নির্বাচনে প্রযুক্তির ভালো ও মন্দ

আশফাক আহমেদ

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন ও সংশ্লিষ্টদের কার্যক্রম চলছে। বিগত যে কোনো সময়ের থেকে এবারের জাতীয় নির্বাচনে যে বিষয়টি অনেক বেশি প্রভাব ফেলতে পারে সেটি হলো প্রযুক্তি। এর বিভিন্ন দিক রয়েছে। একদিকে যেমন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। নির্বাচন পরিচালনা পদ্ধতি নিয়ে দেশের মানুষ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে নানা ধরনের বিভ্রান্তি ও সংশয় আছে। বিশ্বাসযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহার একটি সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। কেননা, প্রযুক্তির ব্যবহার নির্বাচন প্রক্রিয়াকে নিখুঁত করতে এবং বিশ্বস্ত নির্বাচন পরিচালনায় সাহায্য করতে পারে। বিপরীতে বিভিন্ন সামাজিকমাধ্যম ও কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার উত্থানে নির্বাচনে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুধরনেরই প্রভাব ফেলতে পারে।

নির্বাচনের সব তথ্য ভোটারদের কাছে সহজে পৌঁছে দিতে মোবাইল অ্যাপ ‘স্মার্ট ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট বিডি’ এবং নির্বিঘ্নে মনোনয়নপত্র দাখিলে প্রার্থীদের ‘অনলাইন নমিনেশন সাবমিশন সিস্টেম (ওএনএসএস)’ উদ্বোধন করেছে নির্বাচন কমিশন। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ‘স্মার্ট ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট বিডি’ অ্যাপে ভোটাররা খুব সহজে ও দ্রুত তথ্য পাবেন। দুই ঘণ্টা পর পর নির্বাচনের তথ্য এখানে সরবরাহ করা হবে। ফলে হঠাৎ করে কোনো কিছু হয়ে গেলে তা বিশ্লেষণের সুযোগ থাকবে। এসব তথ্য নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিতে সহায়ক হবে। একজন ভোটার অ্যাপটি ডাউনলোড করার পর এতে মোবাইল ফোন নম্বর এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করার পর ভোটার নম্বর থেকে শুরু করে সব তথ্য পেয়ে যাবেন। ভোটকেন্দ্রের ভৌগোলিক অবস্থান, প্রার্থীদের সব তথ্য এবং দুই ঘণ্টা পর পর ভোট কার্যক্রমের তথ্যও পাওয়া যাবে অ্যাপটিতে। এছাড়া নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিল করতে গিয়েও অনেকে বাধাগ্রস্ত হন। আবার দাখিলের পর প্রত্যাহারের জন্যও চাপ দেওয়া হয়। অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিল এসব অনাচার কমাতে সহায়ক হবে আশা করা যায়। এর আগেও কয়েকটি উপনির্বাচনে অনলাইনে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা নেওয়া হয়েছে।

এগুলো ছাড়াও আরও কয়েকটি উপায়ে নির্বাচনে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা যেতে পারে। যেগুলো নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ও স্বচ্ছতা বাড়াতে পারে। যেমন অনেক সময় বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে গোলযোগ দেখা যায়। এতে কেন্দ্রের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণ সম্ভব হয়ে ওঠে না। এটি নিয়ে অভিযোগও আসে কিন্তু প্রমাণের অভাবে এর সমাধান হয় না। এই ক্ষেত্রে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে যদি সিসিটিভি ক্যামেরা প্রতিস্থাপন করা হয়, তবে এটি একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করবে। যারা নির্বাচনে গণ্ডগোল সৃষ্টি করতে চায় তাদের জন্য এটি একটি বাধা হিসেবে কাজ করবে। যদি কোনো গণ্ডগোল হয়েও থাকে তাহলে তার সঠিক প্রমাণ থেকে যাবে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় সিসিটিভি মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকলে এ ধরনের খবর পাওয়া যাবে। তাৎক্ষণিকভাবেও সেখানে হস্তক্ষেপ করা সম্ভব হবে। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন বিগত কয়েকটি নির্বাচনে এ ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। যেমন ২০২২ সালে ভোটে অনিয়মের অভিযোগে গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছিল।

ভোটগ্রহণের পর এর গণনা নিয়েও নানা ধরনের প্রশ্ন ওঠে। প্রথমত, ভোট গণনার সময় অবশ্যই পোলিং এজেন্টদের উপস্থিতি থাকা উচিত। এবং ভোট গণনার সময়, ভোটকেন্দ্রের বাইরে একটি বড় মনিটরের মাধ্যমে কেন্দ্রের বাইরে উপস্থিত জনগণের কাছে দৃশ্যমান করা যায়। তাহলে সব রাজনৈতিক দলের প্রার্থী, নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ সবাই ভোট গণনা সরাসরি দেখতে পাবেন। এতে ভোট গণনায় কারচুপি প্রতিহত করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। একইসাথে সবশেষ ফলাফল সম্পর্কে অবগত থাকতে সহায়তা করবে। দৃশ্যমান হওয়ায় ভোট গণনা নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বাড়াবে।

অনেক ক্ষেত্রে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভোটকেন্দ্রে গোলযোগ হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তৎক্ষণাৎ জানানো সম্ভব হয় না। এই সমস্যাকে মোকাবিলা করতে সফটওয়্যার তৈরি করা যেতে পারে। যাতে কোনো সমস্যা হলে ভোটকেন্দ্র থেকে দ্রুত সময়ের মাধ্যমে নিকটস্থ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। নির্বাচনে জালিয়াতি শনাক্তকরণের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অখণ্ডতা এবং নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য একটি শক্তিশালী পদ্ধতি হতে পারে। এছাড়া, ভোটার তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ে এবং মিথ্যা পরিচয় শনাক্ত করতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অন্যান্য সরকারি ডেটাবেজের সঙ্গে ভোটার নিবন্ধন ডেটাবেজগুলোকে ক্রস-চেক করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রত্যেক ভোটারের আঙুলের ছাপের মাধ্যমে তার পরিচয় নিশ্চিত করা গেলে জালিয়াতি মোকাবিলা করা যাবে। এ ক্ষেত্রে আঙুলের ছাপ কেন্দ্রীয় ডেটাবেজের সঙ্গে সংযুক্ত করা যেতে পারে, অথবা আরও সক্রিয় করার জন্য জেলাভিত্তিক ডেটাবেজের সঙ্গে সংযুক্ত করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ভোট গণনায় স্বচ্ছতা বজায় রাখার জন্য ব্লকচেইনের ব্যবহার নিশ্চিত করা যেতে পারে। প্রতিটি ভোট ও লেনদেন ব্লকচেইনে রেকর্ড করা যেতে পারে, এটি নিশ্চিত করে যে একবার ডেটা প্রবেশ করান হলে নেটওয়ার্ক থেকে সম্মতি ছাড়া এটি পরিবর্তন বা মুছে ফেলা যাবে না। ব্লকচেইন নির্বাচনের ফলাফল নিরাপদে প্রেরণ এবং সংরক্ষণ করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি ট্রান্সমিশনের সময় ফলাফল বাধা বা পরিবর্তিত হওয়ার ঝুঁকি দূর করে।

নির্ভুল, নিরপেক্ষ তথ্য প্রদানের মাধ্যমে স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করতে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাংবাদিকদের উচিত কোনো বিশেষ প্রার্থী বা দলের পক্ষপাতিত্ব না করে সুষ্ঠুভাবে তথ্য উপস্থাপন করা। ভুল তথ্যের বিস্তার রোধ করার জন্য তথ্যের সত্যতা যাচাই অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত নির্বাচনের পরিসংখ্যানের ওয়েবসাইটের সঙ্গে হয় গণমাধ্যম সংযুক্ত থাকবে, অথবা গণমাধ্যম তাদের প্রয়োজনে এই পরিসংখ্যান সেখান থেকে যাচাই-বাছাই করে নিতে পারবে। সব ক্ষেত্রেই ফ্যাক্ট চেকের ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লকচেইন ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মতো উদ্ভাবনী সমাধানগুলো ব্যবহার করে, নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এ রকম দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলোর সমাধান করা যেতে পারে।

প্রযুক্তির যেমন উপকারি দিক রয়েছে তেমন প্রযুক্তির অপব্যবহারে নির্বাচনে সমস্যাও তৈরি হতে পারে। যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিজিএইচকিউ’র অংশ এনসিএসসি। সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক বার্ষিক পর্যালোচনায় এনসিএসসি সতর্কবার্তা দিয়েছে, ভোটারদের প্রভাবিত করতে বাস্তবসম্মত ডিপফেইক ভিডিও ও ভুল তথ্য ছড়ানোর ঝুঁকি বাড়ছে। এর মধ্যে রয়েছে ভুলভাবে উপস্থাপন করা অনলাইন পোস্ট ও ডিপফেইক ভিডিও, যা সামাজিক মাধ্যমে দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে। যা প্রার্থী, নির্বাচন প্রক্রিয়া, ভোট, প্রচারণাসহ নানা বিষয় নিয়ে ভুল বা ইচ্ছাকৃত মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর মাধ্যমে জনমনে শঙ্কা এবং প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে। সৃষ্টি হতে পারে ভুল বোঝাবুঝি। শুধু বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নয়, বিশ্বজুড়ে আগামী নির্বাচনগুলোতে ডিপফেইকের মতো প্রযুক্তি বিভ্রান্তি ছড়াবে না তা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। এছাড়া, ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থ হাসিলে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে থাকেন অনেকে। দেশের বিদ্যমান সাইবার নিরাপত্তা আইনের আওতায় প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার মাধ্যমে নির্বাচনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এমন বিষয় দূর করা যেতে পারে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: টেক ট্রেন্ড

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

2 + 13 =