রফিকুল বাসার
স্পষ্ট দুই পক্ষ। এক পক্ষ উন্নত। সম্পদ আর ঐশ্বর্যে ভরপুর। অন্য পক্ষ অনুন্নত ও উন্নয়নশীল। এক পক্ষ অপচয় করে অন্য পক্ষ খেতে পায় না। একজনের বেঁচে থাকার প্রশ্ন। অন্যজনের বিলাসিতা। এক পক্ষের উন্নত থেকে উন্নততর হওয়া। অন্য পক্ষের টিকে থাকার লড়াই।
এই লড়াই থামাতে একমত বিশ্ব। উভয় পক্ষ। কিন্তু বাস্তবায়নে সম্মত নয় এখনই। পৃথিবী রক্ষায় সকলে একমত হলেও কাজটা শুরু করতে চাইছে না কেউই। প্রত্যেকে চাইছে অন্য কোনো দেশ শুরু করুক।
দুবাইয়ে শুরু হতে যাচ্ছে ২৮তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। সম্মেলনে এই দুই পক্ষের মধ্যে দেওয়া নেওয়া আর মানা না মানার নানা বিষয়ে আলোচনা হবে। এই মানা না মানা আর দেওয়া-নেওয়ায় থাকছে খনিজসম্পদ ব্যবহার আর অর্থ ভাগাভাগি।
এক পক্ষ তার উন্নতির জন্য খনিজসম্পদ ব্যবহার করবে ইচ্ছে মতো। এতে জলবায়ু দূষণ হতেই থাকবে। আর এই দূষণের শিকার হবে অন্য পক্ষ। কিন্তু খনিজ ব্যবহার করতে হবে তাদের ইচ্ছায় যারা সম্পদে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
উন্নত দেশগুলো খনিজের ব্যবহার করে জীবনমানকে পরিবর্তন করেছে। অনুন্নত দেশগুলো যখন উন্নয়নের পথে, যখন খনিজের ব্যবহার বাড়াতে উদ্যোগী, তখন বাধ সাধছে উন্নত দেশগুলো।
এখন বিড়ালের গলায় ঘণ্টা কে বাঁধবে তা নিয়ে প্রশ্ন। সম্মত আছে সব দেশ। কিন্তু শুরু করতে চায় না কেউ। প্রত্যেকে বলে অন্যরা আগে করুক। আর তাই চাপটা স্বাভাবিকভাবেই অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের উপর। উন্নত দেশগুলো একাট্টা হয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বলছে, খনিজের ব্যবহার কমাও। কয়লা পোড়ানো বন্ধ কর। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াও। কয়লা পোড়ানোর কারণে কার্বন বের হচ্ছে বেশি। আর তাতে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হচ্ছে। অন্যদের বললেও নিজেরা সে কাজ করছে না।
উন্নয়নশীল দেশগুলো বলছে, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার অনেক বাড়ানো হয়েছে। আরও বাড়াতে আপত্তি নেই। কিন্তু এর খরচ বেশি। এই বাড়তি অর্থ কে দেবে? যদি উন্নত দেশগুলো অর্থ দেয় তবেই সম্ভব।
শুধু তাইই নয় নবায়নযোগ্য জ্বালানির যে প্রযুক্তি তা উন্নত দেশগুলোর হাতেই। তাই প্রযুক্তি পরিবর্তনে যে বিনিয়োগ তাতে সহায়তা চায় উন্নয়নশীল দেশগুলো।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষে এখনই কয়লা ব্যবহার কমানো সম্ভব নয়। কারণ কম দামের বিকল্প জ্বালানি নেই। তাছাড়া অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী আর সামাজিক উন্নয়ন যথাযথ হওয়ার পরেই, উন্নত দেশগুলোর পর্যায়ে যাওয়ার পরেই বিকল্প খনিজ ব্যবহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
যেখানে যত বেশি শিল্প সেখানে তত বেশি উন্নতি। আর যত বেশি শিল্প আর উন্নতি তত বেশি দূষণ। তাই মোটা দাগে এতদিন উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নত দেশগুলোকেই দায়ী করেছে দূষণের জন্য। কিন্তু এখন উন্নত দেশগুলো নতুনভাবে দূষণের মাত্রা নির্ণয়ের কথা বলছে। বলছে, মাথা গুণে দূষণ ঠিক করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে গেলে কার্বন কমাতে হবে। আর কার্বন কমাতে গেলে খনিজ ব্যবহারে সংযত হতে হবে।
কিন্তু নিজ নিজ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিবেচনায় কেউ এই কাজে এগিয়ে আসছে না। বিশেষ করে যারা বেশি খনিজ ব্যবহার করে তারা সিদ্ধান্ত নিতে বাধা দিচ্ছে। ফলে কার্বন কমানোর উদ্যোগ নিতে পারছে না বিশ্ব রাজনৈতিক নেতারা।
জলবায়ু পরিবর্তনের খারাপ প্রভাব মোকাবেলায় কিছু করতে হবে এই সিদ্ধান্তে উপনিত হলেও কে আগে সেই উদ্যোগ নেবে তা নিয়ে চলছে বিশ্ব রাজনৈতিক কূটচাল। সম্মেলনজুড়ে কূটনৈতিক তৎপরতায় ব্যস্ত উন্নত দেশগুলো। আর অনুন্নত দেশগুলো তাদের দাবি আদায়ে মরিয়া।
আমেরিকা, কানাডা, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, জার্মান, জাপানসহ উন্নত দেশগুলো কার্বন কমানোর উদ্যোগে মূল বাধা। এরসাথে যোগ হয়েছে চীন, ভারত আর ব্রাজিল। এই তিনদেশ উন্নয়শীল হলেও প্রচুর কয়লা ব্যবহার করে। তাই উন্নত দেশগুলো এই তিনদেশকে দ্রুত কয়লার ব্যবহার কমাতে বলছে। কিন্তু তারা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা মাথায় রেখে এই সিদ্ধান্তে সম্মত নয়। উন্নত ঐ সব দেশের সাথে ব্রাজিল, চীন ও ভারত কার্বন কমানোর উদ্যোগ না নিতে অনড়। কাগজে কলমে চুক্তি করলেও কীভাবে তা বাস্তবায়ন না করে থাকা যায় সেই প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর কার্বন কমাতে সহায়তা করতে জলবায়ু তহবিল গঠন করা হয়েছে। উন্নত দেশগুলোর অর্থে এই তহবিল। মজার বিষয় হচ্ছে, এই তহবিলের অর্থের মূল কাজ উন্নত দেশগুলোকে আরও বেশি কার্বন নির্গত হতে দেওয়া। অর্থাৎ উন্নয়নশীল দেশ খনিজ পুড়িয়ে, শিল্প চালু রেখে পরিবেশ দূষণ করবে আর উন্নয়নশীল দেশকে তা বন্ধ রেখে দূষণ সমন্বয় করতে হবে।
এতে রাজি উন্নয়নশীল দেশগুলো। তবে তহবিলের অর্থ নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ আছে। এই তহবিলে ৩৩ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে বলে দাবি করেছে উন্নত দেশগুলো। আর উন্নয়শীল দেশগুলো বলছে, দেওয়া হয়েছে মাত্র ৫ বিলিয়ন ডলার। সামাজিক উন্নয়নে যে অর্থ দেওয়া হতো সেগুলোকেও জলবায়ু তহবিলের জন্য দেওয়া হচ্ছে বলে বলছে উন্নত দেশগুলো।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়-ক্ষতি ঠিক করতে আলাদা স্বাধীন সংগঠন গঠন করার কথা ছিল। কিন্তু তা করা হচ্ছে না। এটা না করতে কঠোর অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয় ও ক্ষতি বলতে কিছু নেই বলে তারা দাবি করছে। এজন্য ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের কোনো প্রশ্নই আসে না। বলছে, এটা একটি অভিযোজনের বিষয়। অভিযোজনের মাধ্যমেই এটি নিষ্পত্তি করতে হবে। পরে অস্ট্রেলিয়াও ক্ষয় ও ক্ষতি বলতে কিছু নেই বলে জানিয়েছে।
এবিষয়ে যা কিছু তা সব অভিযোজনের মধ্যে করতে হবে। এ খাতে যে অর্থের প্রয়োজন হবে তা অভিযোজন থেকেই যাবে। আলাদাভাবে কোনো কিছু করার সুযোগ নেই। আলাদা সংগঠন হলে উন্নয়নশীল দেশগুলো আলাদা তহবিল দাবি করবে বলে উন্নতদেশগুলো সম্মত হচ্ছে না। অন্যদিকে জি৭৭ ও চীন গ্রুপও (১৪০টি দেশের জোট) তাদের প্রস্তাবের বিষয়ে অনড়।
আইনগত বাধ্যবাধকতা কার্যকর না হলে পুরো মানব জাতি অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। গ্রিন হাউজ গ্যাসের ঘনত্ব ৪০০ পিপিএম ছাড়িয়ে গেছে। এক তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বিশ্ব এক গুরুতর অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। ধারনা করা হচ্ছে, বৈশ্বিক উঞ্চতা ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে। এ সবকিছুই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার অভিযোজন। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। বাংলাদেশের রয়েছে বিপুল উপকূলীয় অঞ্চল। যা ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে ক্ষত বিক্ষত। লবণাক্ততার কারণে বিপুল পরিমাণ আবাদি জমি অনাবাদি হয়ে পড়েছে। লাখ লাখ মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে।
তাই বাংলাদেশের মতো টিকে থাকার লড়াইয়ে অংশ নেওয়া দেশগুলোরও বাংলাদেশের সাথে সুর মিলিয়ে এই সম্মেলনে জোরাল ভূমিকা রাখতে হবে। অধিকার আদায়ে সোচ্চার হতে হবে।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: পরিবেশ