেন্ট বসানো হয়। সাথে তার কিডনি জটিলতা থাকায় ডায়ালাইসিসও চলছিল। তবে অক্সিজেন স্যাচুরেশনও কমে আসতে থাকায় তার শরীরের প্রত্যঙ্গগুলো একে একে অকার্যকর হতে শুরু করে। এভাবে পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকলে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। পরে কোনো উন্নতি না হওয়ায় ২৪ জুলাই সকাল সাড়ে ছয়টার পর তার লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়।  ২০২৪ সালের ২৫ জুলাই বাংলাদেশ সময় সকাল ৬টা ৫০ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার সেন্তরা হাসপাতালে শাফিন আহমেদ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর।

বাবার কবরে চিরনিদ্রায়

বাবা কমল দাশগুপ্তর কবরে চিরশায়িত হলেন ব্যন্ড তারকা শাফিন আহমেদ। ৩০ জুলাই বিকেল সাড়ে ৪টায় বনানী কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। এসময় পাশে ছিলেন ভাই তাহসিন আহমেদ ও হামিন আহমেদসহ স্বজন এবং মাইলস সদস্যরা। শাফিন আহমেদের কবরের পাশেই মা কিংবদন্তি নজরুল সংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগম ঘুমিয়ে আছেন। বাবা মায়ের কোলেই যেন ফিরে গেলেন গায়ক শাফিন আহমেদ। ৩০ জুলাই জোহরের নামাজের সময় নেওয়া হয় গুলশান আজাদ মসজিদে। এখানে জানাজা ও সর্বস্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে শাফিন আহমেদের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বনানী কবরস্থানে। জোহরের নামাজের পর গুলশানের আজাদ মসজিতে শাফিনের দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় গীতিকার, সুরকার প্রিন্স মাহমদু, সংগীতশিল্পী পার্থ বড়ুয়া, আঁখি আলমগীর, পলাশ, গীতিকার কবির বকুলসহ সংগীতাঙ্গনের অনেকে উপস্থিত ছিলেন। শাফিন আহমেদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় কুলখানি হয় ২ আগস্ট জুমার নামাজের পর বনানী কবরস্থানের পাশে গুলশান কমিউনিটি মসজিদে।

বাবাকে দাফনে গিয়ে হাসপাতালে ছেলে

জানাজার আগে ব্যান্ড তারকা শাফিন আহমেদের মরদেহের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ছেলে আজরাফ আহমেদ। চাচা হামিন আহমেদের পাশে দাঁড়িয়ে উপস্থিত সবার সামনে কথাও বলেছিলেন। কারও কোনো চাওয়া-পাওয়া থাকলে সেটা যেন তাকে বা তাদের পরিবারকে জানানো হয়। ছেলে হয়ে বাবার শেষযাত্রার সবকিছু সুন্দরভাবে সামলে নিচ্ছিলেন। কিন্তু বাবাকে কবরে সমাহিত করার সময়টা যেন আর সহ্য করতে পারেননি। জ্ঞান হারান। কবরস্থানে সবাই ঘাবড়ে যান। এরপর দ্রুত ঢাকার গুলশানের একটি হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে। বাবার হঠাৎ মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি আজরাফ। চিকিৎসা নিয়ে বর্তমানে সুস্থ ও স্বাভাবিক আছেন তিনি।

মৃত্যুতে শোক

শিল্পীর মৃত্যুতে শোকাহত সংগীতাঙ্গন। শোকবার্তা জানিয়েছেন বিভিন্ন স্তরের সাংস্কৃতিক কর্মী। রেনেসাঁ ব্যান্ডের শিল্পী, গীতিকার, সুরকার নকীব খান বলেন, ‘শাফিন আহমেদের মৃত্যু দেশের ব্যান্ড মিউজিক ও ব্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির জন্য এক বিরাট ক্ষতি।’ তিনি বলেন, ‘সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে এরকম একটা খবর পাব কখনো কল্পনাও করিনি। আমরা কখনো শুনিনি শাফিন অসুস্থ। আমাদের জন্য তার মৃত্যুর খবর মেনে নেওয়া কঠিন। কিছু বলার ভাষা নেই, ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। আমরা তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।’ প্রথম শোনায় খবরটি বিশ্বাস হয়নি ফিডব্যাক ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও সংগীত পরিচালক ফোয়াদ নাসের বাবুর। তিনি বলেন, ‘সকাল সকাল এমন একটা খবর পাব, যেটা খুবই মর্মাহত করেছে আমাদের। প্রথম শোনায় বিশ্বাস হয়নি, এখনো মনে হচ্ছে খবরটা হয়তো ভুল হতে পারে। শ্রোতাদের হৃদয় ছুঁয়েছিল তার গান। তার আকস্মিক মৃত্যুতে ভীষণ শোকাহত।’ শাফিন আহমেদের মৃত্যুর খবরে শোকাহত সোলসের পার্থ বড়ুয়া। বলেন, এই মুহূর্তে তার কিছু বলার ভাষা নেই। সংগীতশিল্পী ও সংগীত পরিচালক শওকত আলী ইমন বলেন, ‘শাফিন ভাই একজন মিউজিক লিজেন্ড ছিলেন। উনার যে ক্রিয়েশন, মাইলসের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। শেষের দিকে উনি মাইলস ছেড়ে দিয়েছেন। একজন ভক্ত হিসেবে আমি অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। উনি উনার সংগীত ক্যারিয়ারে মাত্র একটি গান করেছেন সিনেমায়। সেটা আমার করা। কবির বকুলের লেখায় গানটির শিরোনাম ছিল ‘পাগলের মতো ভালোবাসি তোমায়’। সিনেমাটির নাম ছিল ‘ওয়ার্নিং’। আমার সঙ্গে শাফিন ভাইয়ের অনেক ভালো সম্পর্ক ছিল। উনি সিনেমায় গান করতেন না, এ গানটি গেয়েই আমাকে বললেন, ‘ইমন তোর জন্য গাইলাম’। উনি চলে যাওয়াতে সংগীতের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল।

গীতিকার কবির বকুল বলেন, ‘শাফিনের জন্ম ভালোবাসা দিবসে। সব সময় আমাদের ভালোবাসা দিয়েই ভরিয়ে দিয়েছে। ওর সম্পর্কে বলে শেষ করা যাবে না। আমার লেখা একটি গান গেয়েছে সিনেমায়। এটিই তার জীবনে প্রথম ও শেষ গান ছিল সিনেমার জন্য। অনেক ভালো একজন মানুষ ছিল। সব সময় সবার খবরাখবর রাখত। এখন তো চলেই গেছে আমাদের ছেড়ে। শুধু এটাই বলব, যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক।’ সংগীতশিল্পী বাপ্পা মাজুমদার বলেন,  ‘বিশ্বাসই হচ্ছে না উনি আর নেই! কী বলব আর, বলার মতো কিছু নেই। উনি এতটা কাছের ছিলেন যে, এখনো উনার মৃত্যুর খবর আমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। মৃত্যুকে মেনে নিতেই হয়। তবু কিছু মৃত্যু আমাদের মেনে নিতে অনেক কষ্ট হয়। আমি এই মুহূর্তে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। আমি এখনো একটা ঘোরের মধ্যে আছি।’ সংগীতশিল্পী দিলশাদ নাহার কণা বলেন, ‘শাফিন ভাইয়ের সঙ্গে আমার অনেক ভালো সম্পর্ক ছিল। কিছুদিন আগেও আমি একটা গানের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম, সেখানে শাফিন ভাইয়ের ছেলেও আমার সঙ্গে ছিল। উনি বিদেশে একটি শো করতে গেছেন সেটা জানতাম। কিন্তু মৃত্যুর খবর শুনতে হবে সেটার জন্য একদম প্রস্তুত ছিলাম না। আমি খবরটি শুনে খুবই শকড। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। আল্লাহ উনাকে জান্নাতবাসী করুক।’

শেষ কথা

ওপারে ভালো থাকুক, সবার প্রিয় শাফিন আহমেদ। ভক্তদের মাঝে তিনি বেঁচে থাকবেন তার কাজের মাধ্যমে। মা-বাবার কাছে ভলো থাকুন প্রিয় শিল্পী।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে হবে ক্লিক করুন: স্মৃতিচারণ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

12 − seven =