সব শিশুই ধরীত্রির, কোনো শিশুই পথের নয়

প্রভাষ আমিন

ঢাকার ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি দাঁড়ালেই একটা দৃশ্য আমাকে ব্যথিত করে, শঙ্কিত করে। গাড়ি দাঁড়ালেই কিছু শিশু ছুটে আসে। কেউ গাড়ি পরিষ্কার করতে শুরু করে, কেউ ফুল বিক্রি করে, কেউ চকলেট বিক্রি করে, কেউবা নিছক হাত পাতে। সিগন্যালে দাড়িয়ে থাকা গাড়ির ফাঁক গলে দ্রুতগতিতে তারা বিচরণ করে। মাছ যেমন পানিতে, এই শিশুরা গাড়ির জঙ্গলে তেমনই সাবলীল। এই শিশুদের বয়স ৫ থেকে ১৫। পাশের সড়ক দ্বীপেই কারো কারো সংসার। সেখানে খেলা করে একদম কোলের শিশু। মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, খেলা করছে। সবাই খুব হাসিখুশী এবং চটপটে। তারা জেনে গেছে, এই পৃথিবীটা বড় অদ্ভুত, এখানে টিকে থাকতে হলে লড়াই করতে হবে। মন খারাপ করে কোণায় বসে থাকলে পেটে ভাত জুটবে না। গাড়িতে আমার স্ত্রী মুক্তি থাকলেই হলো। সে সারাক্ষণ তটস্থ থাকে। এই গাড়ির ভিড়ে এই শিশুটি নিরাপদে থাকতে পারবে তো। কিন্তু তাদের কোনো বিকার নেই। পথই তাদের জীবিকা, পথই তাদের ঘর, পথেই তাদের খেলা। তাদের আমরা বলি পথশিশু। আমি তাদের দেখি আর আমাদের একমাত্র সন্তান প্রসূনের কথা ভাবি। মুক্তি প্রসূনের গায়ে ধুলা লাগতে দিতো না। সারাক্ষণ তুলু তুলু করে বড় করেছে। তাতে যে খুব ভালো হয়েছে, এমন দাবি করছি না। বরং দেশের ধুলা গায়ে মেখে বড় হলে আরো শক্তপোক্ত হতে পারতো। কিন্তু শক্তপোক্তভাবে বড় হওয়া আর রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে পথে পথে বেড়ে ওঠা এক নয়।

আমি খালি ভাবি প্রসূনের কী বাড়তি যোগ্যতা। আর পথের সেই শিশুটির কী অপরাধ? আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি না। কিন্তু জন্মটা তো নিছকই এক ভাগ্য। কে কোথায় জন্ম নেবে, এটা তো তার ঠিক করার স্বাধীনতা নেই। আমার সন্তান বলে প্রসূন যে সুবিধা পাচ্ছে, স্রেফ গরীব ঘরে জন্ম নেওয়ার অপরাধে পথের শিশুটি বঞ্চিত হচ্ছে। শুধু এই পথশিশু বা আমাদের সন্তান নয়, পৃথিবীর সব শিশুই জন্ম নেয় শূন্য হাতে। তারপর পরিবার তার ভবিষ্যৎ গড়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। চেষ্টা করে লিখলাম, কারণ বিত্তশালী পরিবারে জন্ম নেওয়া অনেকে পরে ভালো মানুষ হতে পারে না। আবার পথ থেকে উঠে আসা অনেকে মেধা ও পরিশ্রমের জোরে অনেক দূর পৌঁছে যায়। এসব তো ব্যতিক্রম। প্রতিটি শিশু পৃথিবীর সম্পদ। প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে লুকিয়ে আছে অমিত সম্ভাবনা। সঠিক পরিচর্যায়ই সেই শিশু সম্পদ হতে পারে। নইলে বিকাশের আগেই ঝরে যাবে সেই সম্ভাবনা। জন্ম নেওয়া প্রতিটি শিশুর দায়িত্ব ধরিত্রীর। আধুনিক ব্যবস্থায় দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু রাষ্ট্র কি সেই দায়িত্ব পালন করছে?

বিভিন্ন জরিপে ধারণা করা হয়, দেশে ১০ লাখেরও বেশি পথশিশু রয়েছে। তার মধ্যে ঢাকাতেই রয়েছে ৭৫ ভাগ। নানা কারণে শিশুদের পথে নামতে হয়। বাবা-মার অনৈতিক সম্পর্কের বলি হতে হয় অনেক শিশুকে। অনেক সময় বাবা-মা, বাবা বা মা মারা গেলেও শিশুকে পথে নামতে হয়।  অনেক সময় বাবা বিয়ে করে অন্যত্র চলে গেলে সন্তানসহ মা’কে পথে নামতে হয়। পথে নামলে তাদের একটাই লড়াই; বেঁচে থাকার, টিকে থাকার। দ্রুতই তারা বুঝে যায়, পৃথিবীটা অনেক কঠিন। এখানে লড়াই ছাড়া টেকা যাবে না। আমরা আমাদের সন্তানদের খাওয়া নিয়ে কত ঢং করি। সন্তান খেতে চায় না বলে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। আর পথের শিশুরা উচ্ছিষ্ট খেয়ে বেড়ে উঠছে। আর সাথে ফ্রি হলো লাথিগুতা আর গালাগাল। শারীরিক নির্যাতন তো আছেই, ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে যৌন নির্যাতনের শিকার।

প্রতিটি শিশুই নিষ্পাপ। কিন্তু বেড়ে উঠতে উঠতেই পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা তাদের বদলে দেয়। তারাও পাল্টা আঘাত করতে যায়। তাতে অনেকে টিকে থাকে, অনেকে হেরে যায়। পথের শিশুটিই একসময় জড়িয়ে পড়ে নানা অপরাধে। কেউ বড় মাস্তান হয়, কেউ ছিঁচকে চোর হয়, কেউ ছিনতাইকারী হয়, কেউ মাদকেই খোঁজে মুক্তি। এভাবেই অমিত সম্ভাবনা ধ্বংস হয় পথে পথে।

পথের শিশুদের দায়িত্ব অবশ্যই রাষ্ট্রের। বর্তমান সরকার জনকল্যাণে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা জালের নানা প্রকল্পে আগলে রাখা হয় দরিদ্র মানুষকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্যোগ নিয়েছেন দেশের সব গৃহহীনকে ঘর বানিয়ে দেওয়ার। এরই মধ্যে এই প্রকল্পে অনেকে চমৎকার সব ঘর পেয়েছেন। এমন কোনো প্রকল্প কী এই পথশিশুদের জন্য নেওয়া যায় না। আমি নিশ্চিত এই প্রকল্পে বিনিয়োগের রিটার্ন সবচেয়ে ভালো হবে। শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। শিশুদের পেছনে বিনিয়োগ করতে পারলে তা দেশ ও জাতির কাজে লাগবে। পথশিশুরা ভবিষ্যতে মাস্তান হবে, মাদকাসক্ত হবে না কি দক্ষ মানবসম্পদ হবে; তা নির্ধারণ করার দায়িত্ব আমাদের সবার। শিশুর তো নিজেকে রক্ষারই সামর্থ্য নেই, ভবিষ্যৎ ঠিক করবে কীভাবে। আমাদের দেশে মানুষ বেশি। তাই বলে তো মানুষের জীবনের মূল্য কম নয়, সম্ভাবনা কম নয়। সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর দায়িত্ব আমাদের সবার। কিন্তু বেদনার কথা হলো লাখো সম্ভাবনাকে আমরা ‘সম্ভব না’য় বদলে দিচ্ছি। পথশিশুরা যদি পথেই বেড়ে ওঠে তাহলে সে হবে রাষ্ট্রের বোঝা। চাইলে এই বোঝাকেই আমরা সম্পদে বদলে দিতে পারি। তারচেয়ে বড় কথা হলো, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান তো মানুষের মৌলিক চাহিদা। আর প্রতিটি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ তো রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্ব। এরপর শিক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করাও রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব।

তবে রাষ্ট্রের পাশাপাশি সমাজের, বিত্তশালীদের দায়িত্বও কম নয়। আমাদের অনেকের এক বিকেলে সোনারগাঁয়ের চা’য়ের বিলেই একটি শিশুর সব চাহিদা পূরণ হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশে যে পরিমাণ ঘোষিত কোটিপতি আছেন, তাদের সবাই ৫ জন করে শিশুর দায়িত্ব নিলেই পথশিশুরা ভবিষ্যতে দেশের কাজে, দশের কাজে লাগতে পারে।

দ্রোহের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য অনেক আগেই লিখে গেছেন,

‘চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ অঙ্গীকার।’

কবির সেই অঙ্গীকার পূরণের দায়িত্ব আমাদের সবাইকে নিতে হবে। নইলে এই শিশুরা আমাদের অভিশাপ দেবে।

প্রভাষ আমিন, হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: দিবস

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

2 × four =