বিশ্ববিদ্যালয় নারীদের জন্য অনিরাপদ?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

নিজেকে লড়াকু মানুষ হিসেবে বিশ্বাস করে আসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা তার জীবনকেই শেষ করেছেন নিজের হাতে। সহপাঠী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টরকে দায়ী করে ফেইসবুকে পোস্ট লিখে আত্মহত্যা করেছেন তিনি। তার আগে লিখে যান, এটা সুইসাইড না এটা মার্ডার। টেকনিক্যালি মার্ডার।

অবন্তিকার আত্মহত্যার বিষয়টি মর্মান্তিক। তবে এই ঘটনা আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাহীনতার দিকটিও প্রকটভাবে তুলে ধরেছে। নিপীড়িত এই নারী যে মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়েছিলেন, তার উৎস কোথায়? অবশ্যই এই বিশ্ববিদ্যালয়, এই প্রতিষ্ঠান; যার দায়িত্ব ছিল, এ ধরনের যন্ত্রণার মধ্যে তাকে নিক্ষেপ না করে তাকে পুনর্বাসিত করা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে।

স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নেওয়ার চার মাস আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে অবন্তিকা জানিয়েছিলেন ধর্ষণ মানসিকতার নিপীড়ক আম্মান তার সাথে কি ভয়ংকর আচরণই না করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টর বা সহকারী প্রক্টর হলেন এমন ব্যক্তি যার কাছে নির্যাতিতা ছাত্রীরা সর্বাগ্রে প্রতিকার আশা করেন এবং সেই প্রত্যাশা থেকেই অভিযোগ জানিয়েছিলেন তিনি। জগন্নাথের প্রক্টর অফিস কি করেছে? উত্তর সর্বজনবিদিত। বারংবার ডেকে নিয়ে যাওয়া, অশ্লীল কথা বলা, অভিযোগ তুলে নিতে চাপ দেওয়ার কাজ করেছে। জবাব দিতে-দিতে ক্লান্ত অবন্তিকা নতুন করে নিপীড়িত হয়েছেন।

সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে যা জানলাম তাতে বোঝা গেল তার আচরণ অবন্তিকার নিপীড়নের যন্ত্রণা, গ্লানি ও অবসাদকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। আত্মহত্যায় প্ররোচনাটি তাই কেবল নির্দিষ্টভাবে ধর্ষক বা নিপীড়কদের কাছ থেকেই এসেছিল এমন নয়। একজন শিক্ষক হয়েও দ্বীন ইসলাম এই আত্মবিনাশে প্ররোচনা দিয়েছেন।

নারী নির্যাতনের প্রতিকার অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি-তে। সবাই এটাই বলবে। কিন্তু উচ্চাশিক্ষা স্তরে ছাত্র আর শিক্ষক যদি যৌথভাবে নিপীড়ক হয়ে দাঁড়ায় তখন অনেক কিছু ভাবতে হয়। আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা আত্মহত্যা করেছেন এবং মৃতুর সময় একটি সুলিখিত সুইসাইড নোট রেখে গেছেন। রেখে গেছেন অসংখ্য প্রমাণ কি করে দিনের পর দিন তিনি তার সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকী কর্তৃক নিপীড়িত ও নিগৃহীত হয়েছেন। তাই শুধু শাস্তি বা আইনী প্রক্রিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়টিই কি করে এমন অনিরাপদ হয়ে উঠল সেটা ভাবতে হবে।

তার মায়ের কথা শুনে যে কেউ বুঝতে পারবে যে তার কন্যাকে আসলে হত্যা করা হয়েছে। মা’কে বলে গেছে অবন্তিকা যে প্রতিটি মুহূর্তে ক্যাম্পাসে একা পেলে বা সবার সামনে কি ভয়ংকরভাবে অপমান করত সহপাঠী আম্মান। সেই অপমান জমতে জমতে এক পর্যায়ে এতো ভারী হয়ে যায় যে, অবন্তিকা নিজেকে সরিয়ে ফেলে এই পৃথিবী থেকে। এক বছর আগে স্বামী আর এখন কন্যাকে হারিয়ে দিশেহারা অবন্তিকার মা।

যেটা বলছিলাম যে, অবন্তিকা এই আত্মহননের আগে গত বছরের ১৪ নভেম্বর তৎকালীন প্রক্টরের কাছে সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে উত্যক্ত করা ও হয়রানির অভিযোগ জানিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে আম্মানের হয়রানি, হুমকির শিকার হচ্ছেন ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন জানিয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে আবেদন করেছিলেন। আবেদনপত্রে অবন্তিকা অভিযোগ করেন, প্রথমবর্ষে পড়ার সময় অবন্তিকাকে প্রেমের প্রস্তাব দেন আম্মান। অবন্তিকা তাতে রাজি হননি। এরপর থেকেই আম্মান উত্যক্ত ও হয়রানি শুরু করেন। হুমকি দেন, তিনি এমন পরিস্থিতি তৈরি করবেন, যাতে অবন্তিকাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হবে। ২০২২ সাল থেকে আম্মানের নিপীড়নের মাত্রা আরও বেড়েছে বলে আবেদনপত্রে অভিযোগ করেন অবন্তিকা। রাস্তায় চলাফেরার সময়, বিভাগের করিডরে একা থাকলে আম্মান অবন্তিকাকে ছাদে বা ফাঁকা ক্লাসরুমে নিয়ে যেতে চাইতেন। মেসেঞ্জারে তথ্য ছড়িয়ে অবন্তিকাকে অপদস্থ করার হুমকিও দিতেন।

আম্মানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিস। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাইরুজ সাদাফই একমাত্র নন, আরও শিক্ষার্থী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। তার আত্মহত্যার পর আরেক শিক্ষার্থী বেসরকারি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের ছাত্রী ফারজানা মীম অত্যন্ত ভয়ার্ত কণ্ঠে তার দুরবস্থার কথা বলছেন। এই ছাত্রী বলছেন, তার বিভাগের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ আনার পর বিভাগের চেয়ারম্যান ও অন্যান্য শিক্ষক মিলে তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে ফেইল করিয়েছেন। এমনকি শূন্য নম্বর দিয়েছেন একজন। এই ছাত্রী বলছেন, কখন কি হয় এই আতংকে তিনি ঘর থেকে বের হন না। মেয়েটি বলছিলেন, অবন্তিকার মতো সাহসী হলে তিনিও আত্মহত্যা করতেন।

কি ভয়ংকর পরিস্থিতি একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে! শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েদের নিগ্রহ এবং নিগ্রহকারী হিসেবে শিক্ষকদের নাম উঠে আসা গভীর উদ্বেগের। এই ছাত্রীর অভিযোগ কতটা সত্যি তা তদন্তে প্রমাণিত হোক, কিন্তু অভিযোগ গুরুতর। তবে এ কথা সত্যি যে, কিছু নীতিবর্জিত শিক্ষক তথাকথিত স্বায়ত্বশাসনের সুযোগ নিয়ে শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষককূলকে কালিমালিপ্ত করছেন।

অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রেও অভিযোগের কমতি নেই। কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীকে যৌন হয়রানির প্রতিবাদে দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। একই অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রক্টরকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ অভিযোগই নিষ্পত্তি করে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

২০০৯ সালে উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় গঠিত যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল বেশির ভাগ সময়ে সঠিকভাবে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয় না। আবার প্রতিবেদন দিলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট বা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ফোরামগুলোতে উপাচার্যগণ তা উপস্থাপন করেন না। যৌন নিপীড়নের ঘটনাগুলোয় জড়িতরা বেশ ক্ষমতাধর হন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেও ছাত্রীরা বিচার পান না। উল্টো পদে পদে বাধা-বিঘ্ন, অসহযোগিতা করা হয়। যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেলও বারবার আপত্তিকর, অসৌজন্যমূলক ও অপ্রাসঙ্গিক কথা জিজ্ঞেস করে পুনরায় হয়রানি করে। সত্য প্রকাশ না করে নিপীড়ককে রক্ষা করে।

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ে ভাবতে হচ্ছে আমাদের। এগুলো কি এভাবেই চলবে? এমন করে এই প্রতিষ্ঠানগুলো নারীদের জন্য অনিরাপদ হয়ে থাকবে? আজ দেশে একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই, যেখানে ছাত্রীসহ নারীকর্মীরা সম্পূর্ণ সুরক্ষিত বোধ করেন। আসলে এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দায়বদ্ধতা, অভিযোগ নিরসন পদ্ধতি ও ক্ষমতাবিন্যাস নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে। নির্যাতনকারীরা ক্ষমতায় থেকে পড়িয়ে যাচ্ছেন, বা পড়ালেখা করে বেরিয়ে যাচ্ছেন এবং সন্দেহ, দোষ পড়ছে নিগৃহীতাদের উপর।

আগেই বলেছি উচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত যৌন হয়রানি প্রতিরোধে গঠিত সেলের কাছে অধিকাংশ ছাত্রী অভিযোগ জানাতে যাচ্ছেন না। মুখ বুজে অত্যাচার হজম করা বা নীরবে শিক্ষাঙ্গন ত্যাগের কারণ হিসেবে অসুরক্ষিত ক্যাম্পাস, নিগ্রহকারীর অমিত ক্ষমতার পাশাপাশি দায়ী পারিপার্শ্বিক চাপ ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েটিকেই দোষ দেওয়া হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পরিবার এই প্রবণতা সর্বত্র। এছাড়া শুরু হয় রাজনৈতিক ট্যাগ লাগানো এবং কুৎসিত ট্রোল। অবন্তিকার বেলায়ও সেই চেষ্টা আছে একটা পক্ষের।

অবন্তিকা মারা গেছেন। অনেক অভিমান আর অপমান নিয়ে তিনি আমাদেরকে দেখিয়েও গেছেন এই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কতটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর কতটা নিপীড়ক উৎপাদক। আরেকটি এখন মেয়েও কথা বলছেন। আম্মান অবন্তিকাকে নিপীড়ন ও ধর্ষণের হুমকি দিত সবার সামনে এবং আড়ালে। এই ছেলের কিছু হতো না, কারণ প্রক্টর তার পক্ষে আছেন। এরকম অসংখ্য অবন্তিকা আছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা প্রতিনিয়ত এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ালেখাই করে যাচ্ছেন।

মনের ক্ষত নিরাময়ের মতো কোনো করুণাধারা এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অবন্তিকার জন্য বর্ষণ করেনি। তার ক্ষত ছিল গভীর। সেই  ক্ষতস্থান থেকে নিয়ত রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, কিন্তু কেউ দেখেনি। অবন্তিকার আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে সমগ্র সমাজের সামনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অব্যবস্থাপনা উন্মোচিত হয়েছে। আগামীতে এমনটা যেন আর না ঘটে সেকথা ভাবুক সবাই। লাঞ্ছিতাকে পরিবারের সামাজিক মর্যাদাহানির ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখা শিক্ষকদের কাজ নয়।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন:  প্রচ্ছদ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

eleven − one =